বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের জীবনী
বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল নাম, যিনি তাঁর জীবন উৎসর্গ করেছিলেন দেশের জন্য। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে অসীম সাহসিকতা ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে তিনি হয়ে ওঠেন জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের একজন। তাঁর নাম বীরশ্রেষ্ঠ হিসেবে সাতজন মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে প্রথম সারিতে স্থান পেয়েছে।
জন্ম ও প্রাথমিক জীবন
তিনি ১৯৪১ সালের ২৯ অক্টোবর পুরান ঢাকার ১০৯, আগা সাদেক রোডের “মোবারক লজ”-এ জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মৌলভী আবদুস সামাদ এবং মাতার নাম সৈয়দা মোবারকুন্নেসা খাতুন। নয় ভাই ও দুই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন ৬ষ্ঠ।
১৯৪৭ সালের দেশবিভাগের পর তাঁর পরিবার পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) চলে আসে এবং ঢাকার রমনায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। মতিউর রহমান ছোটবেলা থেকেই অত্যন্ত মেধাবী এবং শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবনযাপন করতেন। তিনি ঢাকা আইয়ুব ক্যান্টনমেন্ট স্কুল থেকে এস এস সি পাশ করেন। এরপর তিনি করাচিতে পাকিস্তান এয়ার ফোর্সে ভর্তি হন।
পাইলট হিসেবে প্রশিক্ষণ ও কর্মজীবন
মতিউর রহমান ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। এরপর তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের সারগোদায় অবস্থিত পাকিস্তান বিমান বাহিনী স্কুলে ভর্তি হন। ১৯৬১ সালের ১৫ আগস্ট তিনি রিসালপুরে অবস্থিত পাকিস্তান বিমান বাহিনী একাডেমিতে (তৎকালীন পাকিস্তান বিমান বাহিনী কলেজ) যোগদান করেন।
১৯৬৩ সালের ২২ জুন মতিউর রহমান ৩৬তম জিডি(পি) কোর্স থেকে পাইলট অফিসার হিসেবে কমিশন লাভ করেন এবং পশ্চিম পাকিস্তানের করাচিতে অবস্থিত মৌরিপুর বিমান ঘাঁটির (বর্তমানে মাসরুর) ২ নম্বর স্কোয়াড্রনে নিযুক্ত হন। এরপর তিনি সেই ঘাঁটিতে টি-৩৩ জেট ট্রেনারদের উপর জেট কনভার্সন প্রশিক্ষণ সফলভাবে সম্পন্ন করেন।
তিনি ৭৫.৬৬% নম্বর পেয়ে কোর্সটি সফলভাবে পাস করেন এবং ফাইটার কনভার্সন প্রশিক্ষণের জন্য মনোনীত হন। ফাইটার কনভার্সন প্রশিক্ষণ F-86 Sabre Jets-এ অনুষ্ঠিত হয়, এই কোর্সটি তিনি ৮১% নম্বর পেয়ে পাস করেন। ফাইটার কনভার্সন কোর্সে ফলাফলের কারণে তাকে পেশোয়ারে (১৯ নম্বর স্কোয়াড্রনে) নিযুক্ত করা হয়।
তিনি ১৯৬৩ সালে তাহেরা নামক এক নারীকে বিয়ে করেন, যাঁর সাথে তাঁর দুই কন্যা সন্তান জন্ম নেয়।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ও মতিউরের অবস্থান
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে মতিউর রহমান পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে কর্মরত অবস্থায় ছিলেন। তিনি তখন করাচির মাসরুর বিমান ঘাঁটিতে কর্মরত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি অনুভব করেন, তাঁর জন্মভূমি বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য কিছু করা তাঁর নৈতিক দায়িত্ব।
তবে পাকিস্তান সরকার ও সেনাবাহিনী তখন পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালিদের ওপর নির্মম গণহত্যা চালাচ্ছিল, এবং মতিউর রহমান বুঝতে পারেন, তিনি যদি পাকিস্তান বাহিনীতে থেকে যান, তবে তিনি অন্যায়ের অংশীদার হবেন।
এমন অবস্থায় তিনি সিদ্ধান্ত নেন পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার। কিন্তু পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ তাঁর ওপর কড়া নজরদারি করছিল। তবুও, তিনি তাঁর পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য সুযোগ খুঁজতে থাকেন।
বীরত্বপূর্ণ ঘটনা ও শহীদ হওয়া
১৯৭১ সালের ২০ আগস্ট ছিল সেই দিন, যেদিন মতিউর রহমান তাঁর দেশপ্রেমের চূড়ান্ত প্রমাণ দেন। করাচির মাসরুর বিমান ঘাঁটিতে অবস্থানরত একজন প্রশিক্ষণার্থী পাইলট রশীদ মীনার একটি T-33 জেট প্রশিক্ষণ বিমান নিয়ে উড়ান দেওয়ার সময় মতিউর রহমান কৌশলে সেই বিমানে চড়ে বসেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল বিমানটি পূর্ব পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করা।
তবে করাচি ছেড়ে যাওয়ার কিছু সময় পরেই পাকিস্তান বিমান বাহিনী তাঁকে ধাওয়া করে। তিনি বিমানটি ভারতের আকাশসীমায় প্রবেশ করাতে সক্ষম হলেও সঠিকভাবে অবতরণ করতে পারেননি। ভারতের পাঞ্জাবের কাছে প্যাটানকোট এলাকায় বিমানটি বিধ্বস্ত হয়। রশীদ মীনা ঘটনাস্থলেই নিহত হন, আর মতিউর রহমানও গুরুতর আহত অবস্থায় শহীদ হন।
মরদেহের নিয়তি ও পরে উন্নয়ন
মতিউর রহমানের মরদেহ পাকিস্তান সেনাবাহিনী করাচির মাসরুর ঘাঁটির পাশে অবস্থিত এক অজ্ঞাতস্থানে কবর দেয়। ২০০৬ সালে বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধে ও ভারতের সহযোগিতায় তাঁর মরদেহ পাকিস্তান থেকে ঢাকায় এনে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় শিখা অনির্বাণে পুনঃসমাধিস্থ করা হয়।
বীরশ্রেষ্ঠ খেতাব ও সম্মান
বাংলাদেশ সরকার তাঁর এই অসাধারণ সাহসিকতার জন্য তাঁকে সর্বোচ্চ সামরিক পদক “বীরশ্রেষ্ঠ” উপাধিতে ভূষিত করে। দেশের প্রতিটি নাগরিকের মনে তাঁর জন্য গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা রয়েছে।
স্মরণ ও উত্তরাধিকার
আজও বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের নাম ইতিহাসে অমর হয়ে আছে। তাঁর নামে ঢাকায় একটি বিমান ঘাঁটির নামকরণ করা হয়েছে “বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান বিমান ঘাঁটি”। তাঁর স্মরণে বিভিন্ন বিদ্যালয়, সড়ক এবং স্থাপনা নির্মিত হয়েছে। বাংলাদেশ বিমান বাহিনী তাঁকে সর্বোচ্চ সম্মান দিয়ে স্মরণ করে।
তাঁর জীবন আমাদের শিক্ষা দেয়, কীভাবে একজন ব্যক্তি নিজের আরাম-আয়েশ ও নিরাপদ জীবনের কথা না ভেবে দেশের স্বাধীনতার জন্য নিজের প্রাণ বিসর্জন দিতে পারেন। মতিউর রহমান কেবল একজন সৈনিক ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন মুক্তিকামী আত্মা, যিনি নিজের জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গেছেন, দেশমাতৃকার টানে আত্মোৎসর্গই প্রকৃত বীরত্ব।
বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান বাংলাদেশের ইতিহাসের এক গর্বিত অধ্যায়। তাঁর জীবন ছিল সাহস, আদর্শ এবং দেশপ্রেমের প্রতীক। তাঁর আত্মত্যাগ বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে চির অমর হয়ে থাকবে। তাঁর মত সাহসী ও দেশপ্রেমিক সন্তানরা থাকলে কোনো জাতিকে পরাধীন করে রাখা যায় না।
তথ্যসূত্র:
বাংলাদেশ সরকারের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়
“মুক্তিযুদ্ধ ও বীরশ্রেষ্ঠ” – বাংলা একাডেমি প্রকাশনা
“বীরশ্রেষ্ঠদের জীবনী” – মাহবুবুল হক শাকিল (সম্পাদিত)
বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর ইতিহাস সংক্রান্ত নথিপত্র
দৈনিক প্রথম আলো, দৈনিক ইত্তেফাক, বিবিসি বাংলাা