কার্থেজিয়ান সভ্যতা
কার্থেজিয়ান সভ্যতা ছিল প্রাচীন ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের অন্যতম শক্তিশালী ও প্রভাবশালী সভ্যতা। যা আজকের তিউনিসিয়ার রাজধানী তিউনিস শহরের কাছে কার্থেজ নগরকে কেন্দ্র করে বিকশিত হয়েছিল। এটি খ্রিস্টপূর্ব ৯ম শতকে ফিনিশীয় উপনিবেশ হিসেবে শুরু হলেও দ্রুত স্বাধীন, সমৃদ্ধ ও সামরিকভাবে শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত হয়। কার্থেজ, রোমের সাথে দীর্ঘ পুনিক যুদ্ধের জন্য পরিচিত, যা খ্রিস্টপূর্ব ৩য় ও ২য় শতকে সংঘটিত হয়েছিল।
প্রতিষ্ঠা ও উৎস
কার্থেজ প্রতিষ্ঠিত হয় খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ৮১৪ সালে টাইর নগর (বর্তমান লেবানন) থেকে আসা ফিনিশীয় উপনিবেশকারীদের দ্বারা। কিংবদন্তি অনুযায়ী, রাণী দিদো বা এলিসা টাইর থেকে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র এড়িয়ে এসে এখানে বসতি স্থাপন করেন। শুরুতে এটি ছিল একটি বাণিজ্যিক উপনিবেশ, কিন্তু ধীরে ধীরে এটি নিজস্ব প্রশাসন ও সামরিক শক্তি গড়ে তুলে স্বতন্ত্র নগররাষ্ট্রে পরিণত হয়।
ভূগোল ও অর্থনীতি
কার্থেজ উত্তর আফ্রিকার উপকূলে কৌশলগত অবস্থানে ছিল, যা ভূমধ্যসাগরের পূর্ব ও পশ্চিম অংশের মধ্যবর্তী বাণিজ্যপথ নিয়ন্ত্রণের জন্য আদর্শ ছিল। তারা দক্ষ নাবিক ও বণিক ছিল এবং আফ্রিকা, স্পেন, সিসিলি, সার্ডিনিয়া, কর্সিকা, এমনকি ব্রিটেন পর্যন্ত বাণিজ্য নেটওয়ার্ক বিস্তার করেছিল।
প্রধান পণ্য
ধাতু: রূপা, তামা, সীসা
কৃষিজ পণ্য: জলপাই তেল, শস্য, ফল
বিলাসপণ্য: বেগুনি রঙের কাপড়, হাতির দাঁত, কাঁচের সামগ্রী
সমাজ ও সংস্কৃতি
কার্থেজিয়ান সমাজ ছিল শ্রেণিভিত্তিক। শাসনক্ষমতা ধনী বণিক পরিবারের হাতে ছিল, যারা সেনেট ও পরিষদ পরিচালনা করত।
ধর্ম
কার্থেজের ধর্ম ছিল ফিনিশীয় দেবতাদের পূজাভিত্তিক, প্রধান দেবতা ছিলেন বাল হাম্মোন ও দেবী তানিত। প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণে পাওয়া গেছে যে তারা কিছু সময়ে দেবতাদের সন্তুষ্ট করতে শিশুবলি দিত—যা ঐতিহাসিকভাবে বিতর্কিত হলেও অনেক সূত্রে উল্লেখ আছে। কার্থেজিনিয়ানরা অসংখ্য দেব-দেবীর পূজা করত, প্রত্যেকেই প্রকৃতির একটি নির্দিষ্ট বিষয় বা দিক নিয়ন্ত্রণ করত।
তারা ফিনিশিয়ান ধর্ম পালন করত, যা লেভান্টের প্রাচীন সেমিটিক ধর্ম থেকে উদ্ভূত একটি বহুঈশ্বরবাদী বিশ্বাস ব্যবস্থা । যদিও বেশিরভাগ প্রধান দেব-দেবীর জন্মভূমি ফিনিশিয়ানদের কাছ থেকে আনা হয়েছিল, কার্থেজ ধীরে ধীরে অনন্য রীতিনীতি, দেবত্ব এবং উপাসনার ধরণ তৈরি করে যা এর পরিচয়ের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়।
পরকালে বিশ্বাস
সমাধি খননকালে খাদ্য ও পানীয়ের জন্য ব্যবহৃত পাত্র এবং প্রাচীরবেষ্টিত শহরের দিকে এগিয়ে আসা ব্যক্তির আত্মার চিত্রকর্ম পাওয়া গেছে। এই আবিষ্কারগুলি মৃত্যুর পরের জীবনে বিশ্বাসের দৃঢ় ইঙ্গিত দেয় ।
ভাষা ও লিপি
তাদের ভাষা ছিল পিউনিক (ফিনিশীয়ের উত্তরসূরি), এবং তারা ফিনিশীয় বর্ণমালা ব্যবহার করত।
মায়ুমাস উৎসব
কার্থেজে প্রাপ্ত পুনিক শিলালিপিগুলি একটি মায়ুমাস উৎসবের সাক্ষ্য দেয় , সম্ভবত জলের আনুষ্ঠানিক পোর্টেজ জড়িত; শব্দটি নিজেই সম্ভবত গ্রীক হাইড্রোফোরিয়া ( ὑδροφόρια ) এর উপর একটি সেমিটিক ক্যালক । প্রতিটি লেখা “মহিলার জন্য, বালের তানিত মুখের জন্য, এবং প্রভুর জন্য, আমানুসের বালের জন্য, যা অমুক অমুক প্রতিজ্ঞা করেছিলেন” এই শব্দ দিয়ে শেষ হয়।
সামরিক শক্তি
কার্থেজের সামরিক শক্তি মূলত নৌবাহিনীর উপর নির্ভরশীল ছিল। তাদের বিশাল ও সুসংগঠিত যুদ্ধজাহাজ বহর ছিল, যা বাণিজ্য পথ ও উপনিবেশ রক্ষায় অপরিহার্য ছিল। স্থলবাহিনীতে প্রায়শই ভাড়াটে সৈন্য ব্যবহার করা হতো, যাদের মধ্যে আফ্রিকা, স্পেন ও গল অঞ্চল থেকে আসা যোদ্ধারা অন্তর্ভুক্ত ছিল।
রোমের সাথে সংঘাত – পিউনিক যুদ্ধ
কার্থেজের ইতিহাসে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো রোমের সাথে তাদের দীর্ঘ ও বিধ্বংসী সংঘর্ষ, যা পিউনিক যুদ্ধ নামে পরিচিত।
প্রথম পিউনিক যুদ্ধ (খ্রিস্টপূর্ব ২৬৪–২৪১)
মূলত সিসিলি দ্বীপের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সংঘর্ষ
রোম বিজয়ী হয়, কার্থেজ সিসিলি হারায় ও ভারী ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য হয়
দ্বিতীয় পিউনিক যুদ্ধ (খ্রিস্টপূর্ব ২১৮–২০১)
বিখ্যাত সেনাপতি হ্যানিবাল আল্পস পেরিয়ে হাতি নিয়ে ইতালি আক্রমণ করেন
বহু রোমান যুদ্ধে পরাজিত হলেও শেষ পর্যন্ত রোম আফ্রিকায় পাল্টা আক্রমণ করে
যামা যুদ্ধ (খ্রিস্টপূর্ব ২০২)-এ হ্যানিবাল পরাজিত হন
তৃতীয় পিউনিক যুদ্ধ (খ্রিস্টপূর্ব ১৪৯–১৪৬)
রোম সরাসরি কার্থেজ অবরোধ করে
তিন বছরের অবরোধ শেষে রোম সম্পূর্ণ নগর ধ্বংস করে, জনসংখ্যাকে দাসে পরিণত করে
কার্থেজের ভূমি রোমান প্রদেশে পরিণত হয়
পতন ও উত্তরাধিকার
খ্রিস্টপূর্ব ১৪৬ সালে কার্থেজ ধ্বংস হওয়ার পর রোম ভূমধ্যসাগরের প্রধান শক্তিতে পরিণত হয়। তবে কার্থেজিয়ান সংস্কৃতি ও প্রযুক্তি, বিশেষত নৌনির্মাণ দক্ষতা ও কৃষি প্রযুক্তি, রোমানরা গ্রহণ ও উন্নত করে।
উত্তরাধিকার:
বাণিজ্যিক ও নৌযুদ্ধ কৌশল
উন্নত কৃষি ও সেচ ব্যবস্থা
ভূমধ্যসাগরীয় সাংস্কৃতিক বিনিময়
কার্থেজ ছিল প্রাচীন বিশ্বের অন্যতম উন্নত, বাণিজ্যিকভাবে সমৃদ্ধ ও সামরিকভাবে শক্তিশালী সভ্যতা। যদিও রোমের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফলে এর ধ্বংস ঘটে, তবু এর সামুদ্রিক দক্ষতা, বাণিজ্য নেটওয়ার্ক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব ইতিহাসে অমর হয়ে আছে।
তথ্যসূত্র:
Lancel, Serge. Carthage: A History. Blackwell Publishers, 1995.
Warmington, B.H. Carthage. Penguin Books, 1960.
Hoyos, Dexter. The Carthaginians. Routledge, 2010.
Polybius. The Histories (প্রাচীন গ্রিক ইতিহাসকারের লেখা)।