পিটার দ্য গ্রেট-এর জীবনী
পিটার দ্য গ্রেট (Peter the Great) বা পিটার I, ছিলেন রাশিয়ার এক ঐতিহাসিক রাজা যিনি ১৬৮২ থেকে ১৭২৫ সাল পর্যন্ত রাজত্ব করেন এবং রাশিয়াকে মধ্যযুগীয় অবস্থা থেকে আধুনিক, ইউরোপীয় ধাঁচের একটি শক্তিশালী সাম্রাজ্যে রূপান্তরিত করেন। তাঁর শাসনামল ছিল সংস্কার, সামরিক উন্নয়ন ও পশ্চিমা প্রভাব গ্রহণের এক যুগান্তকারী সময়কাল।
প্রারম্ভিক জীবন
পিটার দ্য গ্রেটের জন্ম ১৬৭২ সালের ৯ জুন, মস্কোতে। তিনি ছিলেন রাশিয়ার জার আলেক্সি মিখাইলোভিচ-এর এবং তার দ্বিতীয় স্ত্রী নাটালিয়া নারিশকিনা-র পুত্র। পিটারের শৈশব ছিল রাজনৈতিক সংকট ও পারিবারিক দ্বন্দ্বে ঘেরা। তার বাবার মৃত্যুর পর, মাত্র দশ বছর বয়সে তাকে এবং তার সৎ ভাই ইভান V-কে যৌথভাবে জার ঘোষণা করা হয়। তবে প্রকৃতপক্ষে ক্ষমতা ছিল তার সৎবোন সোফিয়া আলেক্সেভনার হাতে।
১৬৮৯ সালে পিটার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সোফিয়াকে সরিয়ে দেন এবং ধীরে ধীরে একক শাসকের আসনে অধিষ্ঠিত হন।
শিক্ষা ও ভ্রমণ
পিটার ছিলেন জ্ঞানপিপাসু এবং কৌতূহলী। তিনি রাশিয়ার ঐতিহ্যগত শিক্ষার পরিবর্তে ইউরোপীয় বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহী ছিলেন। ১৬৯৭-৯৮ সালে তিনি “গ্র্যান্ড এমবাসি” নামে পরিচিত একটি ইউরোপ সফরে যান, যেখানে তিনি নৌ-প্রযুক্তি, কারিগরি, সামরিক কৌশল এবং ইউরোপীয় সংস্কৃতি শিখতে চেয়েছিলেন। এই সফরে তিনি ছদ্মবেশে নৌ-কারখানায় কাজ করেছিলেন, যা তাঁর বাস্তববাদী মনোভাবের পরিচায়ক।
আধুনিকীকরণ ও সংস্কার
ইউরোপ থেকে ফিরে এসে পিটার রাশিয়াকে আধুনিক রাষ্ট্রে রূপান্তরের মিশনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তিনি পশ্চিমা ধাঁচে পোশাক, শেভিং, রীতিনীতি গ্রহণে নাগরিকদের বাধ্য করেন। প্রশাসনিক ও সামরিক সংস্কার তাঁর অন্যতম সাফল্য ছিল।
সামরিক সংস্কার: একটি স্থায়ী সেনাবাহিনী গঠন, আধুনিক অস্ত্র ব্যবহার, নৌবাহিনী গঠন ইত্যাদি পিটার দ্য গ্রেট-এর অবদান। তিনি রাশিয়ার প্রথম নৌবাহিনী প্রতিষ্ঠা করেন।
প্রশাসনিক সংস্কার: পিটার প্রশাসনিক কাঠামোকে ইউরোপীয় ধাঁচে পুনর্গঠন করেন। দেশকে বিভিন্ন প্রদেশে ভাগ করে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করেন।
আর্থিক সংস্কার: শিল্প কারখানা গড়ে তোলেন, শুল্কনীতি পরিবর্তন করেন, বিদেশি বিশেষজ্ঞদের আনেন।
শিক্ষা: গণশিক্ষা প্রসারের উদ্যোগ নেন; গাণিতিক ও সামুদ্রিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে শিক্ষার্থী পাঠান।
সেন্ট পিটার্সবার্গ
পিটার তাঁর আধুনিক রাশিয়ার প্রতীক হিসেবে নতুন রাজধানী সেন্ট পিটার্সবার্গ নির্মাণ করেন। ১৭০৩ সালে স্থাপিত এই শহরটি ইউরোপীয় নকশায় নির্মিত হয় এবং “উইন্ডো টু দ্য ওয়েস্ট” নামে পরিচিত হয়। এটি ছিল তার সংস্কারমূলক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতীক।
মহান উত্তরের যুদ্ধ (১৭০০–১৭২১)
পিটার দ্য গ্রেট সুইডেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বাল্টিক সাগরের উপকূলীয় অঞ্চল জয় করেন। এই যুদ্ধে রাশিয়ার বিজয়ের মাধ্যমে রাশিয়া প্রথমবারের মতো ইউরোপীয় পরাশক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ১৭২১ সালে এই যুদ্ধের পর পিটার “সমগ্র রাশিয়ার সম্রাট” উপাধি গ্রহণ করেন।
ধর্মীয় সংস্কার
পিটার গির্জার প্রভাব কমাতে চান। তিনি ১৭০০ সালে প্যাট্রিয়ার্ক পদের শূন্যতা বজায় রেখে “হলি সিনড” নামক একটি ধর্মীয় পরিষদ গঠন করেন যা সরাসরি রাজা কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত ছিল। এর ফলে রুশ অর্থোডক্স চার্চ রাজতন্ত্রের অধীনস্থ হয়।
ব্যক্তিত্ব ও শাসন
পিটার ছিলেন উচ্চাকাঙ্ক্ষী, উদ্যমী এবং প্রায়ই কঠোর ও নির্মম শাসক। তাঁর নেতৃত্বগুণ ও সংস্কারমূলক মনোভাব প্রশংসিত হলেও, তিনি কখনও কখনও অমানবিক শাস্তি এবং নির্মম সিদ্ধান্ত নিতেন। উদাহরণস্বরূপ, তাঁর নিজের পুত্র আলেক্সেইকে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগে কারাগারে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেন।
মৃত্যু ও উত্তরাধিকার
পিটারের মৃত্যু নিয়ে মতভেদ আছে ইতিহাসবিদদের মাঝে। বলা হয়, ১৭২৫ সালে ফিনিশ উপসাগরের কাছে একদল সৈন্যকে সমুদ্রে ডুবে দেখে যেতে দেখে সম্রাট পিটার পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। বরফ শীতল সেই পানির প্রভাবে পরে ভয়ানক অসুস্থ হয়ে মারা যান তিনি। অনেকে অবশ্য এই কাহিনী বিশ্বাস করেন না। সে যা-ই হোক, ১৭২৫ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ভোরবেলা আধুনিক রুশী সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার কোনো পুত্রসন্তান জীবিত না থাকায় দ্বিতীয় স্ত্রী ক্যাথরিন রাশিয়ার সিংহাসনে বসেন।
ঐতিহাসিক প্রভাব
পিটার দ্য গ্রেট রাশিয়ার ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী চরিত্র। তিনি মধ্যযুগীয় রাশিয়াকে আধুনিক যুগে প্রবেশ করান এবং সামরিক, প্রশাসনিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে দেশকে পুনর্গঠিত করেন। তাঁর নেতৃত্বে রাশিয়া ইউরোপীয় রাজনীতিতে প্রধান শক্তিতে পরিণত হয়।
পিটার দ্য গ্রেট ছিলেন এক অনন্য ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব যিনি ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় একটি বিশাল ও পশ্চাদপদ রাষ্ট্রকে আধুনিক যুগে নিয়ে আসেন। তাঁর সংস্কার এবং শক্তিশালী নেতৃত্ব রাশিয়ার ইতিহাসে স্থায়ী ছাপ রেখে গেছে। তাঁর জীবন থেকে শিক্ষা পাওয়া যায় যে দৃষ্টিভঙ্গি ও দৃঢ়সংকল্প থাকলে একটি জাতির ভাগ্য পরিবর্তন করা সম্ভব।
তথ্যসূত্র:
Britannica.com
History.com
“Peter the Great: His Life and World” by Robert K. Massie
Russian History Archives