ক্যানোপিক জারস: প্রাচীন মিশরের রহস্যময় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া পাত্র
প্রাচীন মিশরের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া প্রথা বিশ্বের ইতিহাসে অন্যতম বিস্ময়কর ও জটিল ও জটিল। এর মধ্যে ক্যানোপিক জারস (Canopic Jars) বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। মৃতদেহের মমি করার সময় অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংরক্ষণের জন্য ব্যবহৃত এই পাত্রগুলো শুধু ব্যবহারিক নয়, ধর্মীয় ও প্রতীকী দিক থেকেও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। ক্যানোপিক জারস সম্পর্কে বিস্তারিত জানার আগে এর উৎপত্তি, ব্যবহার, ধর্মীয় বিশ্বাস ও প্রতীকী গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করা যাক।
ক্যানোপিক জারস কী?
ক্যানোপিক জারস হলো মিশরের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া প্রথায় ব্যবহৃত বিশেষ ধরনের পাত্র, যেখানে মৃত ব্যক্তির অভ্যন্তরীণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ—বিশেষত লিভার, ফুসফুস, পাকস্থলী ও অন্ত্র সংরক্ষণ করা হতো। মমি করার সময় দেহ থেকে অঙ্গগুলো বের করা হতো। এগুলোকে রক্ষার জন্য রজন, লবণ ও অন্যান্য পদার্থ দিয়ে শোধন করা হতো। পরে সেগুলো ক্যানোপিক জারে সংরক্ষণ করা হতো। প্রাচীন মিশরীয়দের বিশ্বাস ছিল যে, মৃত্যুর পর আত্মার পুনর্জন্মের জন্য শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অক্ষত থাকা জরুরি। তাই অঙ্গগুলোও যত্নসহকারে সংরক্ষিত হতো।
শব্দের উৎস
“ক্যানোপিক” শব্দটি এসেছে গ্রিক ভাষা থেকে। গ্রিকরা ক্যানোপাস (Canopus) নামের একটি শহরের নামের সঙ্গে এই জারগুলিকে যুক্ত করেছিল। মিশরের এই শহরটি আলেকজান্দ্রিয়ার কাছাকাছি অবস্থিত ছিল। এক পুরাণকাহিনীতে বলা হয়, ক্যানোপাস নামে এক নাবিকের স্মৃতিতে এক মানবমুখী পাত্র ছিল, যেটিকে গ্রিকরা এই পাত্রগুলির সাথে তুলনা করেছিল।
ক্যানোপিক জারের ইতিহাস ও বিবর্তন
ক্যানোপিক জারসের ব্যবহার শুরু হয় পুরাতন রাজত্ব (Old Kingdom) থেকে, তবে তখন এগুলো সাধারণ পাত্র ছিল। মধ্য রাজত্বে (Middle Kingdom) এদের গঠন ও আকারে পরিবর্তন আসে। নতুন রাজত্বে (New Kingdom) এগুলোতে দেবতাদের প্রতীক হিসেবে নকশা যুক্ত হয়।
২১তম রাজবংশ থেকে শুরু করে পরবর্তী সময়ে অঙ্গগুলো জারে না রেখে শরীরের ভেতরেই সংরক্ষণ শুরু হয়। তবুও ক্যানোপিক জারস ধর্মীয় কারণে কফিনের সঙ্গে রাখা হতো।
ক্যানোপিক জারের অংশ ও নকশা
ক্যানোপিক জারস সাধারণত পাথর, অ্যালাবাস্টার, মাটির পাত্র, কাঠ বা কখনো ধাতু দিয়ে তৈরি হতো। এর গঠন দুইটি প্রধান অংশে বিভক্ত:
দেহ বা বেস – যেখানে অঙ্গ সংরক্ষণ করা হতো।
ঢাকনা (Lid) – যেটিতে দেবতার মুখ খোদাই করা থাকত।
প্রথমে ঢাকনাগুলো গোলাকার ছিল, পরে এতে চারটি দেবতার প্রতীকী মাথার নকশা যুক্ত হয়।
হোরাসের চার পুত্র ও ক্যানোপিক জারস
নতুন রাজত্বে ক্যানোপিক জারসের ঢাকনায় হোরাসের চার পুত্রের প্রতীক দেখা যায়। তারা চারটি অঙ্গের রক্ষক হিসেবে বিবেচিত ছিল।
অঙ্গ দেবতা রূপ রক্ষাকারী দেবী
ধর্মীয় তাৎপর্য
ঊনবিংশ রাজবংশের পরবর্তীকালে হোরাসের চার পুত্রের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য ছাউনিযুক্ত পাত্রগুলি শৈলীগতভাবে খোদাই করা হয়েছিল। হোরাসের প্রতিটি পুত্র , একজন সহচর দেবীর সাথে, একটি নির্দিষ্ট অঙ্গ রক্ষার জন্য দায়ী ছিলেন এবং একটি মূল দিক নির্দেশ করেছিলেন:
হাপি: উত্তরের প্রতিনিধিত্বকারী বেবুন-মাথাওয়ালা দেবতা দেবী নেফথিস দ্বারা সুরক্ষিত ছিলেন এবং ফুসফুসে নিযুক্ত ছিলেন।
ডুয়ামুতেফ: পূর্বের প্রতিনিধিত্বকারী শৃগাল-মাথাওয়ালা দেবতা দেবী নিথ দ্বারা সুরক্ষিত ছিলেন এবং পেটে নিযুক্ত ছিলেন।
ইমসেটি: দক্ষিণের প্রতিনিধিত্বকারী মানব-মাথাওয়ালা দেবতা দেবী আইসিস দ্বারা সুরক্ষিত ছিলেন এবং যকৃতের উপর অর্পিত ছিলেন।
কেবেহসেনুয়েফ: পশ্চিমের প্রতিনিধিত্বকারী বাজপাখির মাথাওয়ালা দেবতা দেবী সার্কেট দ্বারা সুরক্ষিত ছিলেন এবং অন্ত্রের জন্য নিযুক্ত ছিলেন।
কিছু জারের ভেতরে অবশিষ্ট ডিএনএ পরীক্ষা করে বিজ্ঞানীরা প্রাচীন রোগ, খাদ্যাভ্যাস ও মমি করার প্রক্রিয়া সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছে
এই দেবতাদের প্রতীকী উপস্থিতি মৃত্যুর পর অঙ্গগুলোর সুরক্ষা নিশ্চিত করে বলে বিশ্বাস করা হতো।
ক্যানোপিক জারের আধ্যাত্মিক গুরুত্ব
প্রাচীন মিশরীয়দের বিশ্বাস অনুযায়ী, মৃত্যুর পর কা (শক্তি), বা (আত্মা) এবং আখ (আলোকিত আত্মা) পুনর্জন্মের জন্য শরীরের অঙ্গগুলোর অক্ষত থাকা জরুরি ছিল। ক্যানোপিক জারস শুধু সংরক্ষণের মাধ্যম নয়, বরং ধর্মীয় শক্তির প্রতীক ছিল। মন্ত্র ও প্রার্থনা খোদাই করে রাখা হতো যাতে দেবতারা অঙ্গগুলোকে সুরক্ষা দেন।
উপকরণ ও অলংকরণ
ক্যানোপিক জারস বিভিন্ন উপকরণ দিয়ে তৈরি হতো:
অ্যালাবাস্টার: অভিজাতদের জন্য।
ক্যালসাইট বা পাথর: দীর্ঘস্থায়ী সুরক্ষার জন্য।
মাটি বা সিরামিক: সাধারণ মানুষের জন্য।
এগুলোতে দেবতাদের ছবি, হায়ারোগ্লিফ, প্রার্থনা খোদাই করা থাকত।
সমাধিক্ষেত্রে ক্যানোপিক জারস
সমাধি বা টম্ব-এ ক্যানোপিক জারস সাধারণত কফিনের পাশে বা বিশেষ কন্টেইনারে রাখা হতো। কিছু টম্বে এগুলোকে ক্যানোপিক চেস্ট (Canopic Chest)-এ রাখা হতো।
গবেষণায় ক্যানোপিক জারসের গুরুত্ব
আজকের প্রত্নতত্ত্বে ক্যানোপিক জারস শুধু প্রাচীন মিশরীয় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া রীতির প্রমাণ নয়, বরং মৃতদেহ সংরক্ষণের প্রযুক্তি, সামাজিক মর্যাদা, ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতিফলন করে। কিছু জারের ভেতরে অবশিষ্ট ডিএনএ পরীক্ষা করে বিজ্ঞানীরা প্রাচীন রোগ, খাদ্যাভ্যাস ও মমি করার
ক্যানোপিক জারস প্রাচীন মিশরের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া প্রথার এক অপরিহার্য অংশ ছিল। এগুলো শুধু মৃতদেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংরক্ষণের জন্য পাত্র নয়, বরং মিশরীয়দের আধ্যাত্মিক বিশ্বাসের প্রতীক। মৃত্যুর পর পুনর্জন্মের ধারণা প্রাচীন মিশরীয় সংস্কৃতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তাদের মতে, শরীরের প্রতিটি অঙ্গই পুনর্জন্মের জন্য অপরিহার্য। তাই অঙ্গগুলোকে সুরক্ষিত রাখতে তারা ক্যানোপিক জারসের মতো পদ্ধতি ব্যবহার করেছিল।
হোরাসের চার পুত্র এবং সংশ্লিষ্ট দেবীদের প্রতীকী রূপ দিয়ে সাজানো জারগুলো শুধু ধর্মীয় গুরুত্বই বহন করত না, বরং প্রাচীন মিশরের শিল্পকলা ও প্রতীকী ভাষার উৎকৃষ্ট উদাহরণও ছিল। প্রতিটি জারে খোদাই করা হায়ারোগ্লিফিক লিপি এবং প্রার্থনা প্রমাণ করে যে, মিশরীয়রা মৃত্যুকে শুধু একটি শেষ নয়, বরং অন্য জগতে নতুন জীবনের সূচনা হিসেবে দেখত।
আজকের দিনে ক্যানোপিক জারস প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় অমূল্য সম্পদ। এগুলো থেকে প্রাচীন চিকিৎসা, মমি করার কৌশল, ধর্মীয় অনুশাসন, এবং সামাজিক স্তরের পার্থক্য সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানা যায়। বিশ্বের নামী জাদুঘরগুলোতে সংরক্ষিত এই জারগুলো এখনো দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করে এবং প্রাচীন মিশরের উন্নত সভ্যতার সাক্ষ্য বহন করে।
অতএব, ক্যানোপিক জারস কেবল পাত্র নয়, বরং হাজার বছর আগে মানুষের মৃত্যুর পর জীবন, দেবতা, এবং আত্মার অমরত্ব সম্পর্কে গভীর বিশ্বাসের এক প্রতীকী নিদর্শন। এগুলো অধ্যয়ন করে আমরা শুধু প্রাচীন মিশরের ইতিহাস নয়, বরং মানুষের আধ্যাত্মিকতা ও মৃত্যুচিন্তার ধারাও গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারি।
তথ্যসূত্র
David, R. (2008). Handbook to Life in Ancient Egypt. Oxford University Press.
Ikram, S. (1997). Death and Burial in Ancient Egypt. The American University in Cairo Press.
Dodson, A., & Ikram, S. (2003). The Mummy in Ancient Egypt. Thames & Hudson.