প্রাইভেট হেনরি স্বেহলা: এক নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগ
১২ জুন ১৯৫২ সাল। পৃথিবীর নানা প্রান্তে যখন মানুষ ব্যস্ত ছিল নিজেদের দৈনন্দিন জীবনে, তখন দূর পূর্ব এশিয়ার পাহাড়ি দেশ কোরিয়ার পিয়ংগনি অঞ্চলের এক দুর্গম পাহাড়ে, ১৯ বছর বয়সী এক তরুণ সৈনিক—প্রাইভেট ফার্স্ট ক্লাস হেনরি স্বেহলা—তার জীবনের সবচেয়ে বীরত্বপূর্ণ এবং শেষ সিদ্ধান্ত নিচ্ছিলেন। এই সিদ্ধান্ত শুধু তার নিজের জীবনকেই বদলে দিয়েছিল না, বরং তার পাশে থাকা সহযোদ্ধাদের জীবনও রক্ষা করেছিল।
হেনরি স্বেহলা ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সির বাসিন্দা। তরুণ বয়সেই সেনাবাহিনীতে যোগ দেন এবং কোরিয়া যুদ্ধের সময় তিনি ৭ম পদাতিক ডিভিশনের ৩২তম পদাতিক রেজিমেন্টের দ্বিতীয় ব্যাটালিয়নের এফ কোম্পানির সদস্য হিসেবে নিয়োজিত হন। ১৯৫২ সালের সেই দিন, তার ইউনিট পাহাড়ি এলাকায় শত্রুবাহিনীর হঠাৎ ও তীব্র আক্রমণের মুখে পড়ে।
শত্রুর ভারী গোলাবর্ষণ এবং গ্রেনেড নিক্ষেপে ইউনিট ছত্রভঙ্গ হওয়ার উপক্রম হয়। এমন অবস্থায়, হেনরি সাহসিকতার সাথে সামনে এগিয়ে গিয়ে শত্রুর দিকে গুলি ছুঁড়তে শুরু করেন, যাতে সহযোদ্ধারা কিছুটা নিরাপদে নিজেদের গুছিয়ে নিতে পারে। তিনি নিজের জীবনকে বাজি রেখে শত্রুর মনোযোগ নিজের দিকে টেনে নেন। তখনই, একটি গ্রেনেড হেনরির খুব কাছে এসে পড়ে—এক মুহূর্তের জন্যও দ্বিধা না করে, তিনি নিজের শরীর দিয়ে গ্রেনেডটিকে ঢেকে ফেলেন। সেই বিস্ফোরণে হেনরি প্রাণ হারান, কিন্তু তার পাশে থাকা সবাই বেঁচে যান।
এই কৃতিত্ব ছিল নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগের এক অনন্য নজির। হেনরির কোনো বাধ্যবাধকতা ছিল না নিজের জীবন উৎসর্গ করার, কিন্তু সৈনিকসুলভ দায়িত্ববোধ এবং সহযোদ্ধাদের প্রতি ভালোবাসা তাকে সে সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছিল।
দীর্ঘদিন ধরে তার এই কীর্তি যথাযথভাবে সম্মানিত হয়নি। তবে অবশেষে, প্রায় ৬০ বছর পর, ২০১১ সালের ২রা মে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা হেনরি স্বেহলাকে মরণোত্তর ‘মেডেল অব অনার’ প্রদান করেন। এটি যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সামরিক সম্মান, যা কেবলমাত্র অসাধারণ সাহসিকতা এবং আত্মত্যাগের জন্য প্রদান করা হয়। প্রেসিডেন্ট ওবামা এক আবেগঘন অনুষ্ঠানে হেনরির পরিবারকে এই সম্মান তুলে দেন এবং বলেন:
“হেনরি স্বেহলার সাহস আমাদের মনে করিয়ে দেয়, বীরত্ব বয়স দেখে আসে না। কোনো একটি মুহূর্তেই একজন মানুষ হয়ে উঠতে পারে ইতিহাসের অংশ।”
হেনরির এই আত্মত্যাগ আজও প্রমাণ করে, কতটা সাহসিকতা, ত্যাগ এবং মানবিকতা লুকিয়ে থাকে এক তরুণ সৈনিকের হৃদয়ে। যুদ্ধের নিষ্ঠুর বাস্তবতায়ও এমন গল্প আমাদের মনে করিয়ে দেয়—বীরত্ব কোনো সিনেমার কল্পকাহিনি নয়, বরং ইতিহাসের বাস্তব পৃষ্ঠা থেকে উঠে আসা সত্য।
তথ্যসূত্র:
U.S. Army Center of Military History
The White House (Medal of Honor Ceremony Archives, July 2011)
Korean War Veterans Memorial