নীল জ্বলন্ত নারকেল অক্টোপাস: সমুদ্রের বুকে এক বুদ্ধিমান রহস্য
সমুদ্রের অতল গভীরে এমন কিছু প্রাণী বাস করে, যাদের আচরণ, গঠন ও ক্ষমতা আমাদের কল্পনাকেও হার মানায়। এমনই এক বিস্ময়কর প্রাণী হলো নারকেল অক্টোপাস (Amphioctopus marginatus)—যাকে তার বিশেষ রঙ ও আচরণের কারণে অনেকেই “নীল জ্বলন্ত নারকেল অক্টোপাস” বলেও উল্লেখ করেন। এটি শুধু তার অদ্ভুত বসবাসের অভ্যাসের জন্যই নয়, বরং বুদ্ধিমত্তা, আত্মরক্ষার কৌশল এবং চোখধাঁধানো রঙ পরিবর্তনের ক্ষমতার জন্যও বিখ্যাত।
পরিচিতি
Amphioctopus marginatus হল Amphioctopus গণের Octopodidae পরিবারের একটি অক্টোপাস প্রজাতি । ১৯৬৪ সালে জাপানি ম্যালাকোলজিস্ট ইওয়াও টাকি এই প্রজাতিটিকে প্রথম Octopus marginatus এবং সমার্থক অর্থ Amphioctopus marginatus হিসাবে বর্ণনা করেছিলেন। চোখের চারপাশে ফ্যাকাশে সীমানার কারণে টাকি ল্যাটিন নাম marginatus বেছে নিয়েছিলেন। ১৯৭৬ সালে, জেড. ডং প্রজাতির নামকরণ করেন Octopus striolatus কিন্তু এই নামটি শ্রেণীবিন্যাসের দিক থেকে বৈধ হিসেবে স্বীকৃত হয়নি।
আকার এবং বর্ণনা
অক্টোপাসের প্রধান দেহ সাধারণত ৫ সেন্টিমিটার (২ ইঞ্চি) থেকে ১০ সেন্টিমিটার (৪ ইঞ্চি) লম্বা হয়; বাহু সহ, এটি দৈর্ঘ্যে প্রায় ৩০ সেন্টিমিটার (১২ ইঞ্চি) পর্যন্ত পরিমাপ করতে পারে। অক্টোপাসের ওজন ৪০০ গ্রাম (১৪ আউন্স) পর্যন্ত হতে পারে। অক্টোপাসটি শিরার মতো গাঢ় রেখাযুক্ত একটি সাধারণ রঙের প্যাটার্ন প্রদর্শন করে, সাধারণত একটি হলুদ সাইফন থাকে । বাহুগুলি সাধারণত গাঢ় রঙের হয়, বিপরীত সাদা চুষার সাথে । অনেক রঙের প্রদর্শনে, চোখের ঠিক নীচে একটি হালকা ট্র্যাপিজয়েডাল এলাকা দেখা যায়।
“নারকেল” নামের পেছনের কারণ
এই অক্টোপাসটি এমন একটি স্বভাবের জন্য পরিচিত যা প্রাণীজগতে একেবারেই বিরল—এটি ভাঙা নারকেলের খোলস সংগ্রহ করে নিজের জন্য আশ্রয় বানায়। কখনও কখনও তারা দুটি খোলস বা অর্ধেক শামুকের খোল একসাথে করে সেগুলোর ভেতর নিজেকে লুকিয়ে রাখে। ভয় পেলে তারা দ্রুত সেগুলোর মধ্যে ঢুকে পড়ে ও চারপাশে বালু ছিটিয়ে দেয়, যাতে তারা আশপাশের পরিবেশে মিশে যেতে পারে।
নীল জ্বলন্ত রঙ
“নীল জ্বলন্ত” উপাধিটি এসেছে এর রঙ পরিবর্তনের ক্ষমতা থেকে। নারকেল অক্টোপাস যখন আতঙ্কিত হয়, আত্মরক্ষা করতে চায় বা অন্য অক্টোপাসের সঙ্গে যোগাযোগ করে, তখন এর ত্বকের কিছু নির্দিষ্ট অংশে চকচকে নীল ও বেগুনি দীপ্তি দেখা যায়। এটি সম্ভব হয় বিশেষ কোষের কারণে, যাকে বলা হয় iridophores ও chromatophores। আলো পড়লে এই কোষগুলো রঙ পরিবর্তন করে এবং আশপাশের পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে ফেলে। এই ঝলমলে নীল রঙ দেখে মনে হয় যেন প্রাণীটি আগুনের মতো জ্বলছে।
বুদ্ধিমত্তা ও আচরণ
নারকেল অক্টোপাসকে বিবেচনা করা হয় সবচেয়ে বুদ্ধিমান অমেরুদণ্ডী প্রাণীগুলোর অন্যতম। তারা শুধুমাত্র সরঞ্জাম ব্যবহার করেই না, বরং পরিকল্পিতভাবে সেগুলো বহন করে চলে। গবেষণায় দেখা গেছে, তারা নারকেলের খোল টেনে নিয়ে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যায় এবং সেগুলো দিয়ে আত্মরক্ষার দুর্গ তৈরি করে। তারা নিজেদের বাহুর সাহায্যে হাঁটার মতো করে চলাফেরা করতে পারে, যা অক্টোপাসদের মধ্যে একটি বিরল বৈশিষ্ট্য।
আচরণ এবং খাদ্যাভ্যাস
তাদের খাদ্যতালিকায় রয়েছে কাঁকড়া, ছোট মাছ, চিংড়ি, শামুক ইত্যাদি। তারা সাধারণত গর্তে লুকিয়ে শিকার করে বা ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে, তারপর হঠাৎ করে আক্রমণ চালায়। এই প্রজাতিটি মূলত ক্যালাপ্পা কাঁকড়া এবং বাইভালভ শিকার করে।
সমুদ্রের রহস্যময় রত্ন
নারকেল অক্টোপাস শুধু তার চেহারা বা রঙের জন্য নয়, বরং তার কার্যকলাপ, পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর দক্ষতা, ও অত্যন্ত সূক্ষ্ম বুদ্ধিমত্তার কারণে প্রাণিবিজ্ঞানের জগতে এক অনন্য প্রাণী। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, প্রকৃতির গভীরে এখনো কত অজানা রহস্য রয়ে গেছে—যেগুলো শুধু জানার অপেক্ষায়।
তথ্যসূত্র:
National Geographic
MarineBio Conservation Society
Huffard, C.L. (2005). Cephalopod behavior and cognition