Friday, October 3, 2025
Homeজীবনীসম্রাট অশোকের জীবনী

সম্রাট অশোকের জীবনী

সম্রাট অশোকের জীবনী

সম্রাট অশোক (খ্রিষ্টপূর্ব ৩০৪ – খ্রিষ্টপূর্ব ২৩২) ছিলেন মৌর্য সাম্রাজ্যের তৃতীয় এবং অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্রাট, যিনি তার শাসনকালকে হিংসা থেকে অহিংসার পথে রূপান্তর করে ইতিহাসে এক অনন্য স্থান দখল করেছেন। তিনি শুধু ভারতবর্ষেই নন, বরং গোটা এশিয়া ও মানবজাতির ইতিহাসে চিরস্মরণীয় একজন শাসক।

শৈশব ও প্রাথমিক জীবন

সম্রাট অশোকের জন্ম খ্রিষ্টপূর্ব ৩০৪ সালে পাটলিপুত্রে (বর্তমান পাটনা) মৌর্য সম্রাট বিন্দুসার ও তার এক রানীর গর্ভে। তিনি ছিলেন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের পৌত্র। যদিও অশোক জন্মসূত্রে রাজপুত্র হলেও, তাঁর মা ছিলেন এক অপেক্ষাকৃত নিম্নবর্গীয় স্ত্রী, যার কারণে রাজদরবারে তাঁর প্রাথমিক দিনগুলো সহজ ছিল না।

অশোক ছোটবেলা থেকেই সাহসী, বুদ্ধিমান এবং কঠোর পরিশ্রমী ছিলেন, যার ফলে রাজনীতিতে তার প্রভাব ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। তাঁকে তক্ষশিলায় পাঠানো হয় রাজনীতি ও প্রশাসনিক শিক্ষার জন্য। অল্প বয়সেই তিনি বিদ্রোহ দমন করে সাহসিকতা দেখান, বিশেষ করে তক্ষশিলার বিদ্রোহ। এই দক্ষতার জন্য তাঁর পিতা বিন্দুসার তাঁকে আরও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিতে শুরু করেন।

নাম ও উপাধিসমূহ

সংস্কৃত শব্দ “অশোক” অর্থ শোকবিহীন বা দুঃখহীন। সমাসগত দিক থেকে শব্দটি বহুব্রীহি। অশোকাবদান গ্রন্থানুসারে, তিনি জন্ম নিয়ে মাতার দুঃখ দূর করেছিলেন বিধায় তার মাতা তাঁকে এ নাম দিয়েছিলেন। সম্রাট অশোকের তাম্রশাসনে তার “দেবনামপ্রিয়” নামটি পাওয়া যায়।

তার সমসাময়িক সিংহলরাজের নাম ছিল দেবনামপ্রিয় তিষ্য (প্রকৃত পালি নাম: দেবনামপিয় তিস্স) এবং তার বংশধর দশরথ মৌর্যেরও এমন নাম ছিল। তাই প্রায়ই বিভ্রান্তি হতো যে সত্যিকার অর্থেই অশোকের নাম বা উপাধি “দেবনামপ্রিয়” কিনা।

তবে মাস্কি (ভারতের কর্ণাটকের স্থান) ও গুজার্রা (মধ্যপ্রদেশ) অঞ্চলে প্রাপ্ত শিলালিপিতে অশোক ও দেবনামপ্রিয়কে একই ব্যক্তি বলে অভিহিত করা হয়েছে। দেবনামপ্রিয় (পালি: দেবনামপিয়) সংস্কৃত শব্দটির অর্থ দেবতাদের প্রিয় অথবা যিনি দেবতাদের প্রিয়।

তৃতীয়-চতুর্থ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের পালি গ্রন্থ দীপবংস সম্রাট অশোককে “পিয়দসি” (সংস্কৃত প্রিয়দর্শী) নামে অভিহিত করেছে। ক্রূর স্বভাবের জন্য তিনি “চণ্ডাশোক” নামে পরিচিত। চণ্ড অর্থ প্রচণ্ড বা ভয়ানক। সুতরাং এ নাম দ্বারা তার ভয়ানক স্বভাব প্রকাশ পাচ্ছে।

ক্ষমতায় আরোহণ

বিন্দুসার মৃত্যুর পর রাজপরিবারে উত্তরাধিকার নিয়ে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম শুরু হয়। অশোক বহু ভাইকে পরাজিত করে অবশেষে খ্রিষ্টপূর্ব ২৬৯ সালে মৌর্য সাম্রাজ্যের সম্রাট হন। তাঁর শাসনকালের শুরুতে তিনি ছিলেন এক কঠোর ও রক্তপিপাসু শাসক। ক্ষমতা সংহত করার জন্য তিনি বহু বিদ্রোহী ও বিরোধী রাজপুত্রকে নির্মমভাবে হত্যা করেন।

সাম্রাজ্য বিস্তার

পিতা বিন্দুসার ও পিতামহ চন্দ্রগুপ্তের রেখে যাওয়া সাম্রাজ্যের আয়তন, সামরিক শক্তি ও সমৃদ্ধি অশোক বহুগুণে বৃদ্ধি করেছিলেন। সিংহাসনে আরোহণ করে অশোক পরবর্তী আট বছর তার সাম্রাজ্য বিস্তারে মনোনিবেশ করেন।

উত্তরে হিন্দুকুশ পর্বতমালা থেকে শুরু করে দাক্ষিণাত্যের কিছু অংশ বাদ দিয়ে সমগ্র ভারতবর্ষ তার করায়ত্ত হয়। অর্থাৎ তার রাজত্ব বর্তমান ভারত, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের অধিকাংশ জায়গা, বাংলাদেশ এবং আনুমানিক নেপালের কিয়দংশেও সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। তার রাজত্বকালের অষ্টম বর্ষে তিনি কলিঙ্গ আক্রমণ করেন। ভয়াবহ এই কলিঙ্গের যুদ্ধে প্রায় এক লক্ষ মানুষ নিহত এবং দেড় লক্ষ মানুষ নির্বাসিত হয়েছিল।

কলিঙ্গ যুদ্ধ: জীবনের মোড় পরিবর্তন

অশোকের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল কলিঙ্গ যুদ্ধ, যা খ্রিষ্টপূর্ব ২৬১ সালে সংঘটিত হয়। কলিঙ্গ (বর্তমানে ওড়িশা) ছিল একটি স্বাধীন ও সমৃদ্ধ রাজ্য, যা মৌর্য সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল না।

অশোক কলিঙ্গ জয় করতে এক বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে আক্রমণ চালান। যুদ্ধ ছিল ভয়াবহ ও রক্তক্ষয়ী — ইতিহাসবিদদের মতে প্রায় ১ লক্ষ লোক নিহত এবং আরও বহু লোক আহত ও বন্দি হয়।

এই যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখে অশোকের মনে গভীর দুঃখ ও অনুশোচনা জন্ম নেয়। কলিঙ্গ যুদ্ধ অশোকের জীবনের একটি মোড় পরিবর্তনকারী ঘটনা হয়ে ওঠে। যুদ্ধের পর তিনি উপলব্ধি করেন যে জয়লাভের চেয়ে মানুষের জীবন ও শান্তি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, “জয় আমার হয়েছে, কিন্তু এই জয় আমাকে শান্তি দেয়নি।”

বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষা

কলিঙ্গ যুদ্ধের পর অশোক বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন এবং অহিংসা, সহানুভূতি ও মানবিকতাকে তাঁর শাসনের মূলনীতি করেন। তিনি উপগুপ্ত নামে এক বৌদ্ধ ভিক্ষুর কাছ থেকে ধর্ম দীক্ষা গ্রহণ করেন। বৌদ্ধ ধর্মের মূল আদর্শ – অহিংসা (অহিংসা পরম ধর্ম), সহনশীলতা, মৈত্রী ও করুণাবোধ – তিনি রাজনীতিতেও প্রয়োগ করতে শুরু করেন।

শাসনব্যবস্থা ও সংস্কার

অশোক ছিলেন একজন প্রশাসক হিসেবেও দক্ষ। বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষা নেওয়ার পর তিনি তাঁর শাসনব্যবস্থায় ব্যাপক সংস্কার আনেন। তিনি “ধর্ম” নামে একটি নীতি চালু করেন, যার মাধ্যমে সমস্ত জাতি, ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মধ্যে সহিষ্ণুতা ও নৈতিক আচরণ প্রসারিত হয়।

তিনি ধর্মমহামাত্র নামক এক ধরনের কর্মকর্তার পদ সৃষ্টি করেন, যারা মানুষের মধ্যে নৈতিকতা ও ধর্মজ্ঞান প্রচারে কাজ করত। গরিব, বৃদ্ধ ও পশুদের কল্যাণে আইন প্রণয়ন করা হয়। হাসপাতাল, বিশ্রামাগার, কূপ, বৃক্ষরোপণ ও পথ নির্মাণে তার উদ্যোগ ছিল অসাধারণ।

ধর্ম প্রচার ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক

অশোক শুধুমাত্র ভারতেই নয়, ভারত উপমহাদেশের বাইরে – বিশেষত শ্রীলঙ্কা, আফগানিস্তান, মায়ানমার, নেপাল এবং মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন দেশে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারে ভূমিকা রাখেন। তাঁর পুত্র মহেন্দ্র ও কন্যা সংঘমিত্রাকে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারের জন্য শ্রীলঙ্কায় পাঠানো হয়।

অশোকের সময়েই বৌদ্ধ ধর্ম আন্তর্জাতিক ধর্মে পরিণত হয়। তিনি বিভিন্ন স্থানে ধর্মালয়, স্তূপ, এবং চতুর্দশ ধর্মলিপি খোদাই করে তার বাণী প্রচার করেন। এই ধর্মলিপিগুলো ব্রাহ্মী, খরোষ্ঠী ও আরামাইক লিপিতে খোদাই করা ছিল।

স্তম্ভ ও শিলালিপি

সম্রাট অশোকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি হচ্ছে তাঁর নির্মিত অশোক স্তম্ভ ও শিলালিপি, যেগুলো ভারতে সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছে। এই স্তম্ভ ও শিলালিপিগুলিতে তিনি তাঁর নীতিবাক্য ও আদর্শ তুলে ধরেছেন। অশোক স্তম্ভের মাথায় খোদাই করা চারটি সিংহের মূর্তি আজ ভারতের জাতীয় প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

স্মৃতিচিহ্ন

সম্রাট অশোকের কীর্তি বিভিন্ন প্রতীক, উৎকীর্ণলিপি শিল্প, মুদ্রা ইত্যাদিতে উদ্ভাসিত। অশোকের স্মৃতিচিহ্ন তার সমসাময়িক ভারত, পাকিস্তান,আফগানিস্তান, বাংলাদেশ ও নেপালের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত।

মৃত্যু ও উত্তরাধিকার

সম্রাট অশোক খ্রিষ্টপূর্ব ২৩২ সালে প্রায় ৭২ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর মৌর্য সাম্রাজ্যের শক্তি ধীরে ধীরে হ্রাস পেতে থাকে। কিন্তু অশোকের নীতি ও দর্শন ইতিহাসে অমর হয়ে থাকে। তিনি প্রমাণ করেন যে একজন সম্রাট শুধু শক্তির দ্বারা নয়, মানবিকতা ও নীতির দ্বারা বিশ্বজয় করতে পারে।

সম্রাট অশোক ছিলেন এমন এক ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব, যিনি হিংসা থেকে মানবতা, যুদ্ধ থেকে শান্তির পথে চলার এক আদর্শ উদাহরণ। তিনি কেবল একজন সম্রাটই ছিলেন না, বরং একজন মহান দার্শনিক ও নীতিশ্রুত নেতা ছিলেন। তার জীবন ও কর্ম আজও শান্তিপ্রিয় মানবতার জন্য প্রেরণার উৎস।

তথ্যসূত্র:

অশোকবনিতে শিলালিপি ও স্তম্ভলিপি (Ashokan Edicts)

।”The Edicts of King Asoka” – রোমিলা থাপার

“A History of Ancient and Early Medieval India” – Upinder Singh

“Ashoka: The Search for India’s Lost Emperor” – Charles Allen

“Buddhist India” – T.W. Rhys Davids

জাতীয় জাদুঘর (National Museum of India) ও ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ (ASI) নথিপত্র।

Itihasar Golpo
Itihasar Golpohttps://itihasargolpo.com
Step into the past with our unforgettable historical journey. Discover the secrets of history on our captivating journey.
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments