বাজরিগর পাখি: সৌন্দর্য ও বুদ্ধিমত্তার প্রতীক
বাজরিগর (Budgerigar) বা “বাডজি” নামে পরিচিত ছোট আকৃতির এই রঙিন পাখিটি পৃথিবীর অন্যতম জনপ্রিয় খাঁচার পোষা পাখি। বৈজ্ঞানিক নাম Melopsittacus undulatus। এটি অস্ট্রেলিয়ার মূলত প্রাকৃতিক পাখি হলেও বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মানুষের ভালোবাসায় জায়গা করে নিয়েছে। বুজেরিগার পাখি তার প্রাণবন্ত রঙ, বন্ধুবান্ধব স্বভাব, কথা বলার সামর্থ্য এবং সহজ প্রতিপালনযোগ্যতার কারণে পাখিপ্রেমীদের কাছে অত্যন্ত প্রিয়।
উৎপত্তি ও স্বাভাবিক পরিবেশ
বাজরিগর পাখির আদি নিবাস অস্ট্রেলিয়া। দেশটির শুষ্ক ও আধা-শুষ্ক অঞ্চল, তৃণভূমি এবং খোলা জঙ্গল এই পাখির জন্য উপযুক্ত বাসস্থান। সেখানে তারা দলবদ্ধভাবে ঘুরে বেড়ায়, প্রাকৃতিক খাদ্য যেমন ঘাসের বীজ, ফল ও পোকামাকড় খায় এবং প্রাকৃতিক গর্তে বা গাছের ফাটলে বাসা বাঁধে।
অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীরা বহু শতাব্দী ধরে এই পাখিকে চেনেন এবং তারা “budgerygar” শব্দটি ব্যবহার করতেন যার অর্থ “ভালো খাবার” বা “ভাল শিকার”।
বৈজ্ঞানিক শ্রেণিবিন্যাস
বৈজ্ঞানিক নাম: Melopsittacus undulatus
পরিবার: Psittaculidae (তোতা পরিবারের অন্তর্ভুক্ত)
উপপরিবার: Loriinae
গোত্র: Melopsittacus (এই গোত্রে একমাত্র সদস্য)
চেহারা ও বৈশিষ্ট্য
প্রাকৃতিকভাবে বাজরিগর পাখি সবুজ-হলুদ রঙের হয়। তবে খাঁচায় প্রতিপালনের মাধ্যমে নীল, সাদা, ধূসর, বেগুনি, এলবিনো বা লুটিনোসহ বহু রঙে পাওয়া যায়। এদের শরীরে কালো ঢেউয়ের মতো দাগ থাকে যা তাদের প্রাকৃতিক ছদ্মবেশ গঠনে সাহায্য করে।
দৈর্ঘ্য: গড়ে ১৮ সেন্টিমিটার। ৬.৫ – ৭ ইঞ্চি এবং খাঁচায় প্রায় ৭ – ৮ ইঞ্চি।
ওজন: এদের ওজন সাধারণত বন্য বাজরিগার ২৫ – ৩৫ গ্রাম এবং খাঁচায় ৩৫ – ৪০ গ্রাম পর্যন্ত হয়।
আয়ু: ৫-১০ বছর (সঠিক যত্নে আরও বেশি হতে পারে)
লিঙ্গ পার্থক্য:পূর্ণবয়স্ক পুরুষ বাজরিগারের নাকের ছিদ্রের চারপাশে নীল রংয়ের ঝিল্লি থাকে। এই ঝিল্লি কপাল ও ঠোঁটের মাঝে নাকের ছিদ্রসহ বিস্তৃত। পূর্ণবয়স্ক স্ত্রী বাজরিগারের নাকের ছিদ্রের চারপাশে বাদামি রংয়ের ঝিল্লি দিয়ে ঘেরা থাকে।
এই ঝিল্লি কপাল ও ঠোঁটের মাঝে নাকের ছিদ্রসহ বিস্তৃত। সাধারণত ৫ – ৮ মাস বয়সে এরা প্রাপ্তবয়স্ক হয়।
চরিত্র ও বুদ্ধিমত্তা
বাজরিগর পাখি খুবই সামাজিক ও কৌতূহলী। তারা মানুষকে দ্রুত চিনে নেয় এবং যদি নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, তবে কিছু শব্দ বা বাক্য অনুকরণ করতেও পারে। এদের শিখন ক্ষমতা ও মেধা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি।
যদি একা রাখা হয়, তাহলে নিয়মিত খেলা, কথা ও মনোযোগ দরকার হয়। অন্যথায় তারা বিষণ্ন হয়ে যেতে পারে। তাই অনেকেই জোড়ায় পাখি পালন করে থাকে।
খাদ্যাভ্যাস
এরা উন্মুক্ত তৃণভূমিতে স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াতে পারে তাই নিজেদের ইচ্ছা মতন খাদ্য সংগ্রহ করতে পারে। খাঁচায় পোষা অবস্থায় খাদ্য হিসেবে কাউন, ছোট ধান , ভাত, ফল ও অন্যান্য শাক-সবজি খায়। যা প্রতিটা বাড়িতে অনায়াসেই মেলে।
তারা ভিজানো নরম ছোলা, গম ও ভুট্টা খায়। তুলসী পাতা খেতে তারা খুব ভালোবাসে।
এছাড়া জোয়ার, বাজরা, রাগি অর্থাৎ মিলেট জাতীয় শস্য ক্যানারি, সূর্যমুখীর বীজ প্রভৃতি বিভিন্ন শস্য মিশ্রিত ভাবে খেতে দেওয়া হয়ে থাকে। কাটেল ফিশ বোন, মিনারেল ব্লক, গ্রিড ও এগফুড অর্থাৎ ডিম ও ডিমের খোলা খেতে দেয়া হয় তাদের সঠিক পুষ্টির জন্য।
যা বর্জনীয়: অ্যাভোকাডো, চকোলেট, কফি, অ্যালকোহল, লবণযুক্ত খাবার – এসব পাখির জন্য বিষাক্ত হতে পারে।
বাসস্থান ও পরিচর্যা
বাজরিগরের জন্য খাঁচা হতে হবে পর্যাপ্ত বড় এবং মুক্ত বাতাস চলাচলের উপযোগী। একাধিক বসার খুঁটি (perch), খেলনা, আয়না, দোলনা থাকা উচিত। তারা যেন ডানা ঝাঁপটানোর সুযোগ পায়—এই ব্যবস্থা রাখা জরুরি।
পরিচর্যা টিপস:
প্রতিদিন খাঁচা পরিষ্কার করা
পানি ও খাদ্য প্রতিদিন বদলানো
মাসে একবার পাখির স্বাস্থ্য পরীক্ষা
পাখিকে বাইরে উড়ানোর ব্যবস্থা থাকলে পরিবেশ নিরাপদ করতে হবে
প্রজনন
স্ত্রী ও পুরুষ পাখি শারীরিক মিলনের ৭ – ১০ দিন পর থেকে ডিম পারা শুরু করে। একদিন পর পর একটি করে ডিম পাড়ে। এরা এক সময়ে ৪ – ৮ টি ডিম পাড়ে। স্ত্রী পাখি তার ডিমে তা দেয় এবং পুরুষ তাদের যত্ন নেয়।
এই পাখিকে ডিম দেয়ার সময় নির্জন জায়গায় রাখতে হবে। ডিম থেকে বাচ্চা ফুটতে ১৮ – ২১ দিন সময় লাগে। নবজাতক ও ছোট বাচ্চা পাখিকে তাদের মা-বাবা এক সাথে খাইয়ে দেয়।
পাখির বাচ্চা গুলি প্রায় ৩৫ – ৪২ দিন বয়স থেকে একা একা খেতে শুরু করে ও অল্প অল্প উড়তে শিখে যায়। প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে পাখিরা মাথা ঝাঁকিয়ে শিস্ দিয়ে গান করে। কখনো কখনো মেয়ে পাখিদেরও এরকম করতে দেখা যায়।
কথা বলা ও প্রশিক্ষণ
বুজেরিগাররা কথা বলতে পারে—তবে এটি নির্ভর করে বয়স, পরিচর্যা, প্রশিক্ষণ ও পরিবেশের ওপর। পুরুষ বাডজিরা সাধারণত কথা বলতে বেশি পটু। ছোট শব্দ বা সহজ বাক্য (“হ্যালো”, “গুড বাডজি”) বারবার বললে তারা অনুকরণ করতে শেখে।
প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে প্রশিক্ষণ দিলে ধীরে ধীরে তারা মানুষের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তোলে ও নির্দিষ্ট শব্দে সাড়া দেয়।
স্বাস্থ্য সমস্যা
সঠিকভাবে যত্ন না নিলে বুজেরিগার পাখি রোগাক্রান্ত হতে পারে। কিছু সাধারণ সমস্যা:
শ্বাসকষ্ট (ঠান্ডা বা ফাঙ্গাল সংক্রমণ)
পালক ছেঁড়া (stress বা পুষ্টির অভাবে)
ডিম আটকে যাওয়া (female birds)
পরজীবী সংক্রমণ
স্বাস্থ্য ভালো রাখতে পরিষ্কার খাঁচা, সুষম খাদ্য ও নিয়মিত পর্যবেক্ষণ অত্যন্ত জরুরি।
সামাজিক গুরুত্ব ও জনপ্রিয়তা
বিশ্বজুড়ে খাঁচার পাখির মধ্যে বাজরিগর পাখি সবচেয়ে বেশি পোষা হয়। তাদের রঙিন সৌন্দর্য, বন্ধুত্বপূর্ণ স্বভাব ও কম খরচে প্রতিপালনযোগ্যতার জন্য এদের জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী।
বিশ্বের অনেক দেশে বাচ্চাদের জন্য পোষা প্রাণী হিসেবে এটি প্রথম পছন্দ। আবার অনেকে একাকীত্ব দূর করতে এই পাখি পোষেন।
এই গৃহপালিত পাখি বছরে কয়েকবার প্রজনন করে। সব জায়গায় পাওয়া যায়। দামে খুবই সস্তা। বিশেষ যত্ন প্রয়োজন হয় না। রোগবালাই কম হয়।
এরা দেখতে রঙিন হওয়ায় আকর্ষণীয় ও প্রকৃতিতে চঞ্চল। তাই সহজেই সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। শ্রবণ ক্ষমতা অনেক ভালো। এই পাখি ছোটো থেকে সঠিক ট্রেনিং পেলে শেখানো শব্দ অনেকটা স্পষ্ট ভাবে বলতে পারে। এরা টিয়া পাখির জাত হওয়ায় যথেষ্ট বুদ্ধিমান প্রকৃতির। বদ্রি পাখিকে অস্ট্রেলিয়ান পাখি বলা হয়।
বাজরিগর পাখি শুধুমাত্র একটি রঙিন ও সুন্দর পোষা পাখি নয়, বরং এটি মানুষের সাথে একটি বন্ধনের প্রতীক। একটু ভালোবাসা, যত্ন ও সময় দিলে তারা মানুষের সাথে কথোপকথন করে, খেলা করে এবং পরিবেশে প্রাণ আনয়ন করে। তাই পাখিপ্রেমীদের কাছে এটি নিঃসন্দেহে এক দুর্দান্ত সঙ্গী।
তথ্যসূত্র:
Australian Geographic – Budgerigars in the wild
The Spruce Pets – Budgerigar Bird Species Profile
Britannica – Budgerigar | Parakeet
BirdLife International – Melopsittacus undulatus