গোষ্ঠীভিত্তিক সমাজকল্যাণ
গোষ্ঠীভিত্তিক সমাজ কাকে বলে
গোষ্ঠীভিত্তিক সমাজ(Group-based society) একটি প্রাচীন সমাজব্যবস্থা,যেখানে সামাজিক সংগঠন গঠিত হয় আত্মীয়তার বন্ধন, রক্তের সম্পর্ক এবং সম্মিলিত পরিচয়ের ভিত্তিতে। এধরনের সমাজে ব্যক্তির পরিচয় নির্ধারিত হয় তার গোষ্ঠী বা কুলের মাধ্যমে, এবং সামাজিক কাঠামোর ভিত্তি হয় একক বা সম্প্রসারিত পরিবার, গোষ্ঠী বা গোত্র। মানব ইতিহাসের শুরুতে যখন রাষ্ট্র, আইন বা কেন্দ্রীয় প্রশাসন গড়ে ওঠেনি, তখন গোষ্ঠীই ছিল মানুষের নিরাপত্তা,সম্পদ বণ্টন এবং সাংস্কৃতিক পরিচয়ের প্রধান ভিত্তি।
গোষ্ঠীভিত্তিক সমাজের মূল বৈশিষ্ট্য
আত্মীয়তা ভিত্তিক সংগঠন:গোষ্ঠীভিত্তিক সমাজে রক্তের সম্পর্ক,যেমন পিতৃসূত্র (patrilineal) বা মাতৃসূত্র (matrilineal),গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সমাজের প্রতিটি সদস্য একটি নির্দিষ্ট কুল বা গোত্রের অন্তর্ভুক্ত এবং সেই পরিচয়েই তার সামাজিক মর্যাদা ও দায়িত্ব নির্ধারিত হয়।
নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব:গোষ্ঠীগত সমাজে সাধারণত একজন প্রবীণ,অভিজ্ঞ বা বংশীয়ভাবে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া নেতা (যেমন: প্রধান, সরদার বা বড়ভাই) কর্তৃত্ব পালন করেন। কখনো এই নেতৃত্ব বংশানুক্রমে, কখনোবা সম্মতিতে নির্ধারিত হয়।
সম্পদের মালিকানা ও বণ্টন:এধরনের সমাজে জমি,পশু কিংবা জলসম্পদের মালিকানা ব্যক্তির নয়,বরং গোষ্ঠীর সম্মিলিত থাকে। প্রত্যেক সদস্য তার গোষ্ঠীর সম্পদের ওপর নির্দিষ্ট হারে অধিকার ভোগ করে।
বিবাহ এবং পারিবারিক নিয়ম:গোষ্ঠীগত সমাজে বিবাহ সাধারণত গোষ্ঠীর বাইরের কাউকে করতে হয় (exogamy)। এতে গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে মৈত্রী ও বন্ধন গড়ে ওঠে। আবার,পণপ্রথা, পিতৃতান্ত্রিক উত্তরাধিকার এবং যৌথ পরিবার প্রথা গোষ্ঠীর ভিত্তিতে গঠিত হয়।
নিয়মকানুন :প্রত্যেক গোষ্ঠীরই কোনো না কোনো নিয়ম-কানুন থাকে। গোষ্ঠীর সদস্যরা সাধারণত এগুলিকে মেনে চলে বা কোনো কোনো সময় মেনে চলতে বাধ্য থাকে। গোষ্ঠীর তার সদস্যদের এগুলোকে মান্য করার জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে চাপ সৃষ্টি করে থাকে। ব্যক্তি তা স্বত্তেও এগুলি না মানলে তাকে গোষ্ঠী থেকে খারিজ করা হয়।
গোষ্ঠীর আকার :ক্ষুদ্রাকৃতি ও বৃহদাকৃতির উভয়ই হতে পারে। মাত্র দুইজন ব্যক্তিকে নিয়েও গোষ্ঠী তৈরি হতে পারে,আবার লাখ লাখ লোক জন নিয়েও একটিমাত্র গোষ্ঠী তৈরি হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ,স্বামী-স্ত্রী এই দুজনকে নিয়ে একটি গোষ্ঠী তৈরি হয় যার নাম পরিবার। আবার কোনো রাজনৈতিক দলও একটি গোষ্ঠী যাতে লাখ লাখ সদস্য থাকতে পারে।
গোষ্ঠী গতিশীল :গোষ্ঠী স্থিতিশীল নয়। এর আকার , আকৃতি , সদস্যসংখ্যা , উদ্দেশ্য , কার্যাবলী প্রভৃতির পরিবর্তন হয়। গোষ্ঠীর সদস্যদের একদিকে যেমন মৃত্যু হয় , আবার অন্যদিকে নতুন সদস্য জন্মায়। আবার বাইরের কোনো শক্তির প্রভাবে এর পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়।
গোষ্ঠীভিত্তিক সমাজের উদাহরণ
আদিম সমাজ:আদিম সমাজ যেমন আফ্রিকার জুলু, আমাজনের ইয়ানোমামি, কিংবা অস্ট্রেলিয়ার অ্যাবরিজিন জনগোষ্ঠীর মধ্যে গোষ্ঠীভিত্তিক কাঠামো পাওয়া যায়। তাদের মধ্যে আত্মীয়তা, ধর্মীয় আচার এবং যৌথ সম্পত্তি ব্যবস্থার এক দৃঢ় গোষ্ঠীগত ভিত্তি রয়েছে।
ভারতীয় উপমহাদেশের গোত্র:প্রাচীন ভারতেও গোষ্ঠীগত সমাজব্যবস্থা দেখা যায়, যেমন ঋগ্বেদীয় যুগের বিভিন্ন ‘জন’ ও ‘বিশ’ (গোষ্ঠী)। আজও অনেক উপজাতি যেমন সাঁওতাল, গারো, চাকমা ইত্যাদির সমাজে গোষ্ঠীগত সংগঠন বিদ্যমান।
আফগানিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যে:পাশতুন,বেদুইন ও কুর্দি জাতিগোষ্ঠীর সমাজে এখনো গোষ্ঠীভিত্তিক কাঠামো টিকে আছে। তাঁদের মধ্যে ‘কাবিলা’ বা ‘ট্রাইব’ ভিত্তিক নেতৃত্ব, সম্মান রক্ষার জন্য যুদ্ধ, এবং গোষ্ঠীসীমার ভিতর সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রচলিত।
সামাজিক কার্যাবলি ও ধর্মীয় ভূমিকা
গোষ্ঠীগত সমাজে ধর্ম ও আচার একটি ঐক্যবদ্ধ চেতনা গঠনে সহায়ক হয়। অনেক সময় গোষ্ঠীর নিজস্ব উপাস্য, টোটেম বা দেবদেবীর পূজা দেখা যায়, যেগুলো তাদের ঐতিহ্য ও পরিচয়ের অংশ হয়ে থাকে। গোষ্ঠীর মৃত্যু, বিবাহ, জন্ম, ফসল উৎসব ইত্যাদি একসঙ্গে পালন করা হয়, যা তাদের পারস্পরিক বন্ধন জোরালো করে।
গোষ্ঠীভিত্তিক সমাজের সুবিধা
সামাজিক নিরাপত্তা:গোষ্ঠী একটি প্রতিরক্ষামূলক ইউনিট হিসেবে কাজ করে। শত্রু আক্রমণ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা অর্থনৈতিক সংকটে গোষ্ঠীর সদস্যরা একে অপরকে সাহায্য করে।
সম্পদ ভাগাভাগি:সমষ্টিগত মালিকানার ফলে একক সম্পদে অধিকার না থাকলেও সবাই একযোগে জীবন ধারণ করতে পারে। এতে সম্পদের ওপর ব্যক্তিগত লোভ বা সংঘর্ষ তুলনামূলকভাবে কম হয়।
ঐক্য ও পরিচয়বোধ:গোষ্ঠী মানুষকে একটি সমন্বিত পরিচয় দেয় এবং ‘আমরা’ বনাম ‘তারা’ ধারণার মাধ্যমে পারস্পরিক সহযোগিতা এবং সংস্কৃতি সংরক্ষণে সহায়তা করে। গোষ্ঠীর সদস্যরা একটি ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ। এই ঐক্য থেকেই জন্ম হয় গোষ্ঠী সংহতি বা group solidarity – র। এই একাত্মতা বা ঐক্যবোধ সদস্যদের পরস্পরের আবেদনে সাড়া দিতে শেখায় ও অনুপ্রাণিত করে। গোষ্ঠীর মধ্যেকার এই ঐক্য ও সংহতি সদস্যদের একই বন্ধনে বেঁধে রাখে।
অভিন্ন আচার-আচরণ ও জীবনযাত্রা:গোষ্ঠীর সদস্যদের স্বার্থ বা প্রয়োজন অভিন্ন ও তাদের মধ্যে সম্পর্ক থাকায় তারা সেই প্রয়োজন মেটানোর জন্য যৌথভাবে সচেষ্ট হয়। এইভাবে দেখা যায় , তাদের আচার-আচরণও অভিন্ন হয়ে থাকে। এই আচরণগত অভিন্নতা থেকেই তারা অভিন্ন জীবনযাত্রার অংশীদার হয়ে পড়ে।
গোষ্ঠীগত সমাজের সীমাবদ্ধতা
বহিরাগত বিরোধিতা:গোষ্ঠীভিত্তিক সমাজে বহিরাগতদের প্রতি সন্দেহপ্রবণতা তৈরি হয়। অনেক সময় অন্য গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সংঘাত বা প্রতিশোধমূলক রীতি দেখা যায়, যা শান্তি বিনষ্ট করতে পারে।
পরিবর্তনবিরোধী মনোভাব:গোষ্ঠীগত নিয়ম-কানুন কঠোর হয় এবং নতুন চিন্তা, শিক্ষা বা সামাজিক পরিবর্তনের প্রতি প্রতিরোধ গড়ে ওঠে।
নারী অধিকার ও বৈষম্য:অনেক গোষ্ঠীগত সমাজে নারীর ভূমিকা সীমাবদ্ধ থাকে, বিশেষ করে পিতৃতান্ত্রিক সমাজে। নারীদের মতামত উপেক্ষিত হয় এবং কখনো তারা পণবস্তু হিসেবে বিবেচিত হয়।
আধুনিক সমাজে প্রভাব ও পরিবর্তন
বর্তমান বিশ্বে রাষ্ট্রীয় কাঠামো, আইনি ব্যবস্থা, নগরায়ন ও বৈশ্বিক যোগাযোগ গোষ্ঠীভিত্তিক সমাজকে অনেকাংশে বিলুপ্ত করেছে। তবে অনেক উপজাতীয় ও ঐতিহ্যবাহী জনগোষ্ঠী এখনও গোষ্ঠীভিত্তিক সংগঠনের উপর নির্ভরশীল।
এছাড়া, আধুনিক সমাজেও ‘গোষ্ঠী’ধারণাটি নতুন রূপে বিদ্যমান—যেমন জাতি, ধর্ম, ভাষা বা সংস্কৃতির ভিত্তিতে গড়ে ওঠা গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়। সামাজিক মিডিয়া বা রাজনীতিতেও “গ্রুপ আইডেন্টিটি” বা গোষ্ঠীগত পরিচয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
গোষ্ঠীভিত্তিক সমাজ মানব সভ্যতার একটি প্রাথমিক ও মৌলিক কাঠামো যা যুগের পর যুগ ধরে মানবজাতিকে সংগঠিত, নিরাপদ ও সাংস্কৃতিকভাবে ঐক্যবদ্ধ রাখে। যদিও আধুনিক রাষ্ট্র ও নাগরিক সমাজ গোষ্ঠীভিত্তিক কাঠামোকে অতিক্রম করেছে, তবুও এর সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও নৈতিক প্রভাব আজও অনেক জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিদ্যমান। গোষ্ঠীভিত্তিক সমাজের ইতিবাচক দিকগুলোকে সম্মান করে এবং নেতিবাচক দিকগুলো দূর করে একটি ভারসাম্যপূর্ণ সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব।
তথ্যসূত্র:
Emile Durkheim, The Division of Labour in Society
Marvin Harris, Cultural Anthropology
UNESCO: Indigenous Peoples & Social Structure