হিপোক্রেটিসের আবিষ্কার
হিপোক্রেটিস (Hippocrates) ছিলেন প্রাচীন গ্রীসের একজন মহান চিকিৎসাবিজ্ঞানী যিনি আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্রের জনক (Father of Modern Medicine) হিসেবে পরিচিত। খ্রিস্টপূর্ব ৪৬০ সালের দিকে জন্মগ্রহণকারী এই জ্ঞানী চিকিৎসকের অবদান চিকিৎসা জগতকে একটি কুসংস্কারমুক্ত, যুক্তিভিত্তিক এবং নৈতিকতাপূর্ণ পথে পরিচালিত করেছিল। তার নামের সাথে যুক্ত “হিপোক্রেটিক শপথ” আজও বিশ্বব্যাপী চিকিৎসকদের জন্য একটি আদর্শ নৈতিক নির্দেশিকা।
এই লেখায় আমরা হিপোক্রেটিসের গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার, মতবাদ, চিকিৎসা পদ্ধতি ও তার প্রভাব নিয়ে আলোচনা করব।
রোগের কারণ বিষয়ে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি
হিপোক্রেটিসের যুগে মানুষ বিশ্বাস করত যে রোগ হচ্ছে দেবতা বা অপদেবতার অভিশাপ। কিন্তু হিপোক্রেটিস এই বিশ্বাসকে অস্বীকার করে বলেন, রোগের কারণ প্রকৃতি, পরিবেশ, খাদ্যাভ্যাস ও জীবনধারা সম্পর্কিত। তিনি যুক্তি দেন যে রোগ হচ্ছে দেহের প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার ফল। এই দৃষ্টিভঙ্গি চিকিৎসাবিজ্ঞানে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছিল।
চার রস তত্ত্ব (Theory of Four Humors)
হিপোক্রেটিসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসাবিদ্যাগত তত্ত্ব ছিল “Four Humors” বা চার রস তত্ত্ব। এই তত্ত্ব অনুসারে, মানবদেহে চারটি প্রধান তরল পদার্থ বা “রস” রয়েছে:
Blood (রক্ত)
Phlegm (কফ)
Yellow bile (হলুদ পিত্ত)
Black bile (কালো পিত্ত)
এই চারটি রসের ভারসাম্য দেহের স্বাস্থ্য নির্ধারণ করে। অতিরিক্ত বা ঘাটতি কোনো রসের ফলে বিভিন্ন রোগ দেখা দেয়। চিকিৎসা তখন সেই ভারসাম্য ফিরিয়ে আনার উপায় হিসেবে বিবেচিত হত — যেমন রক্তস্রাব বা নির্দিষ্ট খাদ্যাভ্যাস প্রয়োগ।
এই তত্ত্ব পরবর্তীকালে রোমান চিকিৎসক গ্যালেন ও মধ্যযুগীয় ইউরোপীয় চিকিৎসাশাস্ত্রে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল।
হিপোক্রেটিক শপথ (Hippocratic Oath)
হিপোক্রেটিসের সবচেয়ে বিখ্যাত অবদান হলো “হিপোক্রেটিক শপথ”, যা এখনো আধুনিক চিকিৎসকদের জন্য নৈতিক আদর্শ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এই শপথে একজন চিকিৎসক প্রতিজ্ঞা করে—
রোগীর ক্ষতি করবেন না (“Do no harm”),
রোগীর গোপনীয়তা রক্ষা করবেন,
নৈতিকতা ও মানবতাবোধ বজায় রাখবেন।
যদিও শপথের আধুনিক সংস্করণ সময়ের সাথে বদলেছে, তবু এর মূল নৈতিক দিকনির্দেশনা অপরিবর্তিত রয়েছে।
রোগ নির্ণয় ও পর্যবেক্ষণ পদ্ধতি
হিপোক্রেটিস রোগ নির্ণয়ে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছিলেন পর্যবেক্ষণ এবং রেকর্ডিং-এর উপর। তিনি রোগীর খাদ্য, ঘুম, মল-মূত্র, শরীরের তাপমাত্রা, শ্বাস-প্রশ্বাস ইত্যাদি লিপিবদ্ধ করতেন এবং সময়ের সাথে রোগের অগ্রগতি লক্ষ্য করতেন। এটিই ছিল আধুনিক ক্লিনিক্যাল পদ্ধতির সূচনা।
তিনি বিশ্বাস করতেন যে প্রকৃতি নিজেই নিরাময়ের পথে এগোয় — “Nature is the physician of diseases”। তাই চিকিৎসকের কাজ হলো রোগীর শরীরকে সেই পথে সহায়তা করা।
অস্ত্রোপচারে সংযম ও সতর্কতা
হিপোক্রেটিস অস্ত্রোপচারের ব্যাপারে খুবই সতর্ক ছিলেন। তিনি ঝুঁকিপূর্ণ ও অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার পরিহারের পরামর্শ দিতেন। সে সময় অনেক চিকিৎসক নানা তাবিজ, অস্ত্র বা খোলা অস্ত্রোপচার করতেন, কিন্তু হিপোক্রেটিস বলেছিলেন: “I will not use the knife… especially in stones”। অর্থাৎ তিনি মূত্রথলির পাথর অপসারণের মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজ অভিজ্ঞ সার্জনের ওপর ছেড়ে দিতে বলতেন।
চিকিৎসার নৈতিকতা ও পেশাদারিত্ব
হিপোক্রেটিস চিকিৎসাকে কেবল পেশা নয়, বরং একটি নৈতিক দায়িত্ব হিসেবে দেখতেন। তিনি চিকিৎসকদের কাছ থেকে—
ধৈর্য, সততা, আত্মসংযম এবং শুদ্ধাচার আশা করতেন।
তার মতে, একজন চিকিৎসককে রোগীকে মানুষ হিসেবে দেখতে হবে, শুধু রোগ নয়। এই মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি আজকের “হোলিস্টিক মেডিসিন”-এর ভিত্তি।
চিকিৎসাবিষয়ক গ্রন্থ
হিপোক্রেটিসের নামে ৭০টির বেশি চিকিৎসাবিষয়ক গ্রন্থ পাওয়া যায়, যেগুলো “Hippocratic Corpus” নামে পরিচিত। যদিও সবগুলো বই তিনি নিজে লেখেননি বলে ধারণা করা হয়, তবুও তার চিন্তাধারার প্রতিফলন এইসব গ্রন্থে সুস্পষ্ট। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য:
On Airs, Waters and Places – রোগের সামাজিক ও পরিবেশগত কারণ আলোচনা করা হয়েছে।
Prognostics – রোগের অগ্রগতির ভবিষ্যদ্বাণী।
Aphorisms – সংক্ষিপ্ত ও গভীর চিকিৎসা বাণী।
হিপোক্রেটিসের প্রভাব
হিপোক্রেটিসের আবিষ্কার ও চিন্তাধারা চিকিৎসাশাস্ত্রকে যুক্তিনির্ভর ও মানবিক পথে পরিচালিত করেছে। তার তত্ত্বগুলো আধুনিক বিজ্ঞানের আলোকে অনেকাংশে ভুল প্রমাণিত হলেও, তিনি যে পর্যবেক্ষণ, নৈতিকতা, ও নথিবদ্ধকরণ-এর উপর জোর দিয়েছিলেন তা আজও চিকিৎসা শিক্ষার ভিত্তি।
হিপোক্রেটিস ছিলেন এমন এক যুগে চিকিৎসা শাস্ত্রের পথিকৃৎ, যখন মানুষ রোগকে অতিপ্রাকৃত বিষয় বলে ভাবত। তিনি যুক্তি, অভিজ্ঞতা ও মানবিকতাকে একত্র করে একটি নতুন ধারার সূচনা করেছিলেন। তার চিকিৎসা পদ্ধতি ও নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চিকিৎসা জগতকে আলোকিত করে যাচ্ছে।
আজও, একজন চিকিৎসক যখন “হিপোক্রেটিক শপথ” গ্রহণ করেন, তখন তিনি কেবল একটি দায়িত্ব গ্রহণ করেন না, বরং একটি প্রাচীন, সম্মানিত ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার বহন করেন — যার সূচনা হয়েছিল হিপোক্রেটিসের হাত ধরেই।
তথ্যসূত্র:
Jones, W.H.S. (Translator). Hippocrates: Volume I-IV. Loeb Classical Library, Harvard University Press.
Nutton, Vivian. Ancient Medicine. Routledge, 2004.
Porter, Roy. The Greatest Benefit to Mankind: A Medical History of Humanity. Harper Collins, 1997.