চার্লস ডারউইনের আবিষ্কার
চার্লস ডারউইন (Charles Robert Darwin) ছিলেন একজন ইংরেজ প্রকৃতিবিদ, ভূবিজ্ঞানী ও জীববিজ্ঞানী, যিনি জীবজগতের বিবর্তন সংক্রান্ত তত্ত্ব দিয়ে বিজ্ঞানে এক বিপ্লব আনেন। তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান হল “বিবর্তনের তত্ত্ব (Theory of Evolution by Natural Selection)” – যা তিনি ১৮৫৯ সালে প্রকাশিত বই “On the Origin of Species”–এ ব্যাখ্যা করেন। এই তত্ত্ব বিজ্ঞানের ইতিহাসে অন্যতম প্রভাবশালী তত্ত্ব হিসেবে গণ্য হয়।
ডারউইনের আবিষ্কারের পটভূমি
ডারউইনের আবিষ্কার আকস্মিক ছিল না; এটি ছিল বহু বছরের গবেষণা, পর্যবেক্ষণ, এবং চিন্তাভাবনার ফল। ১৮৩১ সালে, ডারউইন ব্রিটিশ রাজকীয় নৌবাহিনীর জাহাজ HMS Beagle-এ একজন প্রকৃতিবিদ হিসেবে সমুদ্রযাত্রা শুরু করেন। এই পাঁচ বছরের ভ্রমণে তিনি দক্ষিণ আমেরিকা, গ্যালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জ, আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন অংশে প্রাণী ও উদ্ভিদজগতের বৈচিত্র্য পর্যবেক্ষণ করেন।
বিশেষ করে গ্যালাপাগোস দ্বীপে বিভিন্ন প্রজাতির ফিঞ্চ পাখি দেখে তার মনে প্রশ্ন জাগে—কীভাবে এদের ঠোঁটের গঠন দ্বীপভেদে ভিন্ন হতে পারে? এখান থেকেই জন্ম নেয় তার “প্রাকৃতিক নির্বাচন (Natural Selection)” এর ধারণা।
বিবর্তনের তত্ত্বের মূল ভাবনা
ডারউইনের বিবর্তনের তত্ত্ব মূলত কয়েকটি ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে আছে:
বৈচিত্র্য (Variation): প্রতিটি প্রজাতির ভেতরে কিছু না কিছু বৈচিত্র্য থাকে। যেমন—একই প্রজাতির পাখির ঠোঁটের আকার ভিন্ন হতে পারে।
উত্তরণযোগ্যতা (Heritability): এই বৈশিষ্ট্যগুলো উত্তরাধিকারসূত্রে পরবর্তী প্রজন্মে পৌঁছায়।
সংগ্রাম (Struggle for existence): পরিবেশে খাদ্য ও নিরাপত্তার জন্য প্রতিযোগিতা থাকে, ফলে সব প্রাণী টিকে থাকতে পারে না।
প্রাকৃতিক নির্বাচন (Natural Selection): যেসব বৈশিষ্ট্য প্রাণীকে টিকে থাকতে সাহায্য করে, সেগুলো সময়ের সঙ্গে প্রজাতিতে বেশি প্রচলিত হয়ে পড়ে।
এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ধীরে ধীরে একটি প্রজাতি পরিবর্তিত হয়ে নতুন প্রজাতিতে রূপান্তরিত হতে পারে।
On the Origin of Species (1859)
ডারউইনের সবচেয়ে আলোচিত ও গুরুত্বপূর্ণ বই “On the Origin of Species by Means of Natural Selection” ১৮৫৯ সালে প্রকাশিত হয়। এই বইয়ে তিনি বলেন, সব জীব এক সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে এসেছে এবং সময়ের সাথে সাথে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে বিবর্তিত হয়েছে।
বইটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই আলোড়ন সৃষ্টি হয়। খ্রিস্টান ধর্মমতে, ঈশ্বর সব জীব একসাথে সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু ডারউইনের তত্ত্ব এই ধারণার বিরোধিতা করেছিল, ফলে তীব্র বিতর্কের সৃষ্টি হয়।
ডারউইনের অন্যান্য কাজ
The Descent of Man (1871): এই বইয়ে তিনি ব্যাখ্যা করেন যে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীরও এক সাধারণ পূর্বপুরুষ ছিল। এটি আরও বেশি বিতর্ক সৃষ্টি করে কারণ এতে মানুষের উৎপত্তি নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়।
The Expression of the Emotions in Man and Animals (1872): এখানে তিনি মানুষের ও প্রাণীদের আবেগ প্রকাশের উপায়গুলোর মিল তুলে ধরেন, যা বিবর্তনের ধারাবাহিকতা প্রমাণ করে।
আধুনিক বিজ্ঞানে ডারউইনের প্রভাব
আজকের জীববিজ্ঞান, জিনতত্ত্ব (Genetics), প্রাণিবিদ্যা ও প্রাণিবিকাশমূলক মনোবিজ্ঞানে ডারউইনের তত্ত্ব এক অপরিহার্য ভিত্তি। যদিও ডারউইনের সময়ে জিন বা DNA-এর অস্তিত্ব জানা ছিল না, পরবর্তী গবেষণায় দেখা গেছে তার তত্ত্ব জিনতত্ত্বের সঙ্গে দারুণভাবে খাপ খায়।
বর্তমানে আমরা “সংশ্লেষিত বিবর্তন তত্ত্ব” (Modern Evolutionary Synthesis) নামে ডারউইনের তত্ত্ব ও মেন্ডেলীয় জিনতত্ত্ব একত্র করে একটি বিস্তৃত তত্ত্ব ব্যবহার করি।
কেন ডারউইনের আবিষ্কার গুরুত্বপূর্ণ?
জীবনের উৎপত্তি ব্যাখ্যা: ডারউইনের তত্ত্ব জীবনের বৈচিত্র্য ও উদ্ভব ব্যাখ্যা করতে সাহায্য করেছে।
বিজ্ঞান বনাম বিশ্বাস: তার তত্ত্ব ধর্মীয় বিশ্বাস ও বৈজ্ঞানিক যুক্তির মধ্যকার বিতর্কে এক নতুন অধ্যায় খুলে দেয়।
আধুনিক চিকিৎসা: জীবাণুর বিবর্তন, ওষুধ প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া ইত্যাদি বুঝতে ডারউইনের তত্ত্ব অপরিহার্য।
প্রাকৃতিক সম্পদের সংরক্ষণ: বিভিন্ন প্রজাতির বিবর্তন বুঝে পরিবেশ সংরক্ষণের কৌশল তৈরি সম্ভব হয়।
ডারউইনের ব্যক্তিগত জীবন
চার্লস রবার্ট ডারউইন তাঁর পরিবারিক বাড়ি, দ্য মাউন্টে ১২ ফেব্রুয়ারি ১৮০৯-এ শ্রপশায়ারের শ্রিউসবারিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি ধনী সমাজের গন্যমান্য ডাক্তার এবং অর্থব্যবস্থাপক রবার্ট ডারউইন এবং সুজানা ডারউইন (Wedgwood বিবাহ-পূর্ব) এর ছয় সন্তানের মধ্যে পঞ্চম ছিল। তাঁর পিতামহ এরাসমাস ডারউইন এবং জোসিয়াহ ওয়েডগউড উভয়ই বিশিষ্ট বিলোপকারী ছিলেন।
ইরাসমাস ডারউইন তাঁর প্রকাশিত জুনোমিয়াতে (১৭৯৪) বিবর্তন ও সাধারণ বংশোদ্ভূতির সাধারণ ধারণাগুলির প্রশংসা করেছিলেন, পরে তাঁর প্রপৌত্রের দ্বারাই যা বিস্তার লাভ করে। ডারউইন ১৮২৫ সালের গ্রীষ্মকালীন একজন শিক্ষানবিশ ডাক্তার হিসাবে তাঁর পিতাকে শ্রপশায়ারের দরিদ্রদের চিকিৎসা সেবা দিতে সাহায্য করেছিলেন।
১৮২৫ সালের অক্টোবরে তার ভাই ইরাসমাসের সাথে এডিনবার্গ মেডিকেল স্কুলে (সেই সময়ে যুক্তরাজ্যের সেরা মেডিকেল স্কুল) যাওয়ার আগে পর্যন্ত তিনি চিকিৎসা সেবা অব্যাহত রাখেন। মেডিকেল স্কুলের বক্তৃতাগুলি ডারউইনের কাছে নিস্তেজ মনে হয় এবং শল্যচিকিৎসা বিরক্তিকর বলে মনে করেছিলেন, তাই তিনি তার পড়াশুনাকে অবহেলা করেছিলেন।
তিনি দক্ষিণ আমেরিকার রেইন ফরেস্টে চার্লস ওয়াটারটনের সাথে আসা একজন মুক্ত কালো দাস জন এডমনস্টনের কাছ থেকে দৈনিক প্রায় ঘন্টার হিসেবে ৪০ দিন ধরে ট্যাক্সিডারমি শিখেছিলেন। ডারউইন বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বছরে, প্লিনিয়ান সোসাইটিতে যোগ দিয়েছিলেন। চিকিৎসা সংক্রান্ত গবেষণা ও পড়াশোনায় ডারউইনের অবহেলায় তার পিতা বিরক্ত হন।
তিনি তাকে খ্রিস্টের কলেজ, কেমব্রিজে পাঠান ব্যাচেলর অব আর্টস ডিগ্রি লাভের জন্য যাতে করে তিনি একজন অ্যাঙ্গলিকান কান্ট্রি পারশন হতে পারেন। ডারউইন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মান-বিতরণী পরীক্ষায় অযোগ্য ছিল ফলে তিনি জানুয়ারী ১৮২৮ এ সাধারণ ডিগ্রী কোর্সে যোগদান করেন।
পড়াশোনার চেয়ে তিনি ঘোড়ায় চড়া ও শুটিংকেই প্রাধান্য দিয়েছিলেন। ডারউইনের তালিকাভুক্তির প্রথম কয়েক মাসের সময় তাঁর দ্বিতীয় চাচাত ভাই উইলিয়াম ডারউইন ফক্সও খ্রিস্টের চার্চে অধ্যয়নরত ছিলেন।
১৮৩১ সালের জুন পর্যন্ত ডারউইনকে কেমব্রিজে থাকতে হয়েছিল। ১৮৮২ সালে তার মৃত্যু হলে তাকে বিজ্ঞানীদের সর্বোচ্চ সম্মানের সাথে লন্ডনের ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে আইজ্যাক নিউটনের পাশে সমাধিস্থ করা হয়।
চার্লস ডারউইনের আবিষ্কার শুধু বিজ্ঞানের জগতে নয়, মানুষের চিন্তাধারায়ও এক মৌলিক পরিবর্তন এনেছে। তিনি প্রমাণ করেছিলেন যে প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই জীবজগত গঠিত হয়েছে, কোনো অলৌকিক হস্তক্ষেপের প্রয়োজন নেই। তার “প্রাকৃতিক নির্বাচন” ও “বিবর্তনের তত্ত্ব” আজও বিজ্ঞানের অন্যতম স্তম্ভ হিসেবে গৃহীত।
তথ্যসূত্র:
Darwin, Charles. On the Origin of Species. 1859.
Bowler, Peter J. Evolution: The History of an Idea. 2003.
National History Museum, UK