Saturday, October 4, 2025
Homeজীবনীলালন ফকিরের জীবনী

লালন ফকিরের জীবনী

লালন ফকিরের জীবনী

লালন ফকির, যিনি লালন সাঁই বা ফকির লালন শাহ নামেও পরিচিত, ছিলেন ১৮-১৯ শতকের বাংলা সমাজের অন্যতম প্রভাবশালী বাউল সাধক, মানবতাবাদী দার্শনিক ও গণমানুষের কণ্ঠস্বর। তিনি শুধু একজন সংগীতজ্ঞই নন, বরং এক অসাম্প্রদায়িক চেতনার পথপ্রদর্শক, যাঁর গান ও জীবনবোধ বাংলার মাটি ও মানুষের অন্তরকে গভীরভাবে ছুঁয়ে গেছে।

লালনকে বাউল গানের অগ্রদূতদের অন্যতম একজন হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং তার গান উনিশ শতকে বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
লালন ছিলেন একজন মানবতাবাদী সাধক।

যিনি ধর্ম, বর্ণ, গোত্রসহ সকল প্রকার জাতিগত বিভেদ থেকে সরে এসে মানবতাকে সর্বোচ্চ স্থান দিয়েছিলেন। অসাম্প্রদায়িক এই মনোভাব থেকেই তিনি তার গান রচনা করেছেন। তার গানগুলো যুগে যুগে বহু সঙ্গীতশিল্পীর কণ্ঠে লালনের এই গানসমূহ উচ্চারিত হয়েছে। গান্ধীরও ২৫ বছর আগে, ভারত উপমহাদেশে সর্বপ্রথম,তাকে ‘মহাত্মা’ উপাধি দেয়া হয়েছিল।

জন্ম ও পরিচয়

লালনের জন্ম সাল নিয়ে মতভেদ রয়েছে। অধিকাংশ গবেষকের মতে, তিনি ১৭৭২ থেকে ১৭৭৪ সালের মধ্যে বর্তমান কুষ্টিয়া জেলার ছেঁউড়িয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্ম হিন্দু বৈষ্ণব পরিবারে হলেও জীবনের এক কঠিন সময়ে তিনি দিগভ্রান্ত হন এবং পরে এক মুসলিম ফকিরের সান্নিধ্যে এসে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করেন। তীর্থযাত্রার সময় তিনি গুটিবসন্তে আক্রান্ত হয়ে পথের ধারে পরিত্যক্ত হন। এক মুসলিম পরিবারের সহানুভূতিতে তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন। এ ঘটনাই তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয় এবং তিনি সমাজের প্রচলিত জাতপাত, ধর্মীয় সংকীর্ণতা ও কুসংস্কারকে চ্যালেঞ্জ জানাতে শুরু করেন।

সাধনার পথ

সুস্থ হওয়ার পর তিনি গুরু ফকির সিরাজ সাঁইয়ের সান্নিধ্যে আসেন এবং বাউল ধারায় দীক্ষা গ্রহণ করেন। তিনি আত্মবিশ্বাস অর্জন করে কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন এবং সেখানে একটি আখড়া গড়ে তোলেন। এই আখড়াটি আজও বাউলদের তীর্থস্থান হিসেবে বিবেচিত।

গান ও দর্শন

লালনের জীবনের সবচেয়ে শক্তিশালী দিক হলো তাঁর গান। তাঁর রচনার সংখ্যা প্রায় ২,৫০০-৩,০০০টি। যদিও লিখিত দলিল খুব কম পাওয়া যায়, তাঁর শিষ্যরা মৌখিকভাবে এসব গান ছড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁর গানগুলোতে সহজ ভাষায় গভীর দার্শনিকতা প্রকাশ পায়। তিনি মানবদেহকে সাধনার কেন্দ্র হিসেবে দেখতেন। দেহতত্ত্ব, গুরুতত্ত্ব, আত্মা ও ব্রহ্মের মিলন তাঁর গানের মূল প্রতিপাদ্য।

উদাহরণস্বরূপ তাঁর একটি বিখ্যাত গান:

“মন রে, প্রাণসখা যেন পাই তারে,
গোরার রঙে রঙ মিশায়া।।”

লালন ধর্মীয় গোঁড়ামিকে ঘৃণা করতেন। তিনি বলতেন— “মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি”, অর্থাৎ মানবসেবা ও ভালোবাসা-ই প্রকৃত সাধনা। তিনি হিন্দু-মুসলিম ভেদাভেদ, জাতপাতের বিভাজন ও বর্ণবাদের বিরুদ্ধে জোরালোভাবে গানে গানে প্রতিবাদ জানিয়েছেন।

প্রভাব ও উত্তরাধিকার

লালন ফকির ছিলেন একজন সামাজিক চিন্তাবিদ। তাঁর চিন্তা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, এলেন গিন্সবার্গ প্রমুখের উপর গভীর প্রভাব ফেলেছে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর দর্শনে মুগ্ধ হয়ে ঝড়ের দিনে ছেঁউড়িয়ায় এসে তাঁর সঙ্গে দেখা করেছিলেন এবং লালনের গানে দার্শনিক গম্ভীরতা খুঁজে পান।

১৮৯০ সালের ১৭ অক্টোবর লালনের মৃত্যু হয়। তাঁর শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী ছেঁউড়িয়ার আখড়াতে তাঁকে সমাহিত করা হয়। আজও প্রতিবছর তাঁর মৃত্যুর দিনে হাজারো অনুসারী ও দর্শনার্থী তিন দিনব্যাপী উৎসবে অংশ নেন। বাংলাদেশ সরকার লালনের স্মরণে বিশেষ ডাকটিকিট, স্মারক মুদ্রা এবং তথ্যচিত্রও প্রকাশ করেছে।

লালন শুধু একজন গায়ক বা সাধকই ছিলেন না, তিনি ছিলেন বাংলার মাটির প্রান্তিক মানুষের মুক্তির প্রতীক। তাঁর জীবন ও গান বারবার বলে—ধর্ম নয়, মানুষ বড়; জাত নয়, হৃদয় বড়। আজকের সমাজে যেখানে ধর্মীয় ও সামাজিক বিভেদ দিন দিন বাড়ছে, সেখানে লালনের দর্শন যেন একটি আলোর দিশারী।

তথ্যসূত্র:

বাংলা একাডেমি চরিতাভিধান

লালন সাঁইর গানসংগ্রহ (সম্পা: মফিজুল ইসলাম)

বাংলাদেশ বাউল গবেষণা কেন্দ্র (চুয়াড়িয়া, কুষ্টিয়া)

Itihasar Golpo
Itihasar Golpohttps://itihasargolpo.com
Step into the past with our unforgettable historical journey. Discover the secrets of history on our captivating journey.
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments