চীনা সংস্কৃতি
চীনা সংস্কৃতি পৃথিবীর প্রাচীনতম ও ধারাবাহিকভাবে বিকশিত সংস্কৃতিগুলোর একটি। প্রায় পাঁচ হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে এই সংস্কৃতি তার নিজস্ব ধাঁচে বিকশিত হয়েছে এবং এশিয়া তথা বিশ্বের ইতিহাস, রাজনীতি, দর্শন, সাহিত্য, শিল্প, ধর্ম ও দৈনন্দিন জীবনে গভীর প্রভাব ফেলেছে। চীনের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এতই বিস্তৃত ও বৈচিত্র্যময় যে একে এক কথায় বর্ণনা করা প্রায় অসম্ভব। প্রাচীনকাল থেকেই চীনা সংস্কৃতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে সমৃদ্ধি লাভ করেছে। এখানে কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরা হলো:
দর্শন ও চিন্তাধারা
চীনা সংস্কৃতির ভিত্তি মূলত গঠিত হয়েছে কনফুসিয়ানিজম (Confucianism), তাওবাদ (Taoism) ও বৌদ্ধধর্মের (Buddhism) উপর।
কনফুসিয়ানিজম (কং ফু-জি, ৫৫১-৪৭৯ খ্রিস্টপূর্ব): এটি নৈতিকতা, পারিবারিক দায়িত্ব, সম্মান ও সমাজে শৃঙ্খলার ওপর গুরুত্ব দেয়। শিক্ষার প্রতি শ্রদ্ধা ও বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রতি শ্রদ্ধা কনফুসিয়ান দর্শনের মূলনীতি।
তাওবাদ (লাও ত্সু): প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ জীবনযাপন, সহজ-সরলতা ও “Wu Wei” অর্থাৎ কর্ম না করেও প্রভাব বিস্তার করার ভাবনা এতে প্রাধান্য পায়।
বৌদ্ধধর্ম (ভারত থেকে আগত): ১ম খ্রিস্টাব্দে চীনে প্রবেশ করে এবং ধীরে ধীরে বিভিন্ন রাজবংশে গুরুত্ব পায়। এটি আত্মউন্নয়ন, পুনর্জন্ম ও মোক্ষ ধারণার উপর ভিত্তি করে।
ভাষা ও লিপি
চীনা ভাষা, বিশেষ করে ম্যানডারিন (Mandarin), পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি লোকের দ্বারা ব্যবহৃত ভাষা। চীনা লিপি (Han characters বা 汉字) একটি চিত্রলিপি যা শব্দ বা শব্দাংশকে প্রতিনিধিত্ব করে, এবং প্রায় ৩০০০–৫০০০ অক্ষর দৈনন্দিন ব্যবহারে প্রচলিত।
চীনা ক্যালিগ্রাফি (书法) একটি প্রাচীন ও সম্মানজনক শিল্পরূপ, যা শুধু লিখনশৈলী নয় বরং একধরনের আত্মপ্রকাশ ও ধ্যানমূলক অভিজ্ঞতা।
বিংশ শতাব্দীর শুরুতে, জনসংখ্যার বেশিরভাগই এখনও নিরক্ষর ছিল এবং বিভিন্ন অঞ্চলে কথ্য অনেক ভাষা ( মান্ডারিন , উ , ইউ ( ক্যান্টোনিজ ), মিন নান (বান-লাম-গু), জিন , জিয়াং , হাক্কা , গান , হুই , পিং ইত্যাদি) অন্যান্য অঞ্চলের মানুষের সাথে কথ্য যোগাযোগকে বাধাগ্রস্ত করেছিল।
তবে, লিখিত ভাষা যোগাযোগকে সম্ভব করে তুলেছিল, যেমন চীনের সমগ্র অঞ্চলে সরকারী আদেশ এবং নথিপত্র প্রেরণ করা। সংস্কারকরা একটি জাতীয় ভাষা প্রতিষ্ঠার জন্য যাত্রা শুরু করেছিলেন, বেইজিং-ভিত্তিক ম্যান্ডারিনকে কথ্য রূপ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন । ৪ ঠা মে আন্দোলনের পর, ধ্রুপদী চীনা দ্রুত লিখিত স্থানীয় চীনা দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়েছিল , যা আদর্শ কথ্য ভাষার শব্দভাণ্ডার এবং ব্যাকরণের অনুকরণে তৈরি হয়েছিল।
চীনা ধর্মীয় বিশ্বাস ও প্রথা
চীনা সংস্কৃতিতে ধর্মীয় অনুশীলন বহুমুখী। প্রচলিত ধর্মগুলোর পাশাপাশি পুর্বপুরুষপূজা (ancestor worship) এবং প্রকৃতি ও আত্মাদের প্রতি বিশ্বাস গুরুত্বপূর্ণ। অনেকেই ঐতিহ্যগতভাবে বিভিন্ন দেবতা ও আত্মার পূজা করে থাকে।
চীনে ফেং শুই (Feng Shui) ও ই চিং (I Ching)-এর মতো আধ্যাত্মিক অনুশীলনও ব্যাপক জনপ্রিয়।
উৎসব ও ঐতিহ্য
চীনের অন্যতম বৃহৎ সাংস্কৃতিক উপাদান হলো তাদের রঙিন ও অর্থবহ উৎসবসমূহ।
চাইনিজ নিউ ইয়ার (Spring Festival): চন্দ্রপঞ্জিকা অনুযায়ী নতুন বছরের সূচনা উদযাপন করে। এটি ১৫ দিন ধরে চলে এবং পরিবার-ভিত্তিক নানা অনুষ্ঠান হয়। লাল রঙ, আতশবাজি ও “লায়ন ড্যান্স” এর প্রধান বৈশিষ্ট্য।
ড্রাগন বোট ফেস্টিভাল: ঐতিহাসিক কবি কু ইয়ুয়ান স্মরণে পালিত হয়, এর সাথে ড্রাগন বোট রেস ও আঠালো চালের কেক (zongzi) খাওয়ার প্রথা যুক্ত।
মুন ফেস্টিভাল (Mid-Autumn Festival): চাঁদের পূর্ণতাকে কেন্দ্র করে উদযাপন করা হয়। পরিবার ও বন্ধুবান্ধব একত্রিত হয়ে মুনকেক খাওয়া হয়।
সাহিত্য ও ইতিহাস
চীনের সাহিত্য অতীব সমৃদ্ধ এবং বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন ধারা ও চিন্তাধারার প্রতিফলন ঘটেছে।
শি জিং (The Book of Songs): প্রাচীন চীনের কবিতার প্রথম সংকলন।
সান গু ও ইয়ান ই (Romance of the Three Kingdoms), শুই হু ঝুয়ান (Water Margin), জার্নি টু দ্য ওয়েস্ট, এবং ড্রিম অব দ্য রেড চেম্বার – এই চারটি উপন্যাস চীনা সাহিত্যের চূড়ান্ত নিদর্শন।
চীনা শিল্প ও কারুশিল্প
চীনা শিল্পকলার ক্ষেত্রেও দারুণ বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়:
চীনামাটির বাসন (porcelain) – চীনের নামের সাথেই যুক্ত এই শিল্প বিশ্ববিখ্যাত।
পেইন্টিং – প্রাকৃতিক দৃশ্য, পাখি, ফুল এবং ক্যালিগ্রাফির সমন্বয়ে শিল্পীরা প্রাচীনকাল থেকেই অনন্য সৃষ্টি করেছেন।
রেশম শিল্প – চীনা রেশম প্রাচীন রেশমপথ (Silk Road)-এর মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় হয়।
সঙ্গীত ও নৃত্য
চীনা সঙ্গীতে ঐতিহ্যবাহী বাদ্যযন্ত্র যেমন গুজহেং, আরহু, পিপা ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়।
চীনা অপেরা, বিশেষ করে বেইজিং অপেরা, সংগীত, কাহিনী, অভিনয় এবং পোশাকের অপূর্ব সমন্বয়ে গঠিত।
চীনা স্থাপত্য ও নির্মাণশৈলী
চীনের ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্যে ছাদের ঘূর্ণায়মান প্রান্ত, উঁচু ভিত্তি, এবং কাঠের নির্মাণ খুবই সাধারণ।
চীনের মহাপ্রাচীর (Great Wall): প্রাচীন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং চীনা স্থাপত্যের বিস্ময়কর নিদর্শন।
প্রাসাদ ও মন্দির: যেমন বেইজিং-এর ফরবিডেন সিটি এবং হেভেনের মন্দির।
চীনা খাবার ও রন্ধনপ্রণালী
চীনা খাবার বৈচিত্র্যময়, আঞ্চলিকভাবে ভিন্ন স্বাদের এবং অনন্য কৌশলে প্রস্তুত।
সিচুয়ান খাবারে ঝাল ও মৌলিক স্বাদ প্রাধান্য পায়।
ক্যান্টনিজ খাবার তুলনামূলকভাবে মৃদু ও হালকা স্বাদের।
চপস্টিকস ব্যবহারে দক্ষতা চীনা সংস্কৃতির অন্যতম অংশ।
সমকালীন সাংস্কৃতিক প্রভাব
আজকের চীন বিশ্ববাজারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও তারা তাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অনেক কিছুই বজায় রেখেছে। চীনা চলচ্চিত্র, মার্শাল আর্ট (কুংফু), ফ্যাশন, স্থাপত্য ও চা সংস্কৃতি বিশ্বজুড়ে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে।
চীনা সংস্কৃতি শুধুমাত্র চীনের জনগণের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং এটি মানব সভ্যতার অমূল্য ঐতিহ্য। প্রাচীন দর্শন, সাহিত্য, শিল্প ও ধর্মীয় বিশ্বাসের এক অনন্য সংমিশ্রণ এই সংস্কৃতি, যা আজও জীবন্ত ও প্রাসঙ্গিক। প্রযুক্তি ও আধুনিকতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চললেও, চীনা সমাজ তাদের অতীত ও সংস্কৃতি ধরে রাখার চমৎকার উদাহরণ।
তথ্যসূত্র:
Britannica.com
ChinaCulture.org
UNESCO Intangible Cultural Heritage
BBC Chinese Culture Reports