পল্লী কবি জসীম উদ্দীন এর জীবনী
বাংলা সাহিত্য ভুবনে “পল্লীকবি” উপাধি পাওয়া অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক হলেন পল্লী কবি জসীম উদ্দীন। তিনি ছিলেন গ্রামীণ জীবনের কবি, বাংলার পল্লীর দুঃখ-সুখ, প্রেম-বিরহ, রীতি-রেওয়াজ, কুসংস্কার ও মানবিক অনুভূতিকে তিনি সাহিত্যিক মাধুর্যে বর্ণনা করেছেন। তাঁর কবিতা ও গান বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজকে গভীরভাবে প্রতিফলিত করেছে। কবিগানের ভাষা, সহজ সরল ছন্দ এবং লোকজ কাহিনী তাঁর রচনাকে অন্য সকল কবিদের থেকে আলাদা করেছে। পল্লী কবি জসীম উদ্দীন আবহমান বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে লালিত প্রথম পূর্ণাঙ্গ আধুনিক কবি। ঐতিহ্যবাহী বাংলা কবিতার মূল ধারাটিকে নগর সভায় নিয়ে আসার কৃতিত্ব পল্লী কবি জসীম উদ্দীনের।
পল্লী কবি জসিম উদ্দিনের জন্ম
পল্লী কবি জসীম উদ্দীন ১৯০৩ সালের ১লা জানুয়ারি ফরিদপুর জেলার তাম্বুলখানা গ্রামে তাঁর মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস একই জেলার গোবিন্দপুর গ্রামে ছিল।
পল্লী কবি জসিম উদ্দিনের বাড়ি
পল্লী কবি জসীম উদ্দিনের পৈতৃক বাড়ি ও জন্মস্থান উভয়ই ছিল ফরিদপুর জেলার গোবিন্দপুর গ্রাম। তিনি সেখানেই জন্মগ্রহণ করেন এবং এটিই তাঁর পৈতৃক বাড়ি, যদিও তাঁর জন্ম হয়েছিল মামার বাড়িতে, যা ফরিদপুরেরই তাম্বুলখানা গ্রামে অবস্থিত। তাঁর পৈতৃক বাড়িটি ফরিদপুর সদর উপজেলার অম্বিকাপুর রেলওয়ে স্টেশনের কাছে কুমার নদীর দক্ষিণে অবস্থিত।
পল্লী কবি জসিম উদ্দিনের শৈশব
পল্লী কবি জসিম উদ্দিনের পিতা আনসার উদ্দিন মোল্লা তিনি ছিলেন একজন স্কুল-শিক্ষক। তার মামার বাড়িতেই তার জন্ম ও শৈশব কাটে, যদিও তার পৈতৃক বাড়ি ছিল একই জেলার গোবিন্দপুর গ্রামে। কবি চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত গ্রামের স্কুলে পড়ার পর ফরিদপুর জিলা স্কুলে ভর্তি হন এবং সেখান থেকেই ম্যাট্রিকুলেশন সম্পন্ন করেন। তার শৈশব কেটেছে গ্রামের নদী পাড়ে খড়-নলখাগড়ার তৈরি ঘরে, যা তাকে বাংলার গ্রামীণ পরিবেশ ও প্রকৃতির সাথে গভীরভাবে পরিচিত করে তোলে। কৃষক পরিবারের সন্তান হওয়ায় তিনি শৈশব থেকেই গ্রামীণ জীবনের নিকটতম পরিবেশে বেড়ে উঠেছিলেন। মাঠ-ঘাট, নদী, চর, গ্রামীণ খেলাধুলা, হাটবাজার ও গ্রামীণ উৎসব—সবকিছু তাঁর জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়ায় এবং পরবর্তী সময়ে তাঁর সাহিত্য সৃষ্টির প্রধান অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠে।
পল্লী কবি জসিম উদ্দিনের শিক্ষাজীবন
পল্লী কবি জসীম উদ্দিনের শিক্ষাজীবন ছিল ধাপে ধাপে। তিনি ফরিদপুর হিতৈষী স্কুলে পড়াশোনা শুরু করেন, পরে ফরিদপুর জেলা স্কুল থেকে প্রবেশিকা (১৯২১), রাজেন্দ্র কলেজ থেকে আই.এ (১৯২৪) এবং বি.এ (১৯২৯) সম্পন্ন করেন। সবশেষে, তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তিনি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্য থেকে প্রভাবিত হলেও তিনি নিজের স্বতন্ত্র ধারা বজায় রেখেছিলেন।
পল্লী কবি জসিম উদ্দিনের সাহিত্যজীবনের সূচনা
পল্লী কবি জসীম উদ্দীন খুব অল্প বয়স থেকেই কবিতা লেখা শুরু করেছিলেন। পল্লী কবি জসীম উদ্দিনের সাহিত্যজীবনের সূচনা কলেজ জীবনেই হয়। ১৯২৩-২৪ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তিনি কবর কবিতাটি লেখেন, যা তাঁর সাহিত্যজীবনের ভিত্তি স্থাপন করে। এই কবিতাটি প্রবেশিকা বাংলা পাঠ্যবইয়ে স্থান পায় এবং এটিই তাকে ‘পল্লীকবি’ উপাধি এনে দেয়। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ “রাখালী” প্রকাশিত হয় ১৯২৭ সালে। এতে গ্রামীণ রাখালের জীবন, সরলতা এবং নিঃস্বার্থ প্রেমকে তিনি তুলে ধরেন। পাঠকেরা এতে গ্রামবাংলার সহজ সরল ছায়া খুঁজে পান। পরবর্তীতে তাঁর “নকশী কাঁথার মাঠ” (১৯২৯) প্রকাশিত হলে তিনি বাংলা সাহিত্যে এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে যান। এই কাব্যকাহিনীতে গ্রামীণ প্রেম-বিয়োগান্তক কাহিনী ও লোকজ জীবনের চিত্র অমর হয়ে আছে।
পল্লী কবি জসিম উদ্দিনের প্রধান সাহিত্যকর্ম
পল্লী কবি জসীম উদ্দিনের প্রধান সাহিত্যকর্মগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘নকশী কাঁথার মাঠ’, ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’, ‘রাখালী’, ‘বেদের মেয়ে’, ‘পদ্মাপার’, ‘বাঙালির হাসির গল্প’, ‘এক পয়সার বাঁশী’, ‘হসু’ এবং আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘যাদের দেখেছি’ ও ‘জীবন কথা’।
নাটক
পদ্মাপার (১৯৫০), বেদের মেয়ে (১৯৫১), মধুমালা (১৯৫১), পল্লীবধূ (১৯৫৬), গ্রামের মেয়ে (১৯৫৯), ওগো পুস্পধনু (১৯৬৮), আসমান সিংহ (১৯৮৬)।
আত্মজীবনীমূলক রচনা
জোছনা ও জননীর গল্প (একটি মহাকাব্যিক উপন্যাস), যাদের দেখেছি (১৯৫১), ঠাকুর বাড়ির আঙ্গিনায় (১৯৬১), জীবন কথা(প্রথম খণ্ড ১৯৬৪, দ্বিতীয় খণ্ড ১৯৬৮), স্মৃতিপট (১৯৬৪), স্মরণের সরণী বাহি (১৯৭৮)।
পল্লী কবি জসীম উদ্দীন এর গান
পল্লী কবি জসীম উদ্দীন ছিলেন লোকগানের অসাধারণ রচয়িতা। তাঁর গানগুলো আজও বাংলাদেশের গ্রামীণ মঞ্চে ও বাউল গানের আসরে পরিবেশিত হয়।রঙিলা নায়ের মাঝি (১৯৩৫), গাঙের পাড় (১৯৬৪), জারি গান (১৯৬৮), মুর্শিদী গান (১৯৭৭)।
পল্লী কবি জসীম উদ্দীন কবিতা
পল্লী কবি জসীম উদ্দিনের বিখ্যাত কবিতাগুলোর মধ্যে ‘নকশী কাঁথার মাঠ’, ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’, ‘কবর’, ও ‘আমার বাড়ি’ অন্যতম। তাঁর কবিতা মূলত পল্লিজীবন, গ্রামীণ প্রকৃতি ও মানুষের আবেগকে নিয়ে রচিত, যা ‘পল্লীকবি’ উপাধিতে তাকে পরিচিত করেছে।
উল্লেখযোগ্য কবিতা:
নকশী কাঁথার মাঠ (Nakshi Kanthar Math): বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ একটি গীতিকবিতা।
সোজন বাদিয়ার ঘাট (Sojan Badir Ghat): এটিও একটি উল্লেখযোগ্য গীতিকবিতা।
কবর (Kobor): একটি বিয়োগান্তক ও প্রভাবশালী একাকী কথন, যেখানে একজন বৃদ্ধ তাঁর প্রিয়জন হারানোর বেদনা ব্যক্ত করেন।
আমার বাড়ি (Amar Bari): বন্ধুকে নিজের গ্রামের বাড়িতে আমন্ত্রণ জানিয়ে সেখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও আপ্যায়ন সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে।
নিমন্ত্রণ (Nimontron): বন্ধুকে নিজের বাড়িতে নিমন্ত্রণ জানিয়ে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
পল্লী কবি জসিম উদ্দিনের সাহিত্যিক বৈশিষ্ট্য
পল্লী প্রকৃতির প্রতিচ্ছবি
পল্লী কবি জসিম উদ্দিনের কবিতায় আবহমান বাংলার গ্রামীণ জীবন, প্রকৃতি এবং মানুষের সংস্কৃতির এক জীবন্ত ও বাস্তব প্রতিচ্ছবি দেখা যায়। তাঁর লেখায় পল্লীর মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা, তাদের জীবনের টানাপোড়েন, সামাজিকতা ও পারিবারিক বন্ধন অত্যন্ত সুচারুভাবে তুলে ধরা হয়েছে।
লোকজ ভাষা ও ছন্দের ব্যবহার
তিনি নিজস্ব লোকজ ভাষা ও ঢং ব্যবহার করে গ্রামীণ জীবনের আখ্যান তুলে ধরেছেন, যা বাংলা সাহিত্যে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। তাঁর কবিতাগুলো গীতিময় ও শ্রুতিমধুর, যা পাঠককে সহজেই গ্রামীণ আবহের মধ্যে নিয়ে যায়।
সামাজিক চিত্রণ
তাঁর সাহিত্যকর্ম শুধু প্রকৃতির বর্ণনাতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং সামাজিক বৈষম্য, মানবিক সমস্যা ও বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমের বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছে।
আধুনিকতার সঙ্গে ঐতিহ্য
তিনি ছিলেন আধুনিক বাংলা সাহিত্যের কবি, যিনি নিজস্ব গ্রামীণ অভিজ্ঞতার মাধ্যমে ঐতিহ্যবাহী বাংলা কবিতার মূল ধারাটিকে নগরকেন্দ্রিক সাহিত্যের সাথে একীভূত করেছেন।
অনবদ্য সৃষ্টি
‘নকশী কাঁথার মাঠ’ এবং ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ তাঁর উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি, যা বাংলা ভাষার গীতিময় কবিতার দারুন উদাহরণ হিসেবে আজও বিবেচিত হয়।
বিশ্বজুড়ে পরিচিতি
তাঁর বহু কবিতা বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে, যা তাঁর সাহিত্যের আন্তর্জাতিক আবেদন প্রমাণ করে।
পল্লী কবি জসিম উদ্দিন এর উক্তি
পল্লী কবি জসীম উদ্দিনের উক্তিগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো দীনেশচন্দ্র সেনের উক্তি যে, “জসীম উদ্দীন আমার স্বর্গাদপি গরীয়সী পল্লী গ্রামের কথা তাঁর কাব্যে লিখেছেন,” এবং জসীম উদ্দিনের নিজের উক্তি, “পার্থক্যের জন্যই মানুষ মানুষের বন্ধু হয়। আমার ভিতরে যাহা নাই তাই আমরা অপরের নিকটে পাইয়া তাহার সঙ্গে বন্ধুত্ব করি”।
পল্লী কবি জসীম উদ্দীন সম্পর্কিত অন্যান্য উক্তি:
দীনেশচন্দ্র সেন বলেন, “এই দেখো না কবি জসীম উদ্দীন। আমি তাঁর থেকে অনেক বেশি লেখাপড়া জানি। কিন্তু তাঁর ঐ \’সুজন বাদিয়ার ঘাট\’ এর মতো দু\’লাইন কবিতা আমার পেটে বোম মারলেও আমি লিখতে পারব না। জসিম উদ্দীন একজন প্রকৃতই কবি”।
জসীম উদ্দীন নিজে বলেছিলেন, “আমার ভিতরে যাহা নাই তাই আমরা অপরের নিকটে পাইয়া তাহার সঙ্গে বন্ধুত্ব করি”।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জসীম উদ্দিনের কবিতা শুনে বলেছিলেন, “তোমার কবিতা অন্য ধরনের। আমি ছাড়া এর ছবি আর কেউ আঁকতে পারবে না”।
শিক্ষকতা ও সরকারি চাকরি
পল্লী কবি জসীম উদ্দীন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন এবং পরে সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। তিনি ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার পর পূর্ব পাকিস্তান সরকারের প্রচার বিভাগে কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন এবং ১৯৬২ সালে সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করে তিনি পূর্ণকালীন সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশ করেন।
রাজনৈতিক ও সামাজিক ভূমিকা
পল্লী কবি জসীম উদ্দিনের সরাসরি রাজনৈতিক ভূমিকা কম থাকলেও, তাঁর সামাজিক ও সাহিত্যিক কাজের মাধ্যমে তিনি বাংলার গ্রামীণ জীবন, সংস্কৃতি, এবং সাধারণ মানুষের দুঃখ-দুর্দশার প্রতি সহানুভূতি ও জনসচেতনতা সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি তাঁর লেখায় গ্রামীণ দরিদ্র কৃষক ও মজুরদের প্রতি গভীর মমতা দেখিয়েছেন, যা তৎকালীন সামাজিক বাস্তবতাকে তুলে ধরে। সাহিত্যের মাধ্যমে তিনি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনকে তুলে ধরেছেন এবং সমাজকে কলুষতা ও শোষণমুক্ত করার আহ্বান জানিয়েছেন। গ্রামীণ জনগণের জীবনযাত্রা উন্নয়ন, শিক্ষার প্রসার ও কৃষকের অধিকার প্রতিষ্ঠায় তাঁর প্রচেষ্টা ছিল লক্ষণীয়। পাকিস্তান আমলে তিনি প্রান্তিক কৃষক-শ্রমিকের দুঃখ কষ্টের কথা বলায় শাসকগোষ্ঠীর বিরাগভাজন হন।
পুরস্কার ও সম্মাননা
পল্লী কবি জসীম উদ্দিনের সম্মাননাগুলোর মধ্যে আছে প্রেসিডেন্ট’স প্রাইড অব পারফরমেন্স পুরস্কার (১৯৫৮), একুশে পদক (১৯৭৬), ও স্বাধীনতা পুরস্কার (মরণোত্তর, ১৯৭৮)। এছাড়াও তিনি ১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন। তাঁর ‘নকশী কাঁথার মাঠ’ এবং ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ কাব্যগ্রন্থ ইংরেজিসহ বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে, যা তাঁর কাজের আন্তর্জাতিক পরিচিতি বাড়িয়েছে। পল্লী কবি জসীম উদ্দীন নিজের রচনায় গ্রামীণ জীবন ও লোককথাকে ফুটিয়ে তোলার জন্য ‘পল্লী কবি’ উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন। বর্তমানে তাঁর নামে বাংলা একাডেমি ‘কবি জসীম উদ্দীন সাহিত্য পুরস্কার’ প্রদান করে থাকে, যা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য দেওয়া হয়।
পল্লী কবি জসিম উদ্দিনের মৃত্যু
পল্লী কবি জসীম উদ্দীন ১৪ মার্চ ১৯৭৬ সনে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। তার শেষ ইচ্ছা অনুসারে তাকে ফরিদপুর জেলার অম্বিকাপুর গ্রামে তার দাদীর কবরের পাশে দাফন করা হয়।
অবদান ও মূল্যায়ন
পল্লী কবি জসীম উদ্দিনের প্রধান অবদান হলো তিনি বাংলার গ্রামীণ জীবন, প্রকৃতি এবং মানুষের আনন্দ-বেদনার চিত্র তাঁর কবিতায় তুলে ধরেছেন, যা বাংলা সাহিত্যে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। তাঁর বিখ্যাত সৃষ্টিগুলোর মধ্যে ‘নকশী কাঁথার মাঠ’ ও ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ অন্যতম, যা গীতিময় কবিতার উৎকৃষ্ট নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত। এছাড়াও তিনি লোকগীতি সংগ্রহ ও সংগ্রাহক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন এবং তাঁর লেখনীর মাধ্যমে বাংলার লোকজ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছেন।
রবীন্দ্রযুগের কবি হয়েও পল্লী কবি জসীম উদ্দীন তাঁর কাব্যে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং আধুনিক যুগেও পল্লী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে একটি নিজস্ব কাব্যভুবন নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর কবিতা বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে, যা তাঁকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও পরিচিতি এনে দিয়েছে। পল্লী কবি জসীম উদ্দীন বাংলা সাহিত্যকে এক নতুন দিগন্ত উপহার দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে পল্লী কবি বলে অভিহিত করেছিলেন। তাঁর সাহিত্য থেকে আমরা বাংলার প্রকৃত গ্রামীণ রূপ খুঁজে পাই। তিনি নগরায়ণের বাইরে থেকেও গ্রামীণ সংস্কৃতি ও মানবিক আবেগকে অমরত্ব দিয়েছেন।
পল্লী কবি জসীম উদ্দীন ছিলেন এক অনন্য সাহিত্যপুরুষ, যিনি বাংলা সাহিত্যে গ্রামীণ জীবনের সৌন্দর্য ও মানবিকতার চিত্র অঙ্কন করেছেন অসাধারণ দক্ষতায়। তাঁর কাব্য ও গান শুধু সাহিত্যকর্ম নয়, বরং একেকটি জীবন্ত দলিল—যেখানে বাংলার মাঠ, নদী, খাল-বিল, হাট-বাজার, বিয়ে-শাদি, গ্রামীণ উৎসব, দুঃখ-সুখ, প্রেম-বিরহ সবকিছু স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। তিনি এমন সময় সাহিত্যচর্চা শুরু করেছিলেন, যখন বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার ঢেউ বয়ে যাচ্ছিল, শহুরে জীবন ও রাজনীতির প্রভাব সাহিত্যিকদের কলমে দৃশ্যমান হচ্ছিল। সেই প্রেক্ষাপটে জসীম উদ্দীন তাঁর কবিতায় গ্রামের কৃষক-শ্রমিক, রাখাল, দরিদ্র মানুষের জীবনের কথা বললেন—যা সাহিত্যকে দিল এক নতুন মাত্রা।
তাঁর “নকশী কাঁথার মাঠ” বা “সোজন বাদিয়ার ঘাট” শুধু প্রেমকাহিনী নয়, বরং গ্রামীণ জীবনের অন্তর্নিহিত যন্ত্রণা ও সামাজিক বাস্তবতার প্রতিফলন। তাঁর কবিতা, গান ও নাটক পড়লে বোঝা যায়, তিনি বাংলার মাটির গন্ধ ও মানুষের হৃদয়ের সঙ্গে কতটা নিবিড়ভাবে যুক্ত ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও তাঁর প্রতিভা স্বীকার করে তাঁকে “পল্লীকবি” উপাধি দেন।
পল্লী কবি জসীম উদ্দীনের সাহিত্য শুধু বাংলাদেশের নয়, বিশ্বসাহিত্যেও বিশেষ স্থান করে নিয়েছে। লোকজ ঐতিহ্যকে তিনি সাহিত্যে রূপ দিয়েছেন এমনভাবে, যা প্রমাণ করে—একজন কবি তাঁর মাটির মানুষের সঙ্গে যুক্ত থাকলে তাঁর সৃষ্টি আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও চিরস্থায়ী হয়ে ওঠে।
আজকের দিনে যখন নগরায়ণ ও প্রযুক্তি মানুষের জীবনযাত্রা পাল্টে দিয়েছে, তখনও পল্লী কবি জসীম উদ্দীনের কবিতা আমাদের গ্রামীণ শিকড়ের কথা মনে করিয়ে দেয়। তাঁর সাহিত্য আমাদের শেখায়—গ্রামীণ জীবন সরল হলেও তা গভীর আবেগ ও মানবিকতায় ভরপুর। তিনি ছিলেন দরিদ্রের কণ্ঠস্বর, নিপীড়িতের কবি এবং প্রকৃত অর্থে একজন মানবতাবাদী সাহিত্যিক।
সুতরাং বলা যায়, পল্লী কবি জসীম উদ্দীন কেবল একজন কবি ছিলেন না, তিনি ছিলেন গ্রামীণ জীবনের ইতিহাস রক্ষাকারী, লোকসংস্কৃতির সংগ্রাহক এবং বাংলার চিরন্তন সত্তার প্রতিচ্ছবি। তাঁর সাহিত্য আমাদের জাতীয় পরিচয়, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং মানবিক চেতনার স্থায়ী দলিল হয়ে থাকবে। তিনি আজীবন “পল্লীকবি” হয়েই বাঙালির হৃদয়ে অমর হয়ে আছেন।
তথ্যসূত্র
আহমদ শরীফ, বাংলা সাহিত্য ইতিহাস।
মোহাম্মদ আবদুল কাদের, পল্লীকবি জসীম উদ্দীন: জীবন ও সাহিত্য।
হুমায়ুন আজাদ (সম্পাদিত), বাংলা কাব্যের ইতিহাস।
বাংলা একাডেমি, বাংলা একাডেমি চরিতাভিধান।
আবদুল মান্নান সৈয়দ, বাংলা কবিতার ধারা।
এ কে এম আব্দুল্লাহ, জসীম উদ্দীনের কাব্য ভাবনা।