শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের জীবনী
বাংলাদেশের আধুনিক চিত্রকলার জনক ও শিল্পাচার্যের মর্যাদায় শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন কেবল একজন শিল্পী ছিলেন না, তিনি ছিলেন বাংলার মানুষের দুঃখ-কষ্ট, সংগ্রাম এবং স্বপ্নের অন্যতম সার্থক চিত্রকার। তার আঁকা ছবিতে যেমন ফুটে উঠেছে গ্রামীণ জীবনের বাস্তব রূপ, তেমনি প্রতিফলিত হয়েছে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা ও মানবিক মূল্যবোধ। তার বিখ্যাত চিত্রকর্মের মধ্যে রয়েছে দুর্ভিক্ষ-চিত্রমালা, মই দেয়া, ম্যাডোনা ৪৩, সংগ্রাম, সাঁওতাল রমণী, ঝড়, কাক, বিদ্রোহী ইত্যাদি। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে গ্রামবাংলার উৎসব নিয়ে আঁকেন তার বিখ্যাত ৬৫ ফুট দীর্ঘ ছবি নবান্ন। বিশেষত, তার আঁকা দুর্ভিক্ষ সিরিজ (Famine Sketches) শুধু শিল্পকলার নয়, বরং ইতিহাসের দলিল হিসেবেও পরিচিত।
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন কে ছিলেন
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ছিলেন (২৯ ডিসেম্বর ১৯১৪ – ২৮ মে ১৯৭৬) বিংশ শতাব্দীর একজন বিখ্যাত বাঙালি চিত্রশিল্পী। পূর্ববঙ্গে তথা বাংলাদেশে চিত্রশিল্প বিষয়ক শিক্ষার প্রসারে আমৃত্যু প্রচেষ্টার জন্য তিনি শিল্পাচার্য উপাধি লাভ করেন।
শিল্পাচার্য শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন কোথায় জন্মগ্রহণ করেন
জয়নুল আবেদিন ১৯১৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর ময়মনসিংহ জেলার কিশোরগঞ্জ মহকুমার কেন্দুয়ায় (বর্তমানে নেত্রকোনা) জন্মগ্রহণ করেন পরবর্তীতে ব্রহ্মপুত্র তার অনেক চিত্রকর্মে উপস্থিত হয়েছিল এবং তার পুরো কর্মজীবন জুড়ে অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের শৈশব ও শিক্ষাজীবন
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ছোটবেলা থেকেই ছবি আঁকার প্রতি আগ্রহী ছিলেন এবং ১৯৩৩ সালে কলকাতার গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টসে ভর্তি হন, যেখানে তিনি পাঁচ বছর ব্রিটিশ/ইউরোপীয় ধারার ওপর পড়াশোনা করেন। ১৯৩৮ সালে তিনি প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। তার পিতা ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা এবং পরিবারে একটি শৃঙ্খলাপূর্ণ পরিবেশ বিরাজ করত। শৈশবকাল থেকেই জয়নুল প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, নদী-নালা, গ্রামীণ জীবনের নানা দৃশ্য ও মানুষের কাজকর্ম লক্ষ্য করে তা কাগজে ফুটিয়ে তুলতে ভালোবাসতেন। প্রাথমিক শিক্ষাজীবনে তিনি সাধারণ পড়াশোনার পাশাপাশি অঙ্কনের প্রতিও গভীর আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তার প্রতিভার বিকাশ দেখে শিক্ষকরা তাকে উৎসাহিত করতেন। ছাত্রজীবনে তিনি বিখ্যাত শিল্পী প্রভাশ দাসের সংস্পর্শে আসেন, যিনি তার শিল্পবোধ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের শিল্পজীবনের সূচনা
কলকাতার আর্ট স্কুল থেকে পাশ করার পরই শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন শিক্ষকতা শুরু করেন। তিনি ভারতীয় চিত্রকলায় নতুন ধারা আনতে সচেষ্ট ছিলেন। তার চিত্রকর্মে প্রথাগত ধারা ভেঙে নতুন আধুনিকতাবোধ যুক্ত হয়। ১৯৪৩ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষে তিনি অসংখ্য ক্ষুধার্ত মানুষকে কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেন। সেই সময় তিনি কালো কালি ও কাগজ ব্যবহার করে দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের করুণ চিত্র ফুটিয়ে তোলেন। তার আঁকা দুর্ভিক্ষের চিত্রমালা শুধু শিল্পকলায় নয়, মানবতার ইতিহাসে এক মাইলফলক হয়ে আছে। এসব ছবিতে তিনি দেখিয়েছেন ক্ষুধার্ত মানুষ, মৃতদেহ বহনকারী, কঙ্কালসার শিশু ও দুর্দশাগ্রস্ত নারী-পুরুষের বাস্তব রূপ। এগুলোতে কোনো শৌখিনতা বা অতিরঞ্জন নেই, আছে খাঁটি বাস্তবতা।
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের ঢাকায় শিল্পচর্চা ও চারুকলা প্রতিষ্ঠা
১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর তিনি ঢাকায় চলে আসেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক সময়ে পূর্ব বাংলায় শিল্পচর্চার অবস্থা ছিল প্রায় অনগ্রসর। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন বাংলাদেশে চারুকলার প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি স্থাপনকারী একজন পথিকৃৎ শিল্পী। ১৯৪৮ সালে তিনি ঢাকা আর্ট ইনস্টিটিউট (বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ) প্রতিষ্ঠা করেন, যা এই অঞ্চলে প্রাতিষ্ঠানিক চারু ও কারুকলা শিক্ষার সূচনা করে। চারুকলা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তিনি আধুনিক শিল্পশিক্ষার দ্বার উন্মোচন করেন। এখান থেকে অসংখ্য শিক্ষার্থী শিল্পী হিসেবে গড়ে ওঠেন এবং বাংলাদেশের শিল্পকলার আন্তর্জাতিক পরিচিতি লাভে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন এর কিছু শিল্পকর্ম
তাঁর বিখ্যাত চিত্রকর্মগুলো হলো দুর্ভিক্ষ চিত্রমালা (১৯৪৩), নবান্ন (১৯৬৯),মনপুরা-৭০ (১৯৭৪),সংগ্রাম (১৯৫৯),সাঁওতাল দম্পতি,নৌকা,বীর মুক্তিযোদ্ধা,ব্রহ্মপুত্র ও জলরঙের সিরিজ।
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা
ময়মনসিংহ শহরের উত্তর পাশ দিয়ে প্রবহমান পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে একটি দোতলা দালান আশ্রয় করে ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে এই সংগ্রহশালাটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ এপ্রিল বাংলা ১৩৮২ সালের ১লা বৈশাখ তারিখে তৎকালীন বাংলাদেশ সরকারের উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এই সংগ্রহশালার উদ্বোধন করেন। সে সময় দেশব্যাপী জয়নুল আবেদিনের বিভিন্ন শিল্পকর্ম সংরক্ষণের নির্দেশ দেয়া হয়েছিলো। আর তাই প্রথম দিকেই শিল্পীর নিজের এলাকা তথা ময়মনসিংহে এই সংগহশালাটি প্রতিষ্ঠিত হয়। উদ্বোধনের পর ৭ জুলাই তারিখে সংগ্রহশালার আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়। ২০০৬ খ্রিষ্টাব্দে সংগ্রহশালাটি নতুন করে সাজানো হয়। নীচতলায় ব্যবস্থাপনা কক্ষসমূহ এবং দোতলায় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ছবির গ্যালারী স্থাপন করা হয়। মূল ভবনের পেছনভাগে ব্যবস্থাপকদের বাসস্থানের সঙ্গে সঙ্গে ৩টি কুটির স্থাপন করা হয়েছে যা শিল্পরসিকদের সাময়িক আবাসনের জন্য ব্যবহার করা হয়।
শিল্পধারা ও বৈশিষ্ট্য
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের শিল্পধারায় মানবতাবোধ, সামাজিক চেতনা ও লোকজ ঐতিহ্যের প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষণীয়। তাঁর শিল্পকর্মে বাংলার প্রকৃতি, মানুষ ও জীবনযাত্রার প্রতিচ্ছবি দেখা যায়, যা ‘শিল্পের সারল্য’ ধারণার মাধ্যমে ফুটে ওঠে। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষে কঙ্কালসার মানুষের ছবি আঁকার মাধ্যমে তিনি আন্তর্জাতিক খ্যাতি লাভ করেন এবং ‘সংগ্রাম’ ও ‘নবান্ন’-এর মতো কালজয়ী চিত্রকর্ম সৃষ্টি করেন। তাঁর শিল্পকর্মের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো গভীর আবেগ, শক্তিশালী রেখা এবং দেশীয় মূল্যবোধের প্রকাশ।
জয়নুল আবেদিনের চিত্রকলায় কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য স্পষ্টভাবে দেখা যায়:
বাস্তবধর্মী চিত্রায়ণ: তিনি মানুষের দুঃখ-কষ্ট, আনন্দ-বেদনা, সংগ্রাম ও প্রকৃতিকে বাস্তবভাবে উপস্থাপন করেছেন।
কালো কালি ও রেখার ব্যবহার: দুর্ভিক্ষ সিরিজে তিনি রেখার শক্তিশালী ব্যবহার দেখিয়েছেন। এতে আবেগের গভীরতা ফুটে উঠেছে।
লোকজ প্রেরণা: তিনি বাংলার নকশিকাঁথা, পালাগান, মৃৎশিল্প ইত্যাদি লোকজ ঐতিহ্যকে তার কাজে অন্তর্ভুক্ত করেছেন।
আন্তর্জাতিক প্রভাব: পাশ্চাত্যের শিল্পধারার সঙ্গে দেশীয় সংস্কৃতির সংমিশ্রণে তিনি নিজস্ব ধারা তৈরি করেছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধ ও রাজনৈতিক চেতনা
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সরাসরি রাজনীতি না করলেও তাঁর শিল্পকর্মের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ ও রাজনৈতিক চেতনার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। তিনি ১৯৫৭ সালের ‘নৌকা’, ১৯৫৯ সালের ‘সংগ্রাম’, এবং ১৯৭১ সালের ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’ শিল্পকর্মের মাধ্যমে গণমানুষের সংগ্রাম ও দেশপ্রেমকে তুলে ধরেন। যুদ্ধের সময় তিনি দেশেই ছিলেন এবং নিজের তুলির মাধ্যমে ‘শরণার্থী’ ছবির মতো শিল্পকর্ম তৈরি করে মানুষের দুঃখ-কষ্ট ও দেশান্তরের বাস্তব চিত্র ফুটিয়ে তোলেন। এছাড়া, তিনি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী প্রদত্ত ‘হিলাল-ই-ইমতিয়াজ’ খেতাব প্রত্যাখ্যান করে তাঁর রাজনৈতিক অঙ্গীকার প্রকাশ করেন।
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন কেবল একজন কেবল শিল্পী ছিলেন না, তিনি মুক্তিকামী বাঙালির একজন সক্রিয় সাংস্কৃতিক যোদ্ধা ছিলেন। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক দমননীতি ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে তিনি প্রতিবাদী ছিলেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল জাগ্রত করার জন্য নানা কাজে যুক্ত ছিলেন। বিশেষত, তিনি ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের দুর্দশা নিয়ে আঁকা ছবির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পূর্ব বাংলার মানুষের দুরবস্থার কথা তুলে ধরেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন তার চিত্রকর্ম স্বাধীনতার পক্ষে এক শক্তিশালী অস্ত্র হয়ে ওঠে।
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের প্রধান অবদানসমূহ
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের প্রধান অবদানগুলোর মধ্যে রয়েছে ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ-বিষয়ক চিত্রমালা সৃষ্টি, যা তাকে খ্যাতি এনে দেয়; তাঁর বিখ্যাত চিত্রকর্ম যেমন “নৌকা”, “সংগ্রাম”, “নবান্ন”, এবং “মনপুরা-৭০”; ১৯৪৮ সালে বাংলাদেশে আধুনিক শিল্পকলা চর্চার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে ইনস্টিটিউট অব আর্টস অ্যান্ড ক্র্যাফ্টস (বর্তমান চারুকলা অনুষদ) প্রতিষ্ঠা এবং অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন; এবং গ্রামীণ জীবন ও বাংলার প্রকৃতিকে তাঁর চিত্রকর্মে নিবিড়ভাবে তুলে ধরা। তিনি বাংলাদেশের চিত্রকলাকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং শিল্পকলায় তাঁর অবদানের জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করেন।
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের শেষ জীবন ও মৃত্যু
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ১৯৭৬ সালের ২৮ মে মাত্র ৬১ বছর বয়স এ মৃত্যুবরণ করেন এবং এই দিনটি তার মৃত্যুবার্ষিকী হিসেবে পালিত হয়। তার শেষ জীবন শিল্পকলা চর্চা ও প্রচারের মধ্যে দিয়েই কেটেছে, বিশেষ করে বাংলাদেশে চারুকলার বিকাশে তিনি আমৃত্যু কাজ করে গেছেন। তিনি তার শেষ জীবনেও দেশের শিল্প ও সংস্কৃতিকে পুনরুজ্জীবিত করার আন্দোলনে নিজেকে জড়িত রেখেছিলেন।
উত্তরাধিকার ও প্রভাব
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন বাংলাদেশ তথা পূর্ববঙ্গের আধুনিক শিল্প আন্দোলনের পথিকৃৎ, যার উত্তরাধিকার হলো শিল্পকলা চর্চার প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা এবং লোকশিল্পের সংরক্ষণ। তার প্রভাবের মধ্যে রয়েছে বাংলার মাটি, মানুষ ও প্রকৃতির চিত্রায়ণ এবং ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মেলবন্ধনে এক নতুন ধারার সৃষ্টি। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষে আঁকা ছবি, যেমন ‘নবান্ন’ ও ‘মনপুরা-৭০’ (১৯৭০), তার সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রতিফলন এবং একাত্তরের ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’ তার জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রতীক। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের কাজ শুধু শিল্পকলার ইতিহাসেই নয়, বরং জাতীয় ইতিহাসেও অমূল্য সম্পদ। তাকে যথার্থই “শিল্পাচার্য” উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে। তিনি প্রমাণ করেছেন শিল্প মানে শুধু সৌন্দর্যের প্রকাশ নয়; শিল্প হলো মানুষের সংগ্রাম, দুঃখ, আশা ও মুক্তির প্রতিফলন।
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন কেবল একজন ব্যক্তিমানুষ ছিলেন না, তিনি ছিলেন একটি যুগের প্রতীক। তার জীবন ও শিল্পকর্ম আমাদের সামনে যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে তা হলো—শিল্প কেবল বিনোদন বা সৌন্দর্যচর্চার উপকরণ নয়, বরং সমাজের দর্পণ, জাতির ইতিহাস এবং মানুষের মুক্তির হাতিয়ার।
বাংলাদেশের ইতিহাসে যেসব মহান ব্যক্তিত্ব জাতিকে গঠন করেছে,শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ সিরিজে তিনি ক্ষুধার্ত মানুষের হাহাকার বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরেন, যা কেবল শিল্পকলার নয়, ইতিহাসেরও দলিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর মাধ্যমে তিনি দেখিয়েছেন শিল্পীর দায়িত্ব কেবল নান্দনিক প্রকাশে সীমাবদ্ধ নয়; বরং শিল্পী সমাজের যন্ত্রণা, বাস্তবতা ও মানবিক বোধকে প্রকাশ করার দায়িত্বও বহন করে।
তাঁর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান হলো আধুনিক শিল্পশিক্ষার ভিত রচনা করেছিলেন। ১৯৪৮ সালে চারুকলা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করে তিনি যে ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন, তা আজও বাংলাদেশের শিল্পচর্চার কেন্দ্রবিন্দু। এখান থেকে অসংখ্য শিল্পী বেরিয়ে এসে বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল করেছেন। তাছাড়া সোনারগাঁও লোকশিল্প জাদুঘর প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তিনি প্রমাণ করেছেন যে, তিনি শুধু আধুনিক শিল্পকলার ধারক ছিলেন না, বরং বাংলার গ্রামীণ ও লোকশিল্পকেও নতুনভাবে মর্যাদা দিয়েছেন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার ইতিহাসেও তার নাম বিশেষভাবে উচ্চারিত হয়। রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতার সময়ে তিনি কখনো নীরব দর্শক হয়ে থাকেননি। বরং চিত্রকর্ম, প্রদর্শনী এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তিনি মানুষের চেতনা জাগ্রত করেছেন।
মৃত্যুর পরও শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের নাম অমর হয়ে আছে। তাঁর শিল্পকর্ম যেমন সময়ের সীমানা অতিক্রম করেছে, তেমনি তাঁর চিন্তা ও দর্শনও বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে প্রেরণা দিয়ে যাবে। আজও বাংলাদেশের শিল্পচর্চায় যারা নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছেন, তাঁরা প্রত্যেকেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জয়নুল আবেদীনের উত্তরসূরি।
সবশেষে বলা যায়, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন আমাদের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের এক আলোকবর্তিকা। তিনি প্রমাণ করেছেন, একজন শিল্পীর কলম বা তুলি কখনো কখনো ইতিহাসের সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র হয়ে উঠতে পারে। বাংলার মাটি, মানুষের মুখ, কষ্ট আর স্বপ্নকে বিশ্বমঞ্চে উপস্থাপন করে তিনি বাঙালি জাতিকে এক নতুন মর্যাদা দিয়েছেন। তাই তাঁকে শুধু বাংলাদেশের নয়, সমগ্র বিশ্বের শিল্প-ইতিহাসে চিরস্থায়ী আসনে বসানো যায়।
তথ্যসূত্র
আবদুল্লাহ আল-মামুন, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন, বাংলা একাডেমি, ঢাকা।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, বাংলাদেশের আধুনিক শিল্পকলা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনা।
এনসাইক্লোপিডিয়া বাংলাদেশিকা (প্রথম খণ্ড), এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ।
Shilpacharya Zainul Abedin, Official Archive, Bangladesh National Museum.
Hamiduzzaman Khan, Art and Artists of Bangladesh, Dhaka Art Centre.
Banglapedia: National Encyclopedia of Bangladesh (Asia Society, Asiatic Society of Bangladesh).