মৃত দিবস উৎসব
দিও দে লোস মুয়ের্তোস (Día de los Muertos) – “মৃত দিবস উৎসব” – মেক্সিকোর একটি গভীর অর্থবহ সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় উৎসব, যা মৃত প্রিয়জনদের স্মরণ ও উদযাপনের জন্য পালিত হয়। এই উৎসবটি প্রতি বছর ১ ও ২ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হয়, যা ক্যাথলিকদের All Saints’ Day ও All Souls’ Day-এর সাথে সাংস্কৃতিকভাবে মিলে যায়, কিন্তু এর উৎপত্তি ও রীতিনীতির শিকড় গভীরভাবে প্রাক-কোলম্বিয়ান (অ্যাজটেক ও মায়া) সভ্যতার মধ্যে নিহিত।
উৎসবের উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য
দিও দে লোস মুয়ের্তোস উৎসবের মূল দর্শন হলো — মৃত্যু শেষ নয়, বরং নতুন এক আত্মিক সংযোগের শুরু। এই দিনে বিশ্বাস করা হয়, মৃত আত্মারা পৃথিবীতে ফিরে আসেন তাদের পরিবারের কাছে। জীবিতরা তাদের প্রিয়জনদের স্মরণ করে, খাবার, ফুল, গান, প্রার্থনা এবং আনন্দ-উৎসবের মাধ্যমে তাদেরকে বরণ করে নেয়। এটি শোকের উৎসব নয় বরং এক আনন্দময় পুনর্মিলন।
উৎসবের ইতিহাস
প্রাক-স্প্যানিশ শিকড়:
এই উৎসবের উৎপত্তি হাজার বছরের পুরনো। অ্যাজটেক, নাহুয়া, তলটেক জাতিগোষ্ঠী বিশ্বাস করত, মৃত্যু জীবনের চক্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তারা মৃতদের আত্মাকে সম্মান জানাত এবং উৎসর্গ করত ফুল, খাবার, এবং রঙিন চিত্রকর্ম।
খ্রিস্টধর্মের প্রভাব:
স্প্যানিশ উপনিবেশের পর, ক্যাথলিক খ্রিস্টান ধর্মের প্রভাব পড়ে। এর ফলে প্রাচীন আদিবাসী রীতির সঙ্গে খ্রিস্টান পরম্পরা মিশে যায়। এর ফলেই দিও দে লোস মুয়ের্তোস হয় এক অনন্য সংমিশ্রণ – যা আজ বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত।
প্রধান উপাদান ও রীতিনীতি
অফরেনদা (Ofrenda):
মৃতদের জন্য পরিবারের সদস্যরা ঘরে একটি ছোট্ট বেদী তৈরি করে। সেখানে রাখা হয় মৃতের ছবি, প্রিয় খাবার, পানীয়, মোমবাতি, ধূপ, কাগজের ফুল, এবং নানা স্মারক। এটি আত্মাদের পৃথিবীতে আমন্ত্রণ জানানোর একটি উপায়।
ক্যালাকাস ও ক্যালাভেরা (Calacas and Calaveras):
ক্যালাকাস: কঙ্কাল আকৃতির রঙিন পুতুল, যা বিভিন্ন হাস্যরসাত্মক ভঙ্গিতে সাজানো হয়।
ক্যালাভেরা: চিনি দিয়ে তৈরি “শুগার স্কাল”। অনেকে এগুলোর ওপর প্রিয়জনদের নাম লেখে।
মারিগোল্ড ফুল (Cempasúchil):
এই উজ্জ্বল কমলা বা হলুদ ফুলটিকে বলা হয় “মৃতদের ফুল”। বিশ্বাস করা হয়, এর গন্ধ ও রঙ আত্মাদের পথ দেখায়।
পান দে মুয়ের্তো (Pan de Muerto):
“মৃতদের রুটি” নামে পরিচিত এক বিশেষ ধরনের মিষ্টি রুটি, যা কবরাকৃতি নকশায় তৈরি হয় এবং উৎসবে পরিবেশন করা হয়।
রঙিন কাগজ (Papel Picado):
কাটা রঙিন কাগজ যা বাতাস, আগুন, জল ও পৃথিবীর প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এগুলো পরিবেশকে উৎসবমুখর করে তোলে।
সামাজিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব
দিও দে লোস মুয়ের্তোস শুধু একটি ধর্মীয় বা ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান নয়, এটি পরিবারিক বন্ধনের পুনর্গঠন, জাতিগত পরিচয় সংরক্ষণ, এবং প্রজন্মান্তরে স্মৃতির উত্তরাধিকার তুলে ধরার একটি মাধ্যম। বাচ্চারা তাদের পূর্বপুরুষদের গল্প শুনে বড় হয়, পরিবারে সম্মিলিত স্মরণচর্চা গড়ে ওঠে।
বিশ্বজুড়ে উৎসব
আফ্রিকা
প্রাচীন মিশরে ওয়াগ উৎসব আগস্টের প্রথম দিকে অনুষ্ঠিত হত ( কপটিক ভাষায় এটি থাউট নামে পরিচিত)। এই ছুটির সময় লোকেরা ওসিরিসের মৃত্যু স্মরণ করার জন্য এবং আরুর পরলোকে যাত্রার সময় তাদের মৃত প্রিয়জনদের সম্মান জানাতে নদীতে ছোট নৌকা ছেড়ে দিত ।
ইউরোপ
ইউরোপে, ঐতিহাসিকরা মনে করেন যে মৃতদের তিন দিনের উৎসব হল বন্যার স্মরণে একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান যেখানে হ্যালোইনের প্রথম রাতটি বন্যার আগে পৃথিবীর দুষ্টতাকে চিত্রিত করে। দ্বিতীয় রাতটি বন্যা থেকে বেঁচে যাওয়া উদ্ধারপ্রাপ্তদের উদযাপন করে এবং শেষ রাতটি পৃথিবীকে পুনরায় জনবহুল করে তোলার জন্য সম্মান জানানো হয়। আইরিশ পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে, সামহেইন (বেলটেনের মতো) এমন একটি সময় ছিল যখন পরলোকের ‘দ্বার’ খুলে গিয়েছিল।
যার ফলে অতিপ্রাকৃত প্রাণী এবং মৃতদের আত্মারা আমাদের পৃথিবীতে আসতে পারত; যদিও বেলটেন জীবিতদের জন্য একটি গ্রীষ্মকালীন উৎসব ছিল, সামহেইন মূলত মৃতদের জন্য একটি উৎসব ছিল। মৃতদেরও সামহেইনে সম্মান জানানো হত। শীতের শুরুকে এটি করার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত সময় হিসেবে দেখা যেতে পারে, কারণ এটি প্রকৃতিতে ‘মৃত্যুর’ সময় ছিল। মৃতদের আত্মারা আতিথেয়তার জন্য তাদের বাড়িতে ফিরে যেতেন বলে মনে করা হত। রাতের খাবারের টেবিলে এবং আগুনের কাছে তাদের স্বাগত জানানোর জন্য জায়গা নির্ধারণ করা হয়েছিল।
উত্তর আমেরিকা
মেক্সিকো দেশটি ৩১শে অক্টোবর থেকে ২রা নভেম্বর পর্যন্ত দিয়া দে মুয়ের্তোস উদযাপন করে । মেক্সিকোতে, লোকেরা তাদের মৃত পরিবারের সদস্যদের সুন্দর সাজসজ্জা এবং উৎসবের মাধ্যমে উদযাপন করে, বিশ্বাস করে যে তারা মৃতদের মধ্য থেকে ফিরে আসে এবং পরকালে ফিরে যাওয়ার আগে তাদের পরিবারের সাথে একটি রাত উপভোগ করে। এই ছুটির দিনটি খ্রিস্টীয় অলহ্যালোটাইড এবং আদিবাসীদের রেখে যাওয়া অভ্যাস উভয়ের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল।
দক্ষিণ আমেরিকা
দক্ষিণ আমেরিকা জুড়ে এল দিয়া দে লস মুয়ের্তসের অনেক নাম রয়েছে: এল দিয়া দে লস ডিফুন্টোস (মৃতের দিন); এল দিয়া দে লস সান্তোস (সন্তদের দিন); Todos Santos (সমস্ত সাধু); এল দিয়া দে লাস অ্যানিমাস (আত্মার দিন); এবং এল দিয়া দে লাস অ্যানিমাস বেন্ডিটাস (আশীর্বাদপ্রাপ্ত আত্মার দিন)। প্রাক-কলাম্বিয়ান এবং ক্যাথলিক উদযাপনের সংমিশ্রণ, এল দিয়া দে লস মুয়ের্তোস কবরস্থান পরিদর্শন, মোমবাতি প্রজ্বলন, এবং মৃত পরিবারের সদস্যদের অর্ঘ প্রদান করে।
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি
২০০৮ সালে UNESCO এই উৎসবকে “Intangible Cultural Heritage of Humanity” হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এখন এটি শুধু মেক্সিকোতেই সীমাবদ্ধ নয় — যুক্তরাষ্ট্র, গুয়াতেমালা, পেরু, এমনকি ইউরোপেও উদযাপন করা হয়।
সমসাময়িক জনপ্রিয়তা
Pixar-এর এনিমেটেড চলচ্চিত্র “Coco” (২০১৭) এই উৎসবের আবেগ ও রীতিনীতিকে বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রদর্শনী, কনসার্ট, ওয়ার্কশপ আয়োজন করা হয়।
অনেক শহরে “Day of the Dead Parade” অনুষ্ঠিত হয় – ক্যালাকাস সেজে মানুষ রাস্তায় বের হয়, বাদ্য-বাজনা চলে, এবং মৃতদের স্মরণ করা হয়।
ধর্মীয় ও দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি
এই উৎসবটি জীবনের অস্থায়িত্ব ও মৃত্যুর অনিবার্যতাকে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করার একটি উপায়। এটি শেখায়:
আমরা যাদের হারিয়েছি, তারা আমাদের মাঝে স্মৃতিতে জীবিত।
মৃত্যু ভয় নয়, বরং স্মরণ ও সম্মানের বিষয়।
শোক নয়, ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার মধ্য দিয়ে জীবন উদযাপনই শ্রেষ্ঠ সম্মান।
দিও দে লোস মুয়ের্তোস এমন এক উৎসব যা হাস্য, কান্না, স্মৃতি ও সংস্কৃতিকে একত্র করে। এটি শুধু একটি ধর্মীয় দিন নয় – বরং আত্মীয়তার, আত্মিক সংযোগের এবং সাংস্কৃতিক পরিচয়ের বহিঃপ্রকাশ। মেক্সিকোর এই চিরন্তন ঐতিহ্য বিশ্ববাসীকে মনে করিয়ে দেয়, যে “যারা চলে গেছেন, তারা হারিয়ে যান না – যদি আমরা তাদের স্মরণ করি।”
তথ্যসূত্র:
UNESCO – Intangible Cultural Heritage
National Geographic – Día de los Muertos
Smithsonian Magazine – The Meaning Behind Día de los Muertos
Mexican Government – Secretaría de Cultura