নীল বিদ্রোহ: কৃষকের রক্তাক্ত প্রতিবাদ
নীল বিদ্রোহ ছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে বাংলার কৃষকদের এক অসাধারণ প্রতিবাদ,যা ১৮৫৯ থেকে ১৮৬০ সালের মধ্যে সংঘটিত হয়। এটি ছিল ইংরেজ নীলকরদের বিরুদ্ধে কৃষকদের একটি বৃহৎ আন্দোলন। নীলচাষের জোরদার চাপ, শোষণ, নিপীড়ন ও দুর্ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কৃষকরা সম্মিলিতভাবে বিদ্রোহ করে। এই বিদ্রোহ শুধু বাংলার কৃষক বিদ্রোহই নয়, এটি ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে প্রথম গুরুত্বপূর্ণ কৃষক প্রতিরোধগুলোর মধ্যে একটি।
নীলচাষ: প্রেক্ষাপট
১৭ শতকে ভারতীয় উপমহাদেশে নীলচাষ শুরু হলেও ১৮ শতকে এটি প্রকট আকার ধারণ করে। ইউরোপের বাজারে তখন নীল রংয়ের চাহিদা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। ফলে ব্রিটিশ বণিকরা বাংলার কৃষকদের দিয়ে জোর করে নীলচাষ করাতে শুরু করে। মূলত Nadia, Jessore, Pabna, Rajshahi ও Dinajpur জেলার বিস্তীর্ণ এলাকায় এই চাষ বাধ্যতামূলক করা হয়।
নীলচাষের পদ্ধতি ছিল ভয়ঙ্কর:
কৃষকদেরকে ‘তিনকাঠি’ চুক্তি করতে বাধ্য করা হতো। এর মানে, তারা জমির একটি নির্দিষ্ট অংশে বাধ্যতামূলকভাবে নীল চাষ করবে।
ঋণ দিয়ে চাষ বাধ্যতামূলক করানো হতো, যাকে বলা হতো দাদন। পরে সেই ঋণ শোধ করতে গিয়ে কৃষকরা আরও ঋণের জালে আটকে যেত।
নীল গাছ ধ্বংস করতো জমির উর্বরতা। পরবর্তীতে আর ধান বা অন্যান্য ফসল হতো না।
কৃষকদের ন্যায্য দাম না দিয়ে নামমাত্র দামে ফসল কিনে নেওয়া হতো।
প্রতিবাদ করলে ব্রিটিশ নীলকররা অত্যাচার করত, শারীরিক নির্যাতন, জেল, এমনকি খুন করত।
বিদ্রোহের সূত্রপাত
নদীয়া জেলা কৃষ্ণনগরের কাছে চৌগাছা গ্রামে বিদ্রোহ শুরু হয় , যেখানে ১৮৫৯ সালের মার্চ মাসে দুই কৃষক নেতা, বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস এবং দিগম্বর বিশ্বাস প্রথম বাংলার নীলকরদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন। এটি দ্রুত মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, বর্ধমান, পাবনা, খুলনা এবং যশোরে ছড়িয়ে পড়ে । কালনায় , বর্ধমান শ্যামল মণ্ডল বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন । মণ্ডল ” মৃত্তিকা ” নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন এবং নীলকরদের উপর অত্যাচার এবং কৃষকদের দুর্দশার কথা লিখেন।
কৃষক নেতা গোপাল মণ্ডল, তার একশো পঞ্চাশজন কৃষকের দৃঢ় দল নিয়ে লাঠিয়ালদের আক্রমণ করেন এবং পিটিয়ে পিটিয়ে প্রতিহত করেন। কিছু নীলকরকে প্রকাশ্যে বিচারের মুখোমুখি করা হয় এবং মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। নীলকরদের ডিপো পুড়িয়ে দেওয়া হয়। ধরা এড়াতে অনেক নীলকর পালিয়ে যান। বিদ্রোহী কৃষকদের লক্ষ্যবস্তুতে ছিল জমিদাররাও।
এর প্রতিক্রিয়ায়, চাষীরা ভাড়াটে সৈন্য নিয়োগ করে এবং বিদ্রোহী কৃষকদের সাথে ক্রমাগত সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। ঐতিহাসিকরা উল্লেখ করেছেন যে ১৮৫৭ সালের ভারতীয় বিদ্রোহের বিপরীতে , বিদ্রোহের সদস্যরা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক কর্তৃপক্ষের প্রতি তাদের শত্রুতা নির্দেশ করেনি বরং ইউরোপীয় চাষী এবং বণিকদের দিকে তাদের মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করেছিল; ইতিহাসবিদ সুভাষ ভট্টাচার্য ‘ দ্য ইন্ডিগো রিভোল্ট অফ বেঙ্গল’ (১৯৭৭) বইতে উল্লেখ করেছেন যে “আন্দোলন শুরু হয়েছিল এবং শেষ হয়েছিল নীলকরদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম হিসাবে।”
বিদ্রোহটি অবশেষে নীলকরদের ভাড়াটে বাহিনীর দ্বারা দমন করা হয়েছিল, যদিও এর আগে এটি বাংলা এবং কাঠগড়া অঞ্চলের নীল উৎপাদনের বিশাল এলাকা সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়নি। নীলকররা তাদের নীল চুক্তি ভঙ্গ করার জন্য শত শত কৃষকের বিরুদ্ধে মামলা করে, এই মামলাগুলি রক্ষা করতে সতেরো হাজার টাকারও বেশি ব্যয় হয়।
ব্রিটিশ শাসনের প্রতিক্রিয়া
প্রথমদিকে ব্রিটিশ প্রশাসন বিদ্রোহ দমন করতে চায় এবং নীলকরদের পক্ষে দাঁড়ায়। কিন্তু আন্দোলন এতটাই ব্যাপক ও প্রবল ছিল যে এটি দমন করা কঠিন হয়ে পড়ে। কৃষকরা গণসংগঠনের মাধ্যমে প্রতিরোধ চালিয়ে যেতে থাকে।
পরিস্থিতি এতটাই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে যে ব্রিটিশ সরকার বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করতে বাধ্য হয়।
‘নীল কমিশন’ গঠিত হয়
১৮৬০ সালে ব্রিটিশ সরকার “নীল কমিশন” গঠন করে কৃষকদের অভিযোগ তদন্তের জন্য। এই কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়:
নীলচাষ কৃষকদের জন্য ক্ষতিকর।
কৃষকদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে চাষ করানো অনৈতিক।
জমির উর্বরতা নষ্ট হচ্ছে।
নীলকররা ব্যাপক দমন-পীড়ন চালাচ্ছে।
ফলে নীল চাষ বাধ্যতামূলক না করার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এর ফলে একরকম নীতিগত বিজয় অর্জন করে কৃষকরা। অনেক নীলকুঠি বন্ধ হয়ে যায়, এবং বাংলায় নীলচাষ ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যায়।
পত্রপত্রিকার ভূমিকা
এই বিদ্রোহের সংবাদ বাংলার প্রথিতযশা পত্রিকা ‘দীনবন্ধু’, ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’, ‘সাপ্তাহিক সংবাদ প্রভাকর’ ইত্যাদিতে প্রকাশিত হয়। পত্রিকাগুলো সাহসের সাথে নীলকরদের বর্বরতার বিরুদ্ধে লেখালেখি করে।
বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো দীনবন্ধু মিত্র রচিত নাটক ‘নীল দর্পণ’ (১৮৬০) — যা এ আন্দোলনের ভিত্তিতে লেখা হয়। এটি ইংরেজ ও দেশি পাঠকদের মাঝে ব্যাপক আলোড়ন তোলে। নাটকটি পরবর্তীতে বাংলা সাহিত্যের এক ঐতিহাসিক নিদর্শন হয়ে ওঠে।
নীল বিদ্রোহের গুরুত্ব ও প্রভাব
বাংলায় কৃষক আন্দোলনের পথিকৃত: এটি কৃষকদের প্রথম গণপ্রতিরোধ, যা পরবর্তীকালে আরও অনেক আন্দোলনের অনুপ্রেরণা দেয় — যেমন চম্পারন নীল আন্দোলন (১৯১৭), তেভাগা আন্দোলন ইত্যাদি।
ব্রিটিশ প্রশাসনের সচেতনতা বৃদ্ধি: তারা বুঝতে পারে, কৃষকদের শোষণ করলে তার ফল ভোগ করতে হবে।
সাংবাদিকতা ও নাটকের শক্তি: ‘নীল দর্পণ’ ও পত্রিকার প্রতিবেদন আন্দোলনে সাহস জোগায়।
হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের দৃষ্টান্ত: একসাথে কাজ করার ঐক্যবদ্ধ চিত্র উঠে আসে, যা পরবর্তীকালে রাজনৈতিক আন্দোলনের বীজ বপন করে।
নীল বিদ্রোহ ছিল বাংলার কৃষকশ্রেণির আত্মমর্যাদার যুদ্ধ। তারা প্রমাণ করে দেয়, শোষণ যতই শক্তিশালী হোক না কেন, ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ তাকে পরাজিত করতে পারে। ব্রিটিশ শাসনকালে এই বিদ্রোহ একটি সাহসী দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠে, যা পরবর্তীতে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের বুনিয়াদ তৈরিতে ভূমিকা রাখে।
তথ্যসূত্র:
রণজিৎ গুহ, Elementary Aspects of Peasant Insurgency
দীনবন্ধু মিত্র, নীল দর্পণ
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য আর্কাইভ
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগীয় পত্রিকা