Friday, October 3, 2025
Homeজীবনীশহীদ তিতুমীরের জীবনী

শহীদ তিতুমীরের জীবনী

শহীদ তিতুমীরের পরিচয়

শহীদ তিতুমীর, যার আসল নাম সৈয়দ মীর নিসার আলী,তিনি ছিলেন একজন ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী এবং ওয়াহাবী আন্দোলনের অন্যতম নেতা। তিনি ব্রিটিশ শাসক ও অত্যাচারী জমিদারদের বিরুদ্ধে কৃষকদের সংগঠিত করে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন এবং নারিকেলবেড়িয়ায় বিখ্যাত ‘বাঁশের কেল্লা’ নির্মাণ করেন। ব্রিটিশদের সাথে যুদ্ধে এই কেল্লাতেই তিনি শহীদ হন। বাংলার ইতিহাসে শহীদ তিতুমীর (১৭৮২–১৮৩১) এমন এক নাম, যা ঔপনিবেশিক শাসন ও সামন্ততান্ত্রিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগ্রামী জনতার প্রতীক। তিনি কেবল ধর্মীয় নেতা ছিলেন না; বরং ছিলেন কৃষক ও নিম্নবর্গের মুক্তির যোদ্ধা। তাঁর নেতৃত্বে ১৮৩১ সালের বুকে বাঙালি কৃষকের প্রথম সংগঠিত সশস্ত্র বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। ইংরেজ শাসক ও তাদের দোসর জমিদারদের বিরুদ্ধে তাঁর বাঁশের কেল্লা এক ঐতিহাসিক প্রতিরোধ আন্দোলনের প্রতীক হয়ে আছে।

শহীদ তিতুমীর কে ছিলেন

সৈয়দ মীর নিসার আলী (২৭ জানুয়ারী ১২৮২ – ১৯ নভেম্বর ১৮৩১), যিনি তিতুমীর নামে বেশি পরিচিত, ব্রিটিশ ভারতের প্রথম বাংলাভাষী বিপ্লবীদের মধ্যে একজন যিনি ইসলামী পুনরুজ্জীবনবাদের একটি স্ট্র্যান্ড গড়ে তুলেছিলেন, কখনও কখনও কৃষি ও রাজনৈতিক চেতনার সাথে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের জন্যও। তিনি ব্রিটিশ শাসন ও তাদের অনুগত অত্যাচারী জমিদারদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম এবং তার বিখ্যাত বাঁশের কেল্লার জন্য বিখ্যাত হয়ে আছেন।

শহীদ তিতুমীরের আসল নাম কি

শহীদ তিতুমীরের আসল নাম সৈয়দ মীর নিসার আলী. তিনি ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী ছিলেন এবং তাঁর বিখ্যাত বাঁশের কেল্লার জন্য পরিচিতি লাভ করেন।

শহীদ তিতুমীরের জন্ম ও শৈশব

শহীদ তিতুমীর ১৭৮২ সালের ২৭ জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার বসিরহাট মহকুমার চাঁদপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন এক সুন্নী মুসলিম পরিবার থেকে আসা ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবী, যার প্রাথমিক শিক্ষা গ্রামের পাঠশালায় সম্পন্ন হয় এবং তিনি পরে স্থানীয় মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেন। তাঁর পিতা ছিলেন মীর হাসান আলী এবং মাতা ছিলেন আবিদা রোকেয়া খাতুন। তাঁর পরিবার ইসলামের চতুর্থ খলিফা হযরত আলী (রাঃ)-এর বংশধর বলে জানা যায়। তাঁর পূর্বপুরুষ সাইয়্যেদ শাদাত আলী আরব থেকে বাংলায় এসে ইসলাম প্রচার শুরু করেন। তিনি কুরআনে হাফেজ ছিলেন এবং বাংলা, আরবি ও ফার্সি ভাষায় দক্ষ ছিলেন। পরবর্তীতে কলকাতায় উচ্চতর শিক্ষা নিতে গেলে তিনি ইসলামী শরীয়াহ ও তৎকালীন সামাজিক সংস্কার আন্দোলনের সাথে পরিচিত হন। তিনি আরবি ও ফার্সি সাহিত্যের প্রতি গভীর অনুরাগী ছিলেন। এই প্রাথমিক জীবনের শিক্ষা ও পারিপার্শ্বিক অবস্থাই পরবর্তীতে তাঁকে ব্রিটিশ ও জমিদারদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে উদ্বুদ্ধ করেছিল।

শহীদ তিতুমীরের প্রাথমিক কর্মজীবন

শহীদ তিতুমীরের প্রাথমিক কর্মজীবনের শুরু হয়েছিল ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কারমূলক কাজের মাধ্যমে। তিনি ১৮২২ সালে হজ করতে মক্কায় গিয়ে সাইয়িদ আহমদ বেরেলীর সান্নিধ্য লাভ করেন এবং তাঁর কাছ থেকে ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ করেন। দেশে ফিরে তিনি বাংলার মুসলমানদের মধ্যে ইসলামি অনুশাসন প্রচার শুরু করেন, পাশাপাশি জমিদারদের অত্যাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে কৃষকদের সংগঠিত করে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। তিতুমীর শৈশবে কৃষক পরিবারে বেড়ে উঠলেও জ্ঞানার্জনে প্রবল আগ্রহী ছিলেন। কলকাতায় অবস্থানকালে তিনি সমসাময়িক মুসলিম সংস্কারক ও ওহাবি মতবাদের প্রভাবিত আলেমদের সংস্পর্শে আসেন। ওহাবি আন্দোলন মূলত ইসলামে অশুদ্ধাচার, কুসংস্কার ও শোষণ দূর করার জন্য পরিচালিত হচ্ছিল। তিতুমীর জীবনধারণের জন্য এক সময় শিক্ষকতা করেন এবং পরে স্থানীয় জমিদারদের খাজনা আদায় সংক্রান্ত কাজেও যুক্ত ছিলেন। তবে দ্রুতই তিনি জমিদার ও ইংরেজ শাসকদের অবিচার প্রত্যক্ষ করেন। এই অভিজ্ঞতা তাঁকে কৃষক-জনতার মুক্তির সংগ্রামে নামতে অনুপ্রাণিত করে।

শহীদ তিতুমীরের সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কার

শহীদ তিতুমীরের প্রধান সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কারের মধ্যে ছিল, মুসলিম সমাজে শির্ক ও বিদআতের অনুশীলন থেকে মুক্তি এবং ইসলামের মৌলিক নীতি ও অনুশাসন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা। তিনি ব্রিটিশ ও জমিদারদের শোষণের বিরুদ্ধে এবং অবৈধ কর (যেমন বাঁশের খুঁটি কর) বন্ধ করার জন্য আন্দোলন গড়ে তোলেন। তার নেতৃত্বে কৃষকরা সংগঠিত হয় এবং ‘তরীকা-ই-মোহাম্মদীয়া’ আন্দোলনের মাধ্যমে সমাজে ধর্মীয় ও সামাজিক বিশুদ্ধতা প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা হয়।

শহীদ তিতুমীর তাঁর আন্দোলনের মূল শিকড় স্থাপন করেছিলেন সাধারণ মানুষের জীবনে। তিনি মুসলমানদের মধ্যে প্রচলিত অন্ধবিশ্বাস,অলৌকিকতার ভ্রান্ত ধারণা এবং অশিক্ষা দূর করার চেষ্টা করেন। কৃষকদের জন্য ন্যায্য খাজনা আদায় ও জমিদারদের শোষণ বন্ধের দাবি তোলেন। নিম্নবর্গীয় মুসলমানদের আত্মমর্যাদা ও সংগ্রামী চেতনা জাগ্রত করেন। তাঁর প্রচারণা গ্রামীণ সমাজে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষত তাঁতি, কৃষক, নাপিত, লোহা-কারিগর ইত্যাদি পেশাজীবী শ্রেণি তাঁর আন্দোলনের শক্তিশালী বাহিনী হয়ে ওঠে।

শহীদ তিতুমীরের ব্রিটিশ ও জমিদার নিপীড়ন

শহীদ তিতুমীরের বারাসাত বিদ্রোহ (১৮৩০-১৮৩১) ব্রিটিশ ও জমিদারদের শোষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে একটি সশস্ত্র প্রতিরোধ ছিল। উনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে বাংলার কৃষক সমাজ নানা ধরনের শোষণের শিকার ছিল। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি রাজস্ব আদায়ে কঠোরতা আরোপ করে। হিন্দু-মুসলিম জমিদার ও মহাজনেরা কৃষকদের অতিরিক্ত খাজনা দিতে বাধ্য করত। মুসলমান কৃষকদের ক্ষেত্রে বিশেষ কিছু বৈষম্য ছিল। উদাহরণস্বরূপ, হিন্দু জমিদার কৃষকদের দাড়ি রাখার জন্য ‘দাড়ি কর’ নামে এক ধরনের অমানবিক খাজনা চাপাত। তিতুমীর কৃষকদের ওপর চাপানো অবৈধ কর, যেমন বাঁশের খুঁটি কর, এবং জমিদারদের শোষণ থেকে মুক্তির জন্য কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ করে আন্দোলন শুরু করেন। তিনি ধর্মীয় সংস্কারের পাশাপাশি রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে জমিদার ও ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। অবশেষে, ব্রিটিশ সেনাবাহিনী নারকেলবাড়িয়ার বাঁশের কেল্লায় তিতুমীর ও তাঁর অনুসারীদের ঘিরে ফেলে এবং ব্রিটিশদের হাতে তিতুমীর নিহত হন।

শহীদ তিতুমীরের আন্দোলনের সূচনা

শহীদ তিতুমীরের আন্দোলনের সূচনা হয় ১৮২৭ সালে, যখন তিনি তাঁর গ্রামের দরিদ্র কৃষকদের নিয়ে জমিদার এবং ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকদের শোষণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। তাঁর এই আন্দোলনের মূল ভিত্তি ছিল ওয়াহাবি মতবাদ, যা তিনি মক্কায় সৈয়দ আহমেদ শহীদ-এর শিষ্যত্ব গ্রহণ করার পর অর্জন করেন। তিনি মানুষকে ইসলামি শরীয়াহ মেনে চলতে উৎসাহিত করেন এবং একইসাথে জমিদারদের অবিচারের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর ডাক দেন। ১৮৩০ সালে বারাসাত অঞ্চলের জমিদার কৃষকদের উপর নতুন কর আরোপ করলে তিতুমীর বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন। তিনি গ্রামে গ্রামে সভা করে কৃষকদের সংগঠিত করতে থাকেন। তিতুমীরের এ আন্দোলন কেবল ধর্মীয় সংস্কারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং এটি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শোষণ ও স্থানীয় জমিদারি শোষণের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিরোধেও রূপান্তরিত হয়েছিল।

শহীদ তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা নির্মাণ

শহীদ তিতুমীর তার ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে ১৮৩১ সালের ২৩শে অক্টোবর পশ্চিমবঙ্গের বারাসতের কাছে নারিকেলবাড়িয়ায় বাঁশ ও কাদা দিয়ে দ্বি-স্তর বিশিষ্ট একটি কেল্লা নির্মাণ করেন, যা বাঁশের কেল্লা নামে পরিচিত। এটি ছিল তার অনুসারীদের সংগঠিত করার, প্রশিক্ষণ দেওয়ার এবং ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার একটি কেন্দ্র।

উদ্দেশ্য

ব্রিটিশ শাসকদের অত্যাচার ও জমিদারদের শোষণ থেকে কৃষকদের সংগঠিত করা।

অনুসারীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং তাদের জন্য একটি নিরাপদ আশ্রয় ও অস্ত্র মজুদ করার ব্যবস্থা করা।

ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য একটি বিপ্লবী কেন্দ্র স্থাপন করা।

গুরুত্ব

বাঁশের কেল্লা ছিল স্থানীয় জনগণের সাহসিকতা ও উদ্ভাবনী চিন্তার প্রতীক।

এটি ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য স্থাপনা।

এই কেল্লাটি পরবর্তীকালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যও অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করে

শহীদ তিতুমীরের সাথে ইংরেজদের যুদ্ধ

শহীদ তিতুমীরের সঙ্গে ব্রিটিশদের যুদ্ধ ১৮৩১ সালের ১৯ নভেম্বর নারিকেলবাড়িয়ার বাঁশের কেল্লায় সংঘটিত হয়, যেখানে কর্নেল স্টুয়ার্ডের নেতৃত্বে ব্রিটিশ বাহিনী কামানের গোলার আঘাতে কেল্লাটি ধ্বংস করে দেয়। তিতুমীরের প্রায় ৫,০০০ সৈন্য ইংরেজদের সাথে মোকাবিলা করে। কিন্তু আগ্নেয়াস্ত্র ও প্রশিক্ষিত বাহিনীর কাছে কৃষক বাহিনী টিকতে পারেনি। এই যুদ্ধে তিতুমীর ও তাঁর প্রায় ৪০ জন সঙ্গী বীরত্বপূর্ণভাবে লড়াই করে শহীদ হন, যা বারাসাত বিদ্রোহের চূড়ান্ত পরিণতি হিসেবে বিবেচিত হয়। তাঁর মৃত্যু বাংলার প্রতিরোধ ইতিহাসে এক অমর অধ্যায় সৃষ্টি করে।

শহীদ তিতুমীরের আদর্শ

শহীদ তিতুমীরের প্রধান আদর্শ ছিল ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে জনগণের স্বাধীনতা ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা, যা তিনি জমিদার এবং ব্রিটিশ নীলকরদের শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে কৃষকদের সংগঠিত করার মাধ্যমে প্রকাশ করেছিলেন। তিনি মক্কায় সৈয়দ আহমেদ শহীদ-এর সংস্পর্শে এসে ওয়াহাবি মতবাদ দ্বারা প্রভাবিত হন এবং ইসলামের শরিয়তভিত্তিক জীবনযাপন ও সামাজিক সংস্কারের উপর জোর দেন। তাঁর নীতি ছিল ঐক্য, সাহসিকতা ও আদর্শের ভিত্তিতে যেকোনো অন্যায় শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো।

শহীদ তিতুমীরের ঐতিহাসিক গুরুত্ব

শহীদ তিতুমীরের ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম কারণ তিনি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রথমদিকের প্রতিরোধ গড়ে তোলেন এবং বাংলার কৃষকদের শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগঠিত করেন। তাঁর তৈরি বিখ্যাত “বাঁশের কেল্লা” ছিল ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রতীক, যা তাঁর স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতীকী তাৎপর্য বাড়িয়েছে। তিতুমীরের আন্দোলন মূলত বারাসত বিদ্রোহ নামে পরিচিত, যা ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।

শহীদ তিতুমীরের বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও এটি বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে বিশাল গুরুত্ব বহন করে। এটি ছিল বাংলার প্রথম সশস্ত্র কৃষক বিদ্রোহ।পরবর্তীতে ফকির-সন্ন্যাসী আন্দোলন, নীল বিদ্রোহ, তেভাগা আন্দোলন ইত্যাদির পূর্বসূত্র হিসেবে তিতুমীরের নাম উজ্জ্বল হয়ে আছে। ব্রিটিশ শাসনবিরোধী আন্দোলনে তিতুমীর শহীদ বীরের মর্যাদা পান।

শহীদ তিতুমীরের উত্তরাধিকার

শহীদ তিতুমীরের উত্তরাধিকার হলো ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রাম, সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কারের প্রতীক এবং দেশপ্রেমের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তাঁর সংগ্রাম ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে স্থানীয় মুসলিম জনগণের সশস্ত্র প্রতিরোধ হিসেবে পরিচিত। ১৯ শতকে জমিদারদের অত্যাচার ও ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে তাঁর লড়াই এবং বিখ্যাত বাঁশের কেল্লার নির্মাণ তাঁর ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার। তিতুমীর তাঁর অনুসারীদের অনুপ্রাণিত করেন এবং তাঁর অবদান পরবর্তী প্রজন্মের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের জন্য প্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করেছে। আজও শহীদ তিতুমীরের নাম উচ্চারণ করা হয় কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির প্রতীক হিসেবে। ঢাকায় শহীদ তিতুমীর সরকারি কলেজ, কলকাতায় রাস্তা ও প্রতিষ্ঠান তাঁর নামে নামকরণ করা হয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে তাঁকে এক অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে ধরা হয়।

শহীদ তিতুমীর ছিলেন বাংলার কৃষক সমাজের এক দুর্দান্ত প্রতিরোধ যোদ্ধা, যিনি জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত শোষণ ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। তাঁর নেতৃত্বে ১৮৩১ সালের বাঁশের কেল্লার যুদ্ধ কেবল একটি সামরিক সংঘর্ষ ছিল না, বরং এটি ছিল বাংলার কৃষকদের আত্মমর্যাদা ও অধিকার রক্ষার এক ঐতিহাসিক ঘোষণা।

শহীদ তিতুমীর আমাদের ইতিহাসে যে শিক্ষা দিয়ে গেছেন, তা বহুস্তরীয়। প্রথমত, তিনি প্রমাণ করেছিলেন যে, সাধারণ কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষ ঐক্যবদ্ধ হলে ক্ষমতাধর শাসক ও জমিদার শ্রেণির বিরুদ্ধেও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে। তাঁর আন্দোলনের মাধ্যমে সমাজের প্রান্তিক মানুষ নতুনভাবে নিজেদের শক্তি ও মর্যাদা সম্পর্কে সচেতন হয়।

দ্বিতীয়ত, তিনি ছিলেন সামাজিক সংস্কারক। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে অপব্যয়, অন্ধবিশ্বাস এবং সামাজিক কুসংস্কার দূর করার চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর কাছে ধর্ম মানে ছিল ন্যায়, সমতা ও মুক্তি। ফলে তাঁর আন্দোলন কেবল রাজনৈতিক বিদ্রোহ নয়, বরং নৈতিক ও সামাজিক সংস্কারেরও এক রূপ ছিল।

তৃতীয়ত, বাঁশের কেল্লা প্রতীক হয়ে আছে সৃজনশীল প্রতিরোধ কৌশলের। অস্ত্রশস্ত্রে দুর্বল কৃষকরা যখন ইংরেজ সেনার আধুনিক অস্ত্রের সামনে দাঁড়িয়েছিল, তখন তারা কৌশল হিসেবে বাঁশ দিয়ে প্রতিরক্ষা দুর্গ তৈরি করে। যদিও সেই দুর্গ শেষ পর্যন্ত টিকেনি, কিন্তু এর প্রতীকী গুরুত্ব বাংলার ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে।

চতুর্থত, শহীদ তিতুমীরের মৃত্যু বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক অনন্য অনুপ্রেরণা। তিনি দেখিয়েছিলেন যে শোষক-শাসকের বিরুদ্ধে লড়াই জীবন দিয়ে হলেও করতে হয়। তাঁর আত্মত্যাগ পরবর্তী কৃষক আন্দোলন, ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ, নীলবিদ্রোহ কিংবা ঔপনিবেশিক-বিরোধী জাতীয় আন্দোলনে শক্তি যুগিয়েছে।

অবশেষে বলা যায়, শহীদ তিতুমীরের নাম কেবল ইতিহাসের পাতায় সীমাবদ্ধ নয়। তিনি আজও নিপীড়িত মানুষের লড়াইয়ের প্রেরণার উৎস। তাঁর বাঁশের কেল্লা আজকের দিনে হয়তো ভৌত অস্তিত্বে নেই, কিন্তু তা প্রতিরোধ, সাহস ও স্বাধীনতার এক চিরন্তন প্রতীক হয়ে বেঁচে আছে।

বাংলাদেশ ও বাংলার মানুষ তাঁকে স্মরণ করে কৃষক-শ্রমিক শ্রেণির মুক্তিসংগ্রামের প্রথম শহীদ হিসেবে। শহীদ তিতুমীর তাই কেবল একজন মানুষ নন, তিনি এক প্রতীক—অন্যায়ের বিরুদ্ধে অটল দাঁড়িয়ে থাকা, স্বাধীনতার জন্য আত্মদান করা, এবং নিপীড়িত জনতার মুক্তি আন্দোলনের চিরন্তন আলোকবর্তিকা।

তথ্যসূত্র

আতিকুল্লাহ, সৈয়দ। বাংলার কৃষক আন্দোলনের ইতিহাস। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনা, ১৯৮৪।

আহমদ, সৈয়দ নজরুল। বাংলার কৃষক বিদ্রোহ ও শহীদ তিতুমীর। বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৭৫।

ইসলাম, সেলিমুল। তিতুমীর: বাংলার কৃষক আন্দোলনের অগ্রদূত। মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, ২০০২।

Government of India Records (British Library, India Office). Reports on the Barasat Uprising, 1831.

Sengupta, Nitish. History of the Bengali-Speaking People. UBS Publishers, New Delhi, 2001.

Itihasar Golpo
Itihasar Golpohttps://itihasargolpo.com
Step into the past with our unforgettable historical journey. Discover the secrets of history on our captivating journey.
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments