Friday, October 3, 2025
Homeজীবনীমোহাম্মদ রুহুল আমিন: বীরত্বের প্রতীক

মোহাম্মদ রুহুল আমিন: বীরত্বের প্রতীক

মোহাম্মদ রুহুল আমিন: বীরত্বের প্রতীক

মোহাম্মদ রুহুল আমিন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের এক অমর বীর, যিনি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে তাঁর জীবনের চূড়ান্ত ত্যাগ স্বীকার করেন। তিনি বাংলাদেশের জাতীয় ইতিহাসে সাহস ও বীরত্বের এক অমর প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত। রুহুল আমিন একজন ইঞ্জিন রুম আর্টিফিসার হিসেবে তার পেশাগত জীবন শুরু করেন।

তবে মুক্তিযুদ্ধের সময় তার দেশপ্রেম এবং মানবতার জন্য যে ত্যাগ তিনি স্বীকার করেছিলেন তা তাকে ইতিহাসের পাতায় চিরস্মরণীয় করে রেখেছে। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে চরম সাহসিকতা আর অসামান্য বীরত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ যে সাতজন বীরকে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সামরিক সম্মান “বীরশ্রেষ্ঠ” উপাধিতে ভূষিত করা হয় তিনি তাদের অন্যতম।

মোহাম্মদ রুহুল আমিন ১৯৩৫ সালে নোয়াখালী জেলার সোনাইমুড়ি উপজেলার বাঘপাঁচড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম আজহার পাটোয়ারী এবং মাতার নাম জোলেখা খাতুন। তিনি ছিলেন বাবা মায়ের প্রথম সন্তান। তারা ছিলেন ছয় ভাই বোন। তিনি বাঘপাচঁড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করে আমিশাপাড়া কৃষক উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন।

মোহাম্মদ রুহুল আমিন এসএসসি পাশ করে ১৯৫৩ সালে জুনিয়র মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে পাকিস্তান নৌবাহিনীতে যোগদান করেন। নৌবাহিনীতে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ নেয়ার জন্য তিনি করাচির নিকটবর্তী আরব সাগরে অবস্থিত মানোরা দ্বীপে পাকিস্তানি নৌঘাঁটি (পি.এন.এস) বাহাদুরে। প্রাথমিক প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর সেখান থেকে পি.এন.এস. কারসাজে যোগদান করেন।

১৯৫৮ সালে পেশাগত প্রশিক্ষণ শেষ করেন। ১৯৬৫ সালে মেকানিসিয়ান কোর্সের জন্য নির্বাচিত হন। পি.এন.এস. কারসাজে কোর্স সমাপ্ত করার পর আর্টিফিসার পদে নিযুক্ত হন। ১৯৬৮ সালে চট্টগ্রাম পি.এন.এস. বখতিয়ার নৌঘাঁটিতে বদলি হয়ে যান। ১৯৭১ সালের এপ্রিলে ঘাঁটি থেকে পালিয়ে যান। বাড়িতে গিয়ে ছাত্র, যুবক ও সামরিক আধাসামরিক বাহিনীর লোকদের মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেন। মেজর শফিউল্লাহর অধীনে ২ নম্বর সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন।পরবর্তীতে তিনি সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২ নম্বর সেক্টরের অধীনে থেকে বিভিন্ন স্থলযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।

বাংলাদেশ তখন পূর্ব পাকিস্তান নামে পরিচিত ছিল। তার পারিবারিক পরিবেশ প্রাথমিকভাবে সাধারণ, কিন্তু দেশপ্রেম ও মানবিক মূল্যবোধে ভরা। ছোটবেলা থেকেই তিনি নিয়মিত শিক্ষার প্রতি আগ্রহী ছিলেন এবং সমানতালে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে নিজের পেশাগত জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে সক্ষম হন। ইঞ্জিন রুম আর্টিফিসার হিসেবে প্রশিক্ষণ গ্রহণের মাধ্যমে তিনি সমুদ্র এবং জাহাজ পরিচালনার জটিল বিষয়গুলোতে দক্ষতা অর্জন করেন।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ সালে শুরু হলে রুহুল আমিন তাঁর কর্মস্থল এবং জীবনকে ত্যাগ করে দেশের মুক্তির জন্য লড়াইয়ে অংশ নেন। তিনি পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে মুক্তিকামী আন্দোলনে যোগ দেন এবং ত্যাগ ও সাহসিকতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। তার পদচারণা বিশেষভাবে সমুদ্র ও নৌযান সংক্রান্ত কাজের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধকে সহায়তা প্রদান করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

১৯ ডিসেম্বর ১৯৭১, যুদ্ধে তিনি যে দৃঢ়তার পরিচয় দেন, তা ইতিহাসে অমর হয়ে আছে। পাকিস্তানি সেনারা যাত্রা করেছিলেন তখনকার কিশোরগঞ্জ বা চট্টগ্রাম অঞ্চলে; রুহুল আমিন তাঁর জাহাজের ইঞ্জিন রুমে অবস্থান করছিলেন। যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি দেখিয়েছিলেন চরম সাহসিকতা এবং দায়িত্বের প্রতি অটলতা। পাকিস্তানি বাহিনী যখন মুক্তিকামী সেনাদের উপর আক্রমণ চালাচ্ছিল, রুহুল আমিন নিজের জীবন বাজি রেখে জাহাজ চালনা ও পরিচালনা চালিয়ে যান। যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি আহত হলেও দায়িত্ব ত্যাগ করেননি।

তার মৃত্যুর পর, মোহাম্মদ রুহুল আমিন বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে এক বীরের মতো অমর হয়ে থাকেন। স্বাধীনতার জন্য যে ত্যাগ তিনি স্বীকার করেছিলেন, তা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক অনন্য অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত। তিনি শুধু একজন সৈনিক ছিলেন না; তিনি ছিলেন দেশপ্রেম ও মানবিক দায়িত্বের এক জীবন্ত উদাহরণ। তাঁর জীবন থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা হলো—সাহস, নিষ্ঠা এবং আত্মত্যাগ মানবজাতির ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকে।

মোহাম্মদ রুহুল আমিনের ত্যাগকে স্মরণে রাখার জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে “শহীদ” ও “মুক্তিযুদ্ধ বীর” হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেছে। তাঁর নাম বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, স্মৃতিসৌধ, এবং পদক বা পুরস্কারের মাধ্যমে চিরস্মরণীয় করা হয়েছে। তরুণ প্রজন্মের জন্য তিনি অনুপ্রেরণার এক অমোঘ উৎস। তার জীবন প্রমাণ করে যে একজন ব্যক্তি যদি ন্যায়, দেশপ্রেম ও মানবতার জন্য নিবেদিত থাকে, তবে তার প্রভাব অনন্তকাল পর্যন্ত জীবন্ত থাকে।

রুহুল আমিনের জীবনী শুধু ইতিহাসের তথ্য নয়; এটি সাহস, দেশপ্রেম, দায়িত্ববোধ এবং মানবিক ত্যাগের গল্প। তিনি আমাদের শিখিয়েছেন যে বিপদময় পরিস্থিতিতেও ধৈর্য ধরে কাজ করলে এবং নিজের দায়িত্বের প্রতি অনুগত থাকলে মহান ফলাফল অর্জন সম্ভব। তার আত্মত্যাগ ও বীরত্বের গল্প বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অমর কাহিনীর অংশ এবং তা ভবিষ্যতের প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে।

মোহাম্মদ রুহুল আমিন আমাদের মনে করিয়ে দেন যে স্বাধীনতা সহজে অর্জিত হয় না; এটি অর্জিত হয় সাহসী ব্যক্তিদের ত্যাগ, আত্মত্যাগ ও অটল সংকল্পের মাধ্যমে। তাঁর জীবন আমাদের শেখায় যে, শুধু নিজস্ব স্বার্থ নয়, বরং জাতির কল্যাণের জন্য কাজ করাই প্রকৃত বীরত্বের পরিচয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে রুহুল আমিনের নাম চিরস্মরণীয় থাকবে, এবং তার সাহসিকতা ও ত্যাগের উদাহরণ সদা তরুণ প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে।

তথ্যসূত্র:

সরকারি মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্র (Bangladesh Liberation War Research Center)

বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর, ঢাকা – মুক্তিযুদ্ধকালীন সামরিক নথি ও শহীদদের পরিচয়পত্র।

আফসার আলম, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও বীর শহীদ, ঢাকা, ২০০৫।

বাংলাদেশ নৌবাহিনী প্রকাশনা – ইঞ্জিন রুম আর্টিফিসারদের ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধকালীন অবদান।

Previous article
Next article
Itihasar Golpo
Itihasar Golpohttps://itihasargolpo.com
Step into the past with our unforgettable historical journey. Discover the secrets of history on our captivating journey.
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments