দামেস্ক গেট: প্রাচীন জেরুজালেমের জীবন্ত সাক্ষী
দামেস্ক গেট (Damascus Gate) জেরুজালেমের পুরনো শহরের অন্যতম প্রধান ও প্রাচীন প্রবেশদ্বার। এটি পুরনো শহরের উত্তর দিকের প্রাচীরে অবস্থিত। গেটটি তার বিশালাকার কাঠামো, ঐতিহাসিক গুরুত্ব এবং স্থাপত্যশৈলীর জন্য বিশ্বব্যাপী সুপরিচিত। বর্তমানে এটি পুরনো শহরের সবচেয়ে জনবহুল ও ব্যস্ততম প্রবেশদ্বার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। দামেস্ক গেটকে আরবি ভাষায় বলা হয় باب العامود (বাব আল-আমুদ) যার অর্থ “স্তম্ভের দরজা” এবং হিব্রুতে বলা হয় שער שכם (শা’আর শখেম) যার মানে “শেখেম গেট”। এই নামগুলো গেটটির প্রাচীনকালের ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও ভৌগোলিক অবস্থানকে নির্দেশ করে।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
দামেস্ক গেটের ইতিহাস হাজার বছরের পুরনো। এর উৎপত্তি রোমান আমল পর্যন্ত পৌঁছে যায়। জেরুজালেম শহরের উত্তর প্রাচীর বরাবর এই গেটটি ছিল শহরের প্রধান প্রবেশপথগুলোর একটি।
রোমান যুগ (২য় শতক খ্রিস্টাব্দ):
দামেস্ক গেটের প্রথম কাঠামো নির্মিত হয় রোমান সম্রাট হ্যাড্রিয়ানের সময় (১৩৫ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি), যখন জেরুজালেমকে Aelia Capitolina নামে পুনর্গঠন করা হয়। তখন গেটটি শহরের কেন্দ্রীয় প্রবেশদ্বার হিসেবে ব্যবহৃত হত। একটি বড় বিজয় তোরণ এবং রাস্তার মাঝখানে একটি রোমান স্তম্ভ ছিল, যেখান থেকে আরবি নাম “বাব আল-আমুদ” এসেছে।
বাইজেন্টাইন ও মুসলিম শাসন:
বাইজেন্টাইন সময়ে গেটটির কাঠামো পরিবর্তিত হলেও এর মৌলিক রূপ অক্ষুণ্ণ ছিল। সপ্তম শতকে মুসলিম বাহিনী জেরুজালেম দখল করলে গেটটি আবারও ব্যবহৃত হয়।
ক্রুসেডার যুগ:
১২শ শতকে ক্রুসেডাররা জেরুজালেম দখল করলে দামেস্ক গেট তাদের দুর্গ ও প্রতিরক্ষা কাঠামোর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশে পরিণত হয়। তখন এর উপরে টাওয়ার ও প্রাচীর যোগ করা হয়।
অটোমান যুগ (১৬শ শতক):
আজকের যে গেটটি দেখা যায়, সেটি মূলত অটোমান সুলতান সুলেমান দ্য ম্যাগনিফিসেন্ট ১৫৩৭ সালে নির্মাণ করান। তিনি জেরুজালেমের পুরনো শহরের প্রাচীর পুনর্নির্মাণের সময় দামেস্ক গেটের বর্তমান কাঠামো তৈরি করান। এর বিশাল পাথরের দেয়াল, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও অলঙ্কৃত প্রবেশপথ সেই সময়ের স্থাপত্যশৈলীর নিদর্শন।
স্থাপত্যশৈলী ও নকশা
দামেস্ক গেটের নকশা এক কথায় অসাধারণ। এর প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো হলো:
প্রবেশপথ: গেটটির প্রধান প্রবেশপথ খিলানাকৃতির। দরজার বাইরে একটি প্রশস্ত প্রাঙ্গণ রয়েছে।
প্রতিরক্ষা বৈশিষ্ট্য: গেটের উপর রয়েছে শক্তিশালী দুর্গপ্রাচীর ও পর্যবেক্ষণ টাওয়ার, যা প্রাচীনকালে সামরিক প্রতিরক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
অটোমান শৈলী: গেটের অলংকরণ ও পাথরের কাজ অটোমান স্থাপত্যশৈলীর উদাহরণ।
ভেতরের রাস্তা: গেটের ভেতর দিয়ে পুরনো শহরের অন্যতম প্রধান বাজার রাস্তা El-Wad Street চলে গেছে, যা শহরের কেন্দ্রে গিয়ে মিশেছে।
দামেস্ক গেটের নামের উৎপত্তি
গেটটির ইংরেজি নাম “Damascus Gate” এসেছে এর অবস্থান ও পথের কারণে। প্রাচীনকালে এই গেট দিয়ে যে প্রধান সড়কটি বের হত, তা উত্তর দিকে দামেস্ক পর্যন্ত যেত। তাই ইউরোপীয়রা এটিকে “Damascus Gate” বলে ডাকতে শুরু করে। আরবি নাম “বাব আল-আমুদ” এসেছে গেটের কাছে থাকা একটি রোমান স্তম্ভ থেকে। হিব্রু নাম “শেখেম গেট” এসেছে পুরনো বাইবেলীয় শহর শেখেম (বর্তমান নাবলুস)-এর দিকে এই রাস্তা যাওয়ার কারণে।
দামেস্ক গেটই একমাত্র জেরুজালেম গেট যার আরবি নাম, বাব আল-আমুদ (‘স্তম্ভের দরজা’)। এই নামটি কমপক্ষে দশম শতাব্দী থেকে প্রচলিত আছে। ক্রুসেডাররা এটিকে সেন্ট স্টিফেনের গেট (ল্যাটিন ভাষায়, পোর্টা স্যাঙ্কটি স্টেফানি ) নামে অভিহিত করেছিল, যা সেন্ট স্টিফেনের মৃত্যুবরণের স্থানের কাছাকাছি বলে উল্লেখ করা হয়, যা সম্রাজ্ঞী ইউডোসিয়ার সময় থেকে শহরের দেয়ালের বাইরে অবস্থিত একটি গির্জা এবং মঠ দ্বারা চিহ্নিত ছিল। লেঘর্নের একজন ইহুদি ভ্রমণকারীর জেরুজালেম ভ্রমণের ১৫২৩ সালের একটি বিবরণে বাব এল ‘আমুদ নামটি ব্যবহার করা হয়েছে এবং সিদেকিয়ার গুহার কাছাকাছি থাকার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব
দামেস্ক গেট কেবল একটি স্থাপত্য নিদর্শন নয়, বরং এটি ইহুদি, খ্রিস্টান ও মুসলিম—তিন ধর্মের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ইহুদিদের জন্য: গেটটি পুরনো শহরের ইহুদি পাড়ার কাছাকাছি হওয়ায় এটি একটি ঐতিহাসিক প্রবেশপথ।
খ্রিস্টানদের জন্য: দামেস্ক গেটের কাছেই বেশ কিছু খ্রিস্টান ধর্মীয় স্থান রয়েছে।
মুসলিমদের জন্য: গেটের ভেতরের মুসলিম কোয়ার্টার এবং আল-আকসা মসজিদের দিকে যাওয়ার পথে এটি অন্যতম প্রধান দরজা।
সংস্কৃতি ও সাহিত্য
দামেস্ক গেট ফিলিস্তিনি সাহিত্য ও সংস্কৃতির বেশিরভাগ ক্ষেত্রে একটি সাংস্কৃতিক প্রতীক। অনেক ফিলিস্তিনিদের কাছে এর লোককাহিনী এবং আবেগগত মূল্য রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে স্কোয়ারে বালাদি পণ্য এবং কফি শপ বিক্রি করা মহিলাদের চিত্র। দামেস্ক গেট হল রবার্ট স্টোনের ১৯৯৮ সালের উপন্যাসের শিরোনাম, যা সহস্রাব্দের শুরুতে জেরুজালেমে পটভূমিতে রচিত।
বর্তমান অবস্থা ও ব্যবহার
আজকের দিনে দামেস্ক গেট জেরুজালেমের পুরনো শহরের অন্যতম ব্যস্ত প্রবেশদ্বার। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। গেটের ভেতরে প্রবেশ করলেই দেখা যায় সরগরম বাজার, যেখানে ফলমূল, মসলা, হস্তশিল্প, পোশাক এবং স্মারক সামগ্রী বিক্রি হয়।
এটি স্থানীয়দের পাশাপাশি পর্যটকদের কাছেও একটি প্রধান আকর্ষণ।
তবে রাজনৈতিক উত্তেজনার সময় দামেস্ক গেট প্রায়ই সংঘর্ষের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়, কারণ এটি পুরনো শহরের মুসলিম কোয়ার্টারের কাছে অবস্থিত। ইসরায়েলি পুলিশ এখানে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা বজায় রাখে।
দামেস্ক গেটের কাছে গুরুত্বপূর্ণ স্থানসমূহ
মুসলিম কোয়ার্টার: গেটের ভেতরে প্রবেশ করলে এই এলাকা শুরু হয়।
Via Dolorosa: খ্রিস্টানদের কাছে পবিত্র একটি পথ, যেখান দিয়ে যিশু ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার আগে হেঁটেছিলেন।
সুক বাজার (Souk): ভেতরের রঙিন ও ঐতিহ্যবাহী বাজার এলাকা।
পর্যটন ও অভিজ্ঞতা
দামেস্ক গেট ভ্রমণকারীদের জন্য এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা। গেটের আশেপাশে ঘোরাফেরা করে আপনি ইতিহাসের স্তরগুলো অনুভব করতে পারবেন। বিশেষত ভেতরের সরু গলিপথ ও বাজার আপনাকে মধ্যযুগীয় শহরের আবহ এনে দেবে।
গেটের উপরে ওঠার সুযোগ থাকলে সেখান থেকে জেরুজালেমের প্যানোরামিক দৃশ্য দেখা যায়।
চ্যালেঞ্জ ও সংরক্ষণ
দামেস্ক গেট একটি বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা হলেও এর রক্ষণাবেক্ষণ একটি বড় চ্যালেঞ্জ। রাজনৈতিক অস্থিরতা, জনসংখ্যার চাপ এবং আধুনিকীকরণের কারণে এর প্রাচীন কাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকিতে আছে। UNESCO এবং বিভিন্ন সংস্থা এটির সংরক্ষণের জন্য কাজ করছে।
দামেস্ক গেট শুধু একটি স্থাপত্যের নিদর্শন নয়, বরং এটি এক জীবন্ত ইতিহাস, যা যুগের পর যুগ ধরে জেরুজালেমের কাহিনি বয়ে নিয়ে চলেছে। রোমান যুগের বিজয় তোরণ থেকে শুরু করে বাইজেন্টাইন, মুসলিম, ক্রুসেডার এবং অটোমান যুগের পরিবর্তন—প্রতিটি স্তর দামেস্ক গেটকে আরও সমৃদ্ধ করেছে।
এই প্রবেশদ্বার শুধু শহরের গেট নয়, এটি মানুষের যাতায়াতের কেন্দ্র, বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র এবং সংস্কৃতির এক মিলনমেলা। গেটের প্রতিটি পাথর অতীতের গল্প বলে—বিজয় ও পরাজয়ের, সংঘাত ও শান্তির, ধর্মীয় বিশ্বাস ও মানুষের সহাবস্থানের গল্প।
আজকের দিনে দামেস্ক গেট জেরুজালেমের প্রাণকেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত, যেখানে প্রাচীন ঐতিহ্য এবং আধুনিক জীবনের সমন্বয় ঘটে। তবে রাজনৈতিক অস্থিরতা, সংঘাত ও অতিরিক্ত ভিড় এর প্রাচীন সৌন্দর্যকে হুমকির মুখে ফেলেছে। তাই এটির সংরক্ষণ কেবল একটি স্থাপনা রক্ষার কাজ নয়, বরং মানবজাতির ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সংরক্ষণের একটি দায়িত্ব।
যদি কেউ জেরুজালেমকে বুঝতে চায়, তবে তাকে অবশ্যই দামেস্ক গেটের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হবে, কারণ এই গেটের ভেতরে লুকিয়ে আছে শহরের আত্মা। এখানে এসে বোঝা যায়, ইতিহাস শুধু বইয়ের পাতায় নয়—এটি জীবন্ত, শ্বাসপ্রশ্বাস নিচ্ছে, ঠিক এই গেটের পাথরের গায়ে।
তথ্যসূত্র
UNESCO World Heritage Centre – Old City of Jerusalem and its Walls
Israel Ministry of Foreign Affairs – Gates of Jerusalem
Encyclopaedia Britannica – Damascus Gate
Jewish Virtual Library – Damascus Gate (Sha’ar Shechem)
Palestinian Heritage Foundation – History of Jerusalem Gates