Friday, October 3, 2025
Homeজীবনীবীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ মোস্তফা কামালের জীবনী

বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ মোস্তফা কামালের জীবনী

বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ মোস্তফা কামালের জীবনী

মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল (১৬ ডিসেম্বর ১৯৪৭ – ১৮ এপ্রিল ১৯৭১) বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী একজন শহিদ মুক্তিযোদ্ধা। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে চরম সাহসিকতা আর অসামান্য বীরত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ যে সাতজন বীরকে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সামরিক সম্মানবীরশ্রেষ্ঠ উপাধিতে ভূষিত করা হয় তিনি তাদের অন্যতম। তিনি মুক্তিযুদ্ধে অসীম সাহসিকতা, ত্যাগ ও দেশপ্রেমের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।

প্রারম্ভিক জীবন

মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল ১৯৪৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর কমিল্লা জেলার মুরাদনগর উপজেলার ভুইয়াপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা হাবিবুর রহমান সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত হাবিলদার ছিলেন এবং মাতা মালেকা বেগম। গ্রামীণ পরিবেশে বেড়ে ওঠা কামাল শৈশব থেকেই দুঃসাহসী ও পরিশ্রমী ছিলেন। প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার পর তিনি গ্রামের কৃষি ও পারিবারিক কাজে যুক্ত হন, তবে তাঁর মনে ছিল দেশ ও জাতির জন্য কিছু করার তীব্র ইচ্ছা।

শিক্ষাজীবন

মোস্তফা কামাল পড়াশোনা বেশিদূর করতে পারেননি। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পর উচ্চ বিদ্যালয়ে দু-এক বছর অধ্যয়ন করেন।

কর্মজীবন ও সেনাবাহিনীতে যোগদান

মোস্তফা কামালের ছেলেবেলা তার পিতার কর্মস্থল কুমিল্লা সেনানিবাসে কেটেছে। বিদ্যালয়ের প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখার চেয়ে সেনানিবাসে সেনাদের কুচকাওয়াজ, মার্চপাস্ট ইত্যাদি ভালো লাগত। ক্রমেই তিনি সেনাবাহিনীর একজন সদস্য হবার স্বপ্ন দেখতে থাকেন এবং স্থির করেন সেনাবাহিনীতে যোগ দিবেন। ২০ বছর বয়সে হঠাৎ করেই মোস্তফা কামাল বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশে হয়ে যান।

পরে ১৯৬৮ সালে পাকিস্তানের চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে চাকরি চূড়ান্ত হবার পরে সে তার পিতা-মাতার সন্ধান পান। তিনি ৪নং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে সিপাহী পদে কর্মরত ছিলেন। সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে তিনি সামরিক কৌশল ও অস্ত্র চালনায় দক্ষতা অর্জন করেন।

মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ ও ভূমিকা

১৯৭১ সালের মার্চ মাসে পাকিস্তানি সেনারা বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালানো শুরু করলে কামাল বিদ্রোহী মনোভাব পোষণ করেন। স্বাধীনতার ঘোষণার পর তিনি তাঁর রেজিমেন্টের সাথে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তাঁর ইউনিট ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও আশেপাশের এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ পরিচালনা করে।

কামাল ছিলেন অদম্য সাহসী এবং ঝুঁকি নিতে দ্বিধা করতেন না। ১৯৬৭-এর ১৬ ডিসেম্বর বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে সেনাবাহিনীতে চাকরিগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিক। ১৯৭১-এর প্রথম দিকে চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পাঠানো হয়। তখন সারাদেশে যুদ্ধের বিভৎসতা ছড়িয়ে পড়ছিল।

সেনানিবাসগুলোতে অবস্থা উত্তপ্ত হয়ে উঠে। স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার সাথে সাথে চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে ঘিরে তিনটি প্রতিরক্ষা ঘাঁটি গড়ে তোলে এন্ডারসন খালের পাড়ে। আখাউড়ায় অবস্থিত চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট দক্ষিণ দিক থেকে নিরাপত্তার জন্য দরুইন গ্রামের দুই নম্বর প্লাটুনকে নির্দেশ দেয়।

সিপাহি মোস্তফা কামাল ছিলেন দুই নম্বর প্লাটুনে। ভালো বক্সার হিসাবে রেজিমেন্টে তার সুনাম ছিলো। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর কয়েকদিন পূর্বে বক্সার হিসাবে সিপাহি মোহাম্মদ মোস্তফা অবৈতনিক ল্যান্স নায়েক হিসাবে পদোন্নতি পান।

১৯৭১ সালের এপ্রিলের প্রথম দিকে আখাউড়া সেক্টরে পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে এক তীব্র সংঘর্ষ হয়। ১৭ এপ্রিল, মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান ছিল দরুণ চাপের মধ্যে, কারণ পাকিস্তানি সেনারা সংখ্যায় ও অস্ত্রে অনেক শক্তিশালী ছিল। কামাল তখন তাঁর সঙ্গীদের নিরাপদে সরিয়ে নিতে সামনে এগিয়ে যান।

তিনি একাই শত্রুপক্ষের গুলির মুখে দাঁড়িয়ে লড়াই চালিয়ে যান, যাতে সহযোদ্ধারা পিছু হটতে পারেন। তাঁর অগ্নিসংযোগে পাকিস্তানি বাহিনীর অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি শত্রুর গুলিতে মারাত্মকভাবে আহত হন এবং যুদ্ধক্ষেত্রেই শহীদ হন।

বীরত্বের স্বীকৃতি

মোহাম্মদ মোস্তফা কামালের এই আত্মত্যাগ ছিল নিঃস্বার্থ ও অতুলনীয়। তিনি একা শত্রুর মোকাবিলা করে সহযোদ্ধাদের জীবন রক্ষা করেছিলেন। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সরকার তাঁর অসামান্য বীরত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে বীরশ্রেষ্ঠ উপাধিতে ভূষিত করে।

পুরস্কার ও সম্মাননা

মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সামরিক পদক বীরশ্রেষ্ঠ পদক দেওয়া হয় মোহাম্মদ মোস্তফা কামালকে। এছাড়া তার নামে প্রতিষ্ঠিত কলেজ প্রাঙ্গণের একটি কোণে ভোলা জেলা পরিষদের তত্ত্বাবধানে বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল লাইব্রেরি ও জাদুঘর নির্মাণ করা হয়।

এছাড়া মোস্তফা কামালের নামানুসারে গ্রামের নাম মৌটুপীর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়েছে কামালনগর৷ ঢাকার কমলাপুরে (বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী মোস্তফা কামাল স্টেডিয়াম) তার নামে একটি ফুটবল স্টেডিয়ামের নামকরণ করা হয়েছে। এছাড়াও ভোলায় তার নামে বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী মোস্তফা কামাল স্মৃতি জাদুঘর নির্মাণ করা হয়েছে।

স্মৃতিসৌধ

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ার দরুইন গ্রামে তার শাহাদাত স্থানের পাশেই এ গ্রামের জনগণ তাকে সমাহিত করেন। সেখানে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে বীরশ্রেষ্ঠ শহিদ সিপাহি মোহাম্মাদ মোস্তফা কামালের স্মরণে তার নামে একটি ভবন রয়েছে। এটি ৬ তলা বিশিষ্ট মূল ভবনের একটি উপভবন। ভবনটির ৫ম তলায় কীর্তনখোলা অডিটোরিয়াম অবস্থিত।

বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল ছিলেন স্বাধীনতার জন্য নিঃস্বার্থভাবে প্রাণ উৎসর্গ করা এক মহাপুরুষ। তাঁর জীবন আমাদের শেখায় যে, সত্যিকারের দেশপ্রেম মানে নিজের স্বার্থ ভুলে জাতির জন্য কাজ করা। তাঁর সাহস, ত্যাগ ও বীরত্ব বাংলাদেশের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

তথ্যসূত্র:

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর আর্কাইভস

বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয়

“বীরশ্রেষ্ঠদের গল্প” – ড. মাহফুজুর রহমান

Itihasar Golpo
Itihasar Golpohttps://itihasargolpo.com
Step into the past with our unforgettable historical journey. Discover the secrets of history on our captivating journey.
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments