Friday, October 3, 2025
Homeজীবনীনবাব সলিমুল্লাহর জীবনী

নবাব সলিমুল্লাহর জীবনী

নবাব স্যার সলিমুল্লাহ

বাংলাদেশ ও উপমহাদেশের ইতিহাসে নবাব সলিমুল্লাহ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নাম। তিনি ছিলেন একজন সমাজসংস্কারক, রাজনীতিবিদ এবং প্রভাবশালী মুসলিম অভিজাত নেতা। উনিশ শতকের শেষভাগ থেকে বিশ শতকের প্রথমদিকে ভারতের মুসলিম সমাজ যখন রাজনৈতিক ও শিক্ষাগতভাবে পিছিয়ে পড়েছিল, তখন তিনি মুসলমানদের স্বার্থরক্ষায় অসাধারণ ভূমিকা পালন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের জন্ম পর্যন্ত নানা ঐতিহাসিক ঘটনায় তাঁর অবদান অনস্বীকার্য।

নবাব সলিমুল্লাহ কে ছিলেন

খাজা সলিমুল্লাহ বা নবাব সলিমুল্লাহ (৭ জুন ১৮৭১-১৬ জানুয়ারি ১৯১৫) ঢাকার চতুর্থ নবাব ছিলেন। তার পিতা নবাব খাজা আহসানউল্লাহ ও পিতামহ নবাব খাজা আব্দুল গনি। তিনি নিখিল ভারত মুসলিম লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। তিনি ছিলেন একজন প্রভাবশালী মুসলিম রাজনীতিবিদ, যিনি তার পিতার মৃত্যুর পর উত্তরাধিকার সূত্রে ঢাকার নবাব এবং তার পিতা খাজা আহসানউল্লাহ ও পিতামহ খাজা আব্দুল গনি-র ঐতিহ্য বহন করেন। 

নবাব সলিমুল্লাহ বংশধর পরিচয়

নবাব সলিমুল্লাহর জন্ম ৭ জুন ১৮৭১ সালে ঢাকার বিখ্যাত নবাব পরিবারে। তাঁর পিতা ছিলেন খাজা আহসানুল্লাহ, যিনি ঢাকা নবাব পরিবারের দ্বিতীয় নবাব ছিলেন এবং সমাজকল্যাণমূলক নানা কর্মকাণ্ডের জন্য খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তাঁর মাতা ছিলেন নবাব বেগম ওয়াহিদুন্নেসা ঢাকা নবাব পরিবার ছিল বাংলার মুসলমান সমাজের অন্যতম অভিজাত পরিবার। তারা ব্রিটিশ শাসকদের নিকট অত্যন্ত প্রভাবশালী হিসেবে পরিচিত ছিল এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনে মুসলিম সমাজের নেতৃত্ব দিয়েছিল। এই পরিবারের সন্তান হিসেবে সলিমুল্লাহ শৈশব থেকেই শিক্ষিত, ভদ্র, রাজনীতিসচেতন এবং উদার পরিবেশে বেড়ে ওঠেন।

নবাব সলিমুল্লাহ খান এর শিক্ষা জীবন

নবাব সলিমুল্লাহ ছোটবেলা থেকেই তীক্ষ্ণ মেধাসম্পন্ন ছিলেন। এবং শিক্ষা জীবনে অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছিলেন। তিনি ব্রিটিশ সরকারের অধীনে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে যোগ দেন, যা তার প্রখর মেধা ও বিদ্যায় পারদর্শীতার সাক্ষ্য বহন করে। তিনি শুধু নিজের শিক্ষা জীবনই নয়, বরং সমগ্র মুসলিম সমাজের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, যা তাঁর শিক্ষা জীবনের একটি অংশ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। শিক্ষার প্রতি তাঁর আগ্রহ ছিল প্রবল। তিনি প্রথমে কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে পড়াশোনা করেন। পরবর্তীতে তিনি ইউরোপে গিয়ে উচ্চশিক্ষা লাভ করেন। তিনি ইংরেজি, আরবি, ফারসি ও উর্দু ভাষায় দক্ষ ছিলেন। তাঁর শিক্ষাজীবন তাঁকে মুসলিম সমাজের অগ্রগতির জন্য নতুন চিন্তাধারা ও আধুনিক সংস্কারের প্রতি উদ্বুদ্ধ করে।

নবাব সলিমুল্লাহর নবাব উপাধি অর্জন

নবাব স্যার সলিমুল্লাহ ঢাকার চতুর্থ নবাব ছিলেন এবং ১৯০১ সালে পিতার মৃত্যুর পর তিনি নবাব পদে অধিষ্ঠিত হন। ব্রিটিশ সরকার তাঁকে বিভিন্ন সময়ে সম্মানিত করে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ১৯০২ সালে সিএসআই (কম্যান্ডার অফ দ্য অর্ডার অফ দ্য স্টার অফ ইন্ডিয়া), ১৯০৩ সালে নবাব বাহাদুর, এবং ১৯১১ সালে জিসিএসআই (গ্র্যান্ড কমান্ডার অফ দ্য অর্ডার অফ দ্য স্টার অফ ইন্ডিয়া) উপাধিগুলো। তিনি ‘নবাব’ উপাধি লাভ করেন এবং দ্রুতই সমাজে প্রভাব বিস্তার করতে থাকেন। সমাজসেবামূলক কর্মকাণ্ড, দানশীলতা ও শিক্ষাবিস্তারমূলক উদ্যোগের মাধ্যমে তিনি সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জন করেন।

নবাব সলিমুল্লাহর রাজনৈতিক জীবনের সূচনা

নবাব সলিমুল্লাহর রাজনৈতিক জীবনের সূচনা হয় ১৯০৩-০৪ সালে বঙ্গভঙ্গের সময়, যখন তিনি সরকারের এই পরিকল্পনার বিষয়ে মতামত দিতে গিয়ে রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েন। ১৯০৪ সালের জানুয়ারিতে আহসান মঞ্জিলে পূর্ববঙ্গের হিন্দু-মুসলিম নেতৃবৃন্দকে নিয়ে এক সভার আয়োজন করে তিনি বঙ্গবিভাগের কিছু প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন, যা তার রাজনৈতিক জীবনের প্রথম বড় পদক্ষেপ ছিল। এর ধারাবাহিকতায় তিনি ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠায় মুখ্য ভূমিকা পালন করেন এবং বাঙালি মুসলমানদের সর্বভারতীয় রাজনীতির মূলধারায় যুক্ত করেন। নবাব সলিমুল্লাহ মূলত ব্রিটিশ সরকারের অনুগত মুসলিম অভিজাত নেতা ছিলেন। তবে তাঁর লক্ষ্য ছিল মুসলমানদের জন্য রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব ও শিক্ষার উন্নয়ন নিশ্চিত করা। তাঁর রাজনৈতিক জীবনের মোড় ঘোরে বঙ্গভঙ্গের সময় (১৯০৫ সালে)।

বঙ্গভঙ্গ ও সলিমুল্লাহর ভূমিকা

নবাব স্যার খাজা সলিমুল্লাহ বঙ্গভঙ্গ সমর্থন করেছিলেন কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন যে এটি পূর্ব বাংলার মুসলমানদের জন্য উন্নয়ন বয়ে আনবে এবং নতুন প্রদেশ গঠিত হলে ঢাকার গুরুত্ব বাড়বে। তিনি ১৯০৪ সালে ব্রিটিশ ভাইসরয় লর্ড কার্জনের সাথে আলোচনার মাধ্যমে প্রস্তাবিত বঙ্গভঙ্গ পরিকল্পনাকে প্রভাবিত করেন, যার ফলে ১৯০৫ সালে পূর্ববঙ্গ ও আসাম নিয়ে একটি নতুন প্রদেশ গঠিত হয় এবং ঢাকা তার রাজধানী হয়। যদিও পরবর্তীতে বঙ্গভঙ্গ রদ করা হয়, যা নবাবকে হতাশ করে, তিনি পূর্ব বাংলার মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ১৯০৫ সালে ব্রিটিশ সরকার বঙ্গভঙ্গ ঘোষণা করলে হিন্দু সমাজ ব্যাপক বিরোধিতা করে। কিন্তু নবাব সলিমুল্লাহ এটিকে বাংলার মুসলিম সমাজের জন্য আশীর্বাদ হিসেবে দেখেন। কারণ পূর্ববঙ্গের মুসলমানরা পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু জমিদার ও অভিজাতদের তুলনায় অনেক পিছিয়ে ছিল। তিনি মনে করতেন, আলাদা পূর্ববঙ্গ-আসাম প্রদেশ প্রতিষ্ঠিত হলে মুসলমানরা বেশি সুযোগ-সুবিধা পাবে এবং প্রশাসনিক ও শিক্ষাগত উন্নয়নের পথ সুগম হবে। তিনি ঢাকায় বঙ্গভঙ্গ সমর্থনে বহু সভা-সমাবেশ করেন এবং মুসলিম সমাজকে সংগঠিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।

অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের জন্ম (১৯০৬)

১৯০৬ সালে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষিতে এবং মুসলিম সমাজের রাজনৈতিক অধিকার রক্ষার্থে ঢাকার নবাববাড়িতেই অনুষ্ঠিত হয় এক ঐতিহাসিক সম্মেলন। এই সম্মেলন থেকেই জন্ম নেয় অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ, যা পরবর্তীকালে পাকিস্তান আন্দোলনের প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। নবাব সলিমুল্লাহ এই সম্মেলনের অন্যতম আয়োজক ও পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তিনি মুসলিম লীগের গঠনে প্রেরণা জুগিয়েছিলেন এবং সংগঠনটির প্রথম সারির নেতাদের মধ্যে ছিলেন।

নবাব সলিমুল্লাহ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

নবাব সলিমুল্লাহর আরেকটি যুগান্তকারী অবদান হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা। নবাব স্যার সলিমুল্লাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য তার নিজের সম্পত্তি থেকে ৬০০ একর জমি দান করেছিলেন, যদিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার জীবদ্দশায় প্রতিষ্ঠিত হয়নি, বরং মৃত্যুর পর এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন ও উদ্বোধন করা হয়। তাঁর নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি আবাসিক হল, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, নামকরণ করা হয়েছে, যা ১৯৩১ সালে উদ্বোধন করা হয়। বঙ্গভঙ্গ রদ (১৯১১) হওয়ার পর মুসলমানরা আবারও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তখন তিনি মুসলমানদের জন্য একটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার দাবি জোরালোভাবে তোলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাথমিক প্রস্তাবনা তাঁরই উদ্যোগে গৃহীত হয় এবং মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি এর প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে গেছেন। তাঁর এই প্রচেষ্টা ১৯৩১ সালে বাস্তব রূপ পায়, যদিও তিনি সেই দিনটি দেখে যেতে পারেননি।

নবাব সলিমুল্লাহর সমাজসেবামূলক কাজ

নবাব সলিমুল্লাহ একজন বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী, রাজনীতিবিদ ও সমাজসেবক ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, যার জন্য তিনি নিজের জমি দান করেছিলেন। এ ছাড়া তিনি মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠায়ও অন্যতম প্রধান ভূমিকা রাখেন এবং শিক্ষা ও জনকল্যাণমুখী কাজের জন্য প্রাদেশিক শিক্ষা সমিতি চালু করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি সামাজিক ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য ঢাকার পঞ্চায়েত পদ্ধতিকে সুসংগঠিত করেন এবং বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।

রাজনীতি ছাড়াও তিনি সমাজকল্যাণে গভীরভাবে যুক্ত ছিলেন। দরিদ্র ও শিক্ষাবঞ্চিত মুসলমানদের জন্য বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন।মাদ্রাসা শিক্ষার উন্নয়নে উদ্যোগ নেন। চিকিৎসা ও দাতব্য কার্যক্রমে নবাববাড়ির সম্পদ ব্যয় করেন। মহিলাদের শিক্ষা প্রসারে ভূমিকা রাখেন তাঁর উদ্যোগে ঢাকা শহরে আধুনিক স্থাপত্য ও সামাজিক পরিসেবার উন্নয়ন ঘটে।

ব্যক্তিত্ব ও জীবনধারা

নবাব সলিমুল্লাহ ছিলেন একজন সুশিক্ষিত, উদারমনা এবং প্রভাবশালী নেতা। তিনি ছিলেন ব্রিটিশ শাসকদের ঘনিষ্ঠ হলেও সবসময় মুসলমানদের উন্নতির প্রশ্নে আপসহীন ছিলেন। তিনি বিলাসবহুল জীবনযাপন করলেও দানশীলতায় ছিলেন অগ্রগণ্য। তাঁর দরবার সর্বদা দরিদ্র ও অভাবীদের জন্য উন্মুক্ত থাকত।

নবাব সলিমুল্লাহ মৃত্যু

রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডের চাপে নবাব সলিমুল্লাহর স্বাস্থ্য দ্রুত অবনতি ঘটে। নবাব সলিমুল্লাহ কলকাতায় তাঁর বাড়িতে অসুস্থ অবস্থায় ১৯১৫ সালের ১৬ জানুয়ারি মাত্র ৪৪ বছর বয়সে তিনি পরলোকগমন করেন। পরের দিন তাঁর মরদেহ ঢাকায় আনা হয়। তাঁকে ঢাকাতেই সমাহিত করা হয়। তাঁর মৃত্যুতে সমগ্র উপমহাদেশের মুসলমান সমাজ শোকাহত হয়।

নবাব সলিমুল্লাহর উত্তরাধিকার

নবাব সলিমুল্লাহর সরাসরি কোনো পুত্র না থাকলেও তাঁর নাতি নবাব খাজা আলী হাসান আসকারী ছিলেন তাঁর উত্তরাধিকারী। তাঁর পরিবার ও উত্তরসূরিরা তাঁর সম্পদ ও জনহিতৈষী কাজ উত্তরাধিকার হিসেবে পেয়েছেন। তিনি নিখিল ভারত মুসলিম লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন, যা তাঁর এক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উত্তরাধিকার। নবাব সলিমুল্লাহর অবদান আজও অম্লান।

তিনি মুসলিম সমাজকে রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত করেন। মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা তাঁর দূরদর্শিতার ফল, যা পাকিস্তান সৃষ্টির পথে প্রথম ধাপ।ঢাকায় উচ্চশিক্ষার ভিত্তি স্থাপন করে তিনি বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত হওয়ার সুযোগ দেন। তিনি প্রমাণ করেছেন, অভিজাত শ্রেণির দায়িত্ব কেবল নিজের বিলাসিতা নয়, জনগণের উন্নয়নে নেতৃত্ব দেওয়া।

নবাব সলিমুল্লাহ কেবল একজন প্রভাবশালী জমিদার বা ব্রিটিশ ঘনিষ্ঠ অভিজাত ছিলেন না; তিনি ছিলেন এক দূরদর্শী সমাজসংস্কারক ও রাজনৈতিক নেতা, যিনি মুসলিম জাতির ভবিষ্যৎ রূপরেখা অঙ্কনে মৌলিক ভূমিকা রেখেছিলেন। তাঁর জীবন ও কর্মকে বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে পাই, তিনি মুসলমানদের সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার রক্ষায় যে পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, তা ছিল সেসময়ের ইতিহাসে এক বিপ্লবাত্মক উদ্যোগ।

বঙ্গভঙ্গের মতো বিতর্কিত ইস্যুতে তিনি দৃঢ়ভাবে মুসলমানদের স্বার্থকে সামনে তুলে ধরেন। যদিও অনেক হিন্দু নেতা এটিকে বিভাজনের রাজনীতি হিসেবে ব্যাখ্যা করেছিলেন, সলিমুল্লাহ উপলব্ধি করেছিলেন যে পূর্ববাংলার দরিদ্র, কৃষিভিত্তিক মুসলমান সমাজের জন্য এটি হবে এক নতুন সুযোগ। তাঁর এই বাস্তববাদী রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি মুসলিম সমাজকে আত্মবিশ্বাসী করে তোলে।

অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের জন্ম তাঁর রাজনৈতিক দূরদর্শিতার সর্বোচ্চ নিদর্শন। পরবর্তী সময়ে পাকিস্তান সৃষ্টির যে আন্দোলন ইতিহাস বদলে দেয়, তার সূচনা বিন্দুই ছিল এই মুসলিম লীগ। যদিও সলিমুল্লাহ নিজে পাকিস্তান আন্দোলন দেখেননি, তাঁর গৃহে অনুষ্ঠিত সেই সভা উপমহাদেশের রাজনৈতিক ভাগ্য নির্ধারণ করে দেয়।

শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁর অবদান সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন তিনি দেখিয়েছিলেন, আর তাঁর সেই প্রচেষ্টা ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাস্তব রূপ পায়। এই প্রতিষ্ঠান পরবর্তী সময়ে শুধু পূর্ববঙ্গের নয়, সমগ্র পূর্ব ভারতের মুসলিম সমাজের জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র হয়ে ওঠে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বাধীনতা সংগ্রামেও এই বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে, যা নবাব সলিমুল্লাহর চিন্তার মহিমাকে আরও তাৎপর্যপূর্ণ করে তোলে।

ব্যক্তিগত জীবনযাপনেও তিনি ছিলেন এক দানশীল, জনকল্যাণমুখী ও বিনয়ী নেতা। নবাব পরিবারের বিলাসিতা সত্ত্বেও তিনি সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়াতেন, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন। তাঁর দরবার ছিল অভাবী মানুষের ভরসাস্থল।

তাঁর অকালপ্রয়াণ মুসলিম সমাজের জন্য এক বিরাট ক্ষতি হলেও তাঁর রেখে যাওয়া উত্তরাধিকার অমর হয়ে আছে। তিনি একদিকে মুসলমানদের আধুনিক শিক্ষার পথে উদ্বুদ্ধ করেছেন, অন্যদিকে রাজনৈতিকভাবে তাদের সংগঠিত করেছেন। ফলে বলা যায়, নবাব সলিমুল্লাহ ছিলেন মুসলিম জাগরণের এক প্রধান স্থপতি, যিনি মুসলিম সমাজকে নতুন দিকনির্দেশনা দিয়ে গেছেন।

আজকের বাংলাদেশ তাঁর কর্মের ফল ভোগ করছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, মুসলিম রাজনৈতিক সচেতনতার ধারাবাহিকতা এবং শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারের ধারা—সবকিছুতেই তাঁর অবদান ছড়িয়ে আছে। নবাব সলিমুল্লাহ আমাদের শিখিয়েছেন, নেতৃত্ব মানে কেবল ক্ষমতার ভোগ নয়; নেতৃত্ব মানে জনগণের স্বার্থরক্ষায় নিরলস সংগ্রাম, দূরদর্শিতা এবং মানবিকতার সমন্বয়। তাঁর জীবন আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা, আর তাঁর অবদান ইতিহাসের অমূল্য সম্পদ।

তথ্যসূত্র

মুজাফফর আহমদ। আমার রাজনৈতিক জীবন। ঢাকা, ১৯৬৯।

আহমদ, রফিকুল ইসলাম। ঢাকা নবাব পরিবার ও নবাব সলিমুল্লাহ। ঢাকা: বাংলা একাডেমি, ১৯৮১।

ইসলাম, স্যারাজুল (সম্পা.)। বাংলাপিডিয়া: জাতীয় বিশ্বকোষ। এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ।

Hardy, Peter. The Muslims of British India. Cambridge University Press, 1972.

Karim, A. K. Nazmul. The Dynamics of Bangladesh Society. Vikas Publishing, 1980.

Ahmed, Rafiuddin. The Bengal Muslims 1871–1906: A Quest for Identity. Oxford University Press, 1981.

Itihasar Golpo
Itihasar Golpohttps://itihasargolpo.com
Step into the past with our unforgettable historical journey. Discover the secrets of history on our captivating journey.
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments