জর্জ ওয়াশিংটন
জর্জ ওয়াশিংটন (George Washington) ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম রাষ্ট্রপতি,আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রধান সেনাপতি এবং আধুনিক যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম। তার নেতৃত্ব, সাহসিকতা এবং রাষ্ট্র পরিচালনার দূরদর্শিতাই তাকে “জাতির পিতা” (Father of the Nation) হিসেবে মর্যাদা দিয়েছে। তিনি ১৭৩২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি ভার্জিনিয়া রাজ্যের ওয়েস্টমোরল্যান্ড কাউন্টিতে জন্মগ্রহণ করেন।
শৈশব ও প্রাথমিক জীবন
জর্জ ওয়াশিংটনের পিতা অগাস্টিন ওয়াশিংটন একজন জমিদার ও কৃষক ছিলেন। তার মা মেরি বল ওয়াশিংটন ছিলেন ধর্মভীরু এবং কঠোর মা। ওয়াশিংটনের শৈশব কেটেছে ভার্জিনিয়ার গ্রামীণ অঞ্চলে। তিনি কখনও কলেজে পড়েননি, তবে অঙ্ক, জ্যামিতি, ভূগোল ও জরিপবিদ্যায় দক্ষতা অর্জন করেন। কৈশোরেই তিনি একজন পেশাদার জরিপকারী হিসেবে কাজ শুরু করেন।
ওয়াশিংটন মূলত ইংরেজ ভদ্র সম্প্রদায় বংশোদ্ভূত। তার পূর্বপুরুষগণ ইংল্যান্ডের সালগ্রেভ থেকে আমেরিকায় যান। তার প্র-পিতামহ জন ওয়াশিংটন ১৬৫৬ সালে ভার্জিনিয়া গমন করেন এবং জমি ও ক্রীতদাসদের একত্রিত করেন।
একই কাজ করেন তার পুত্র লরেন্স ওয়াশিংটন এবং তার নাতী, জর্জের পিতা অগাস্টিন ওয়াশিংটন। অগাস্টিন ছিলেন একজন তামাক চাষী এবং তিনি তার জমিতে লোহা উৎপাদনে বিনিয়োগ করেন। জর্জের বাল্যকালে অগাস্টিন ভার্জিনিয়ার ভদ্র সম্প্রদায়ের মধ্যবিত্ত সদস্য ছিলেন।
জর্জ ওয়াশিংটনের ছয়জন ভাইবোন প্রাপ্ত বয়স্ক হয়েছিল,যাদের মধ্যে লরেন্স ও অগাস্টিন জুনিয়র -এই দুইজন ছিল তার পিতার প্রথম পক্ষের স্ত্রী জেন বাটলার ওয়াশিংটনের গর্ভের। তার বাকি চার ভাইবোনরা হল স্যামুয়েল, বেটি এলিজাবেথ, জন অগাস্টিন, ও চার্লস।
তার তিনজন ভাইবোন প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার পূর্বে মারা গিয়েছিল। তাদের মধ্যে তার বোন মিলড্রেড এক বছর বয়সে মারা যায়, তার সৎভাই বাটলার শিশুকালে মারা যায় এবং সৎবোন জেন বার বছর বয়সে মারা যায়, তখন জর্জের বয়স ছিল দুই। তার পিতা ১৭৪৩ সালে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে মারা যান। তখন তার বয়স এগার।
সামরিক জীবন,ফরাসি ও ভারতীয় যুদ্ধ
ওয়াশিংটন ফরাসি ও ভারতীয় যুদ্ধে ভার্জিনিয়ার ব্রিটিশ উপনিবেশের মিলিশিয়ার মেজর হিসেবে সেনাবাহিনীতে তার কর্মজীবন শুরু করেন। ১৭৫৩ সালে তাকে ব্রিটিশ রাজের দূত হিসেবে দুর-উত্তরে বর্তমান পেনসিলভানিয়ার এরিতে ফরাসি ও ভারতীয় অফিসালদের নিকট পাঠানো হয়। তার প্রথম বড় অভিযানের নেতৃত্ব ছিল ওহাইও উপত্যকায়।
ওহাইও কোম্পানি ছিল ওহাইও উপত্যকায় ব্যবসায় সম্প্রসারণের জন্য ব্রিটিশ বিনিয়োগকারীদের অন্যতম মাধ্যম, যার মাধ্যমে ভারতীয় বাণিজ্যে নতুন দিগন্তের সূচনা হয়। ১৭৫৩ সালে ফরাসিরা ওহাইও কাউন্টিতে তাদের সেনা মোতায়ন নিয়ন্ত্রণে নিয়ে যায়।
ভার্জিনিয়া ও পেনসিলভানিয়ার ব্রিটিশ উপনিবেশ ওহাইওকে তাদের নিজেদের অঞ্চল হিসেবে দাবী করে। এ থেকে দুই অঞ্চলের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়, যা পরে ফরাসি ও ভারতীয় যুদ্ধ (১৭৫৪-১৭৬২)নামে পরিচিতি লাভ করে এবং এ থেকেই বিশ্বব্যাপী সাত বছরের যুদ্ধ (১৭৫৬-৬৩) শুরু হয়। ওয়াশিংটন শুরু থেকেই এই যুদ্ধে জড়িত হয়ে পড়েন। যদিও শুরুতে সামরিক অভিজ্ঞতা কম থাকায় তিনি একাধিক ব্যর্থতার মুখোমুখি হন, তবুও তার সাহসিকতা ও নেতৃত্বের গুণ প্রশংসিত হয়।
বিবাহ ও ব্যক্তিগত জীবন
১৭৫৯ সালে তিনি ধনী বিধবা মার্থা কাস্টিসকে (Martha Custis) বিয়ে করেন। তারা কোনো সন্তান জন্ম দেননি, তবে মার্থার আগের বিবাহ থেকে দুটি সন্তান দত্তক হিসেবে লালন-পালন করেন। বিবাহের পর তিনি মাউন্ট ভার্নন নামক নিজ বাসভবনে ফিরে যান এবং কৃষিকাজ ও সামাজিক কার্যক্রমে মনোনিবেশ করেন।
স্বাধীনতা যুদ্ধ ও নেতৃত্ব
১৭৭৫ সালে আমেরিকার ১৩টি উপনিবেশ ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। সেই সময় কন্টিনেন্টাল কংগ্রেস জর্জ ওয়াশিংটনকে প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করে। তিনি ছিলেন সুসংগঠিত, কর্তব্যপরায়ণ এবং কৌশলী নেতা। দীর্ঘ আট বছর ব্রিটিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়ে তিনি শেষ পর্যন্ত আমেরিকার স্বাধীনতা নিশ্চিত করেন।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিজয় আসে ১৭৮১ সালে ইয়র্কটাউনে,যেখানে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর প্রধান কর্নওয়ালিস আত্মসমর্পণ করেন। এই যুদ্ধের পর ১৭৮৩ সালে প্যারিস চুক্তির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে।
রাষ্ট্র গঠনে ভূমিকা
যুদ্ধশেষে ওয়াশিংটন সেনাপতির পদ ত্যাগ করে নিজ বাসভবনে ফিরে যান—এটি ছিল ইতিহাসে বিরল এক ঘটনা, কারণ সাধারণত বিজয়ী সেনানায়করা ক্ষমতা আঁকড়ে থাকেন। ১৭৮৭ সালে যখন মার্কিন সংবিধান রচনা হয়,তখন তিনি সেই কনভেনশনের সভাপতিত্ব করেন।
১৭৮৯ সালে সর্বসম্মতিক্রমে তাকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করা হয়। তিনি ১৭৮৯ থেকে ১৭৯৭ সাল পর্যন্ত দুই মেয়াদে রাষ্ট্রপতি ছিলেন। তার শাসনামলে নতুন রাষ্ট্রের ভিত্তি রচিত হয়, অর্থনীতি ও বিচারব্যবস্থা গড়ে ওঠে, এবং পররাষ্ট্রনীতিতে নিরপেক্ষতা অনুসরণ করা হয়।
রাষ্ট্রপতির ভূমিকা ও নীতিমালা
রাষ্ট্রপতি হিসেবে ওয়াশিংটনের প্রশাসন ছিল বাস্তববাদী ও মধ্যপন্থী। তিনি ফেডারেল সরকারের কর্তৃত্বকে শক্তিশালী করেন এবং সংবিধান বাস্তবায়নে গুরুত্ব দেন। তার মন্ত্রিসভায় ছিলেন আলেকজান্ডার হ্যামিলটন (অর্থমন্ত্রী) ও থমাস জেফারসন (পররাষ্ট্র মন্ত্রী),যাদের মাঝে মতবিরোধ থাকলেও তিনি ভারসাম্য বজায় রাখেন।
ওয়াশিংটন সবসময় রাজনৈতিক বিভাজনের বিপক্ষে ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে রাজনৈতিক দল বিভাজনের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। এছাড়া তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে ইউরোপীয় কূটনৈতিক বিরোধ থেকে দূরে রাখার পরামর্শ দেন।
বিদায় ও উত্তরাধিকার
দুই মেয়াদ শেষে ১৭৯৭ সালে ওয়াশিংটন স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ত্যাগ করেন—এটি ছিল গণতন্ত্রের জন্য এক যুগান্তকারী দৃষ্টান্ত। তার বিদায়ী ভাষণ, যা “Farewell Address” নামে পরিচিত, আমেরিকান রাজনীতির জন্য দিকনির্দেশনামূলক হয়ে ওঠে।
১৭৯৯ সালের ১৪ ডিসেম্বর তিনি মাউন্ট ভার্ননে মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুতে আমেরিকান জাতি গভীর শোক প্রকাশ করে। পরবর্তীতে কংগ্রেস তাকে “প্রথম রাষ্ট্রপতি,প্রথম সেনানায়ক এবং প্রথম নাগরিক” হিসেবে ঘোষণা করে।
ঐতিহাসিক প্রভাব ও স্মৃতি
জর্জ ওয়াশিংটন শুধু একজন সেনানায়ক বা রাষ্ট্রপতি ছিলেন না, তিনি ছিলেন আদর্শ ও নৈতিক নেতৃত্বের প্রতীক। আমেরিকার রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসি, একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়, রাজ্য ও শহর তার নামে নামকরণ করা হয়েছে। আমেরিকার এক ডলারের নোট এবং কোয়ার্টার কয়েনে তার মুখমণ্ডল অঙ্কিত।
তার নৈতিকতা, দেশপ্রেম ও কর্তব্যনিষ্ঠা আজও বিশ্বজুড়ে নেতা ও নাগরিকদের অনুপ্রেরণা যোগায়।
জর্জ ওয়াশিংটনের জীবন কেবলমাত্র ইতিহাসের অধ্যায় নয়, বরং আদর্শ নেতৃত্বের জীবন্ত উদাহরণ। রাজনীতি ও ক্ষমতার শীর্ষে পৌঁছে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং গণতান্ত্রিক চেতনাকে অক্ষুণ্ন রাখা—এই শিক্ষাই তিনি দিয়ে গেছেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে। তাঁর অবদান ছাড়া আধুনিক যুক্তরাষ্ট্রের জন্ম কল্পনা করাও কঠিন।
তথ্যসূত্র:
National Archives (USA)
Mount Vernon Official Site
Library of Congress
Biography.com