সাম্যবাদী সমাজের ধারণা
সাম্যবাদী সমাজ কি
সাম্যবাদ বা কমিউনিজম হল শ্রেণিহীন, শোষণহীন, ব্যক্তিমুনাফাহীন এমন একটি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভাবাদর্শ যেখানে ব্যক্তিগত মালিকানার স্থলে উৎপাদনের সকল মাধ্যম এবং প্রাকৃতিক সম্পদ (ভূমি, খনি, কারখানা) রাষ্ট্রের মালিকানাধীন এবং নিয়ন্ত্রণাধীন থাকে। এই দর্শনের মূল ভিত্তি হলো যে সমাজে কেউ ধনী বা গরিব থাকবে না,সকলেই সমানভাবে কাজ করবে এবং তার সুফল পাবে। সাম্যবাদী সমাজ গঠনের এই চিন্তাটি মূলত কার্ল মার্কস ও ফ্রিডরিখ এঙ্গেলসের লেখা থেকে উঠে আসে, বিশেষত তাদের বিখ্যাত রচনা “The Communist Manifesto”(১৮৪৮)-তে।
সাম্যবাদী সমাজের বৈশিষ্ট্য
শ্রেণীহীন সমাজ: সাম্যবাদী সমাজে ধনী ও গরিবের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকবে না। অর্থাৎ,সমাজে ধনিক শ্রেণী (বুর্জোয়া)ও শ্রমিক শ্রেণী (প্রলেতারিয়েত)থাকবে না।
উৎপাদনের উপায়ের উপর সামাজিক মালিকানা: শিল্প-কারখানা,জমি,খনি,ব্যাংকসহ সব উৎপাদন উপকরণ ব্যক্তিমালিকানাধীন থাকবে না,বরং রাষ্ট্র বা জনগণের যৌথ মালিকানায় থাকবে।
শ্রম অনুযায়ী অবদান,চাহিদা অনুযায়ী বণ্টন: প্রত্যেকে তার সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ করবে এবং তার প্রয়োজন অনুযায়ী সমাজ থেকে গ্রহণ করবে।
ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিলোপ: কোনো ব্যক্তি জমি,কলকারখানা বা ব্যবসার মালিক হতে পারবে না,যাতে কারও পুঁজির ভিত্তিতে অন্যের শ্রম শোষণ না হয়।
সামাজিক ন্যায়বিচার ও শিক্ষা-চিকিৎসা সবার জন্য নিশ্চিত: শিক্ষা,স্বাস্থ্যসেবা,বাসস্থান ও খাদ্য রাষ্ট্রের দ্বারা সবার জন্য সমানভাবে নিশ্চিত করা হয়।
সাম্যবাদের ইতিহাস ও বিকাশ
সাম্যবাদের ধারণা অনেক পুরোনো হলেও,আধুনিক সাম্যবাদের ভিত্তি রচনা করেন কার্ল মার্কস এবং ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস। তাদের মতে,পুঁজিবাদ একটি শোষণমূলক ব্যবস্থা যেখানে ধনিক শ্রেণী শ্রমিকদের শ্রমকে ব্যবহার করে মুনাফা অর্জন করে। এই শোষণ বন্ধ করে একটি শ্রেণীহীন সমাজ গঠনের মাধ্যমেই প্রকৃত মুক্তি সম্ভব।
রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব (১৯১৭):
বিশ্বে প্রথমবারের মতো সাম্যবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয় রাশিয়ায়। বলশেভিক দলের নেতৃত্বে ভ্লাদিমির লেনিন ১৯১৭ সালে রাশিয়ায় জারতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে সমাজতান্ত্রিক সরকার গঠন করেন। এরপর তা পরিণত হয় সোভিয়েত ইউনিয়ন (USSR)-এ। এই রাষ্ট্রই প্রথম সাম্যবাদী সমাজ গঠনের দিকে বাস্তব পদক্ষেপ নেয়।
চীন:
মাও সে তুং-এর নেতৃত্বে ১৯৪৯ সালে চীনে কমিউনিস্ট বিপ্লব ঘটে এবং সাম্যবাদী রাষ্ট্র গঠিত হয়। চীনেও জমি সংস্কার,ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিলোপ এবং সমবায়ভিত্তিক উৎপাদনব্যবস্থা চালু হয়।
অন্যান্য দেশ:
সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের আদর্শ অনুসরণ করে কিউবা (ফিদেল কাস্ত্রো),উত্তর কোরিয়া (কিম ইল সুং),ভিয়েতনামসহ আরও কয়েকটি দেশে সাম্যবাদী শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়।
সাম্যবাদী সমাজ সেবা
শোষণহীন সমাজ: শ্রমিক শ্রেণীর ওপর পুঁজিপতিদের শোষণ বন্ধ হয়।
সমানাধিকার: ধনী-গরিবের বিভাজন না থাকায় সবাই সমান সুযোগ ও মর্যাদা পায়।
নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা: কাজ,শিক্ষা,চিকিৎসা,বাসস্থানের নিশ্চয়তা থাকার কারণে মানুষের মাঝে নিরাপত্তাবোধ জন্মায়।
সামাজিক সংহতি: ব্যক্তির চেয়ে সমাজকে গুরুত্ব দেওয়া হয়,ফলে সামাজিক ঐক্য ও সহযোগিতা বাড়ে।
সাম্যবাদী সমাজের চ্যালেঞ্জ ও সমালোচনা
উৎপাদনে অনুৎসাহ: ব্যক্তিগত প্রণোদনা না থাকায় অনেক ক্ষেত্রে শ্রমিকরা উদ্যম হারায়,যার ফলে উৎপাদন কমে যেতে পারে।
ব্যবস্থাপনার জটিলতা: পুরো সমাজকে এককভাবে পরিচালনা করা এবং সমান বণ্টনের ন্যায্যতা নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
মানবিক স্বাধীনতার সীমাবদ্ধতা: কিছু সাম্যবাদী রাষ্ট্রে মত প্রকাশের স্বাধীনতা,ধর্মীয় স্বাধীনতা বা রাজনৈতিক মতভেদ গ্রহণযোগ্য নয়—যা মানবাধিকার লঙ্ঘন করে।
প্রযুক্তিগত ও শিল্পোন্নয়নে পশ্চাদপদতা: পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় প্রতিযোগিতার মাধ্যমে যে উদ্ভাবন হয়,সাম্যবাদে তার ঘাটতি দেখা যায়।
সাম্যবাদ ও সমাজতন্ত্রের মধ্যে তফাৎ
সমাজতন্ত্রে শ্রেণী বিলোপের সূত্রপাত ও বৈরী শ্রেণীদের বিলোপ আর সাম্যবাদে সমস্ত শ্রেণীর উচ্ছেদ ও লোকসমাজতন্ত্রে কিছুটা কাল যাবত বুর্জোয়া চেতনাগত অধিকারই শুধু নয়,রাষ্ট্রও টিকে থাকে। সমাজতন্ত্র আবশ্যিকতার রাজ্য,আর সাম্যবাদে বুর্জোয়া চেতনাগত অধিকার ও রাষ্ট্র কিছুই থাকবে না। সমাজতন্ত্রে পোলেটেরিয়েত একনায়কত্ব থাকে আর সাম্যবাদে কোনো শ্রেণীরই অস্তিত্ব থাকে না। সাম্যবাদ শ্রেণীহীন সমাজ।
সমাজতন্ত্রে বেতন ও মজুরির অনুপাত সমান থাকে এবং পরে কাগজি ভাউচার থাকে। আর সাম্যবাদে বেতন বা মজুরির অস্তিত্বই থাকে না।
সমাজতন্ত্রে স্থায়ী সেনাবাহিনীর বদলে গণমিলিশিয়া থাকে আর সাম্যবাদে কোন বাহিনীরই অস্তিত্ব থাকবে না।
সমাজতন্ত্রে কায়িক ও মানসিক,শিল্প ও কৃষি,দক্ষ ও অদক্ষ শ্রমের ভাগ থাকে আর সাম্যবাদে কোনো ভাগ থাকে না।
সমাজতন্ত্রে মালিকানার দুই রূপঃ সর্বজনীন ও সমবায় মূলক আর সাম্যবাদে একরূপঃ সমাজের।
সমাজতন্ত্রে শ্রম জীবনধারণের উপায় আর সাম্যবাদে জীবনেরই প্রাথমিক প্রয়োজন শ্রম।
আধুনিক যুগে সাম্যবাদের প্রাসঙ্গিকতা
আজকের বিশ্বে অনেক দেশ পুঁজিবাদী অর্থনীতির পথ অনুসরণ করলেও সাম্যবাদী আদর্শের কিছু অংশ এখনও গুরুত্বপূর্ণ। যেমন:
রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা বিনামূল্যে দেওয়া
ধনী ও গরিবের মধ্যে বৈষম্য কমানোর জন্য করনীতি
সামাজিক সুরক্ষা ও রেশনিং ব্যবস্থা
চীন এখন পুঁজিবাদ ও সাম্যবাদের মিশ্র একটি মডেল অনুসরণ করছে—রাষ্ট্রীয় মালিকানার পাশাপাশি ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও বাজার অর্থনীতি চালু রয়েছে।
সাম্যবাদী একটি আদর্শ সমাজ ব্যবস্থার স্বপ্ন দেখায় যেখানে শোষণ,বৈষম্য ও দারিদ্র্য থাকবে না। বাস্তব ক্ষেত্রে এই আদর্শ পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা কঠিন হলেও এর অনেক দিক মানবিক ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনে সহায়ক। বর্তমান বিশ্বে সম্পূর্ণ সাম্যবাদী রাষ্ট্রের সংখ্যা কমে এলেও,এই আদর্শ এখনো নানা সামাজিক ও রাজনৈতিক আলোচনার কেন্দ্রে রয়ে গেছে। সাম্যবাদের মূল শিক্ষা হলো—সকল মানুষের সমান অধিকার,মর্যাদা ও সুযোগ নিশ্চিত করা,যা একটি ন্যায়সঙ্গত ও মানবিক সমাজ গঠনের জন্য অপরিহার্য।
তথ্যসূত্র:
Marx, Karl & Engels, Friedrich. The Communist Manifesto
Lenin, Vladimir. State and Revolution
Britannica, “Communism”, 2024 Edition
History.com, “Communist States and Movements”