হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পরিচয়
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী (১৮৯২ – ১৯৬৩) ছিলেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত আইনজীবী, রাজনীতিবিদ ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের এক গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। তিনি গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অগ্রণী সৈনিক, পাকিস্তানের অন্যতম প্রধান নেতা এবং পাকিস্তানের পঞ্চম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর রাজনৈতিক দর্শন ছিল গণতন্ত্র, গণঅধিকার ও ধর্মনিরপেক্ষতার উপর ভিত্তি করে। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি জনগণের স্বাধীনতা ও মর্যাদার জন্য সংগ্রাম করেছেন। তিনি যুক্তফ্রন্ট গঠনের মূলনেতাদের মধ্যে অন্যতম।
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী কে ছিলেন
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন একজন পাকিস্তানি বাঙালি ব্যারিস্টার, রাজনীতিবিদ এবং রাষ্ট্রনায়ক যিনি ১৯৫৬ থেকে ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের পঞ্চম প্রধানমন্ত্রী এবং তার আগে ১৯৪৬থেকে ১৯৪৭সাল পর্যন্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী কোথায় জন্মগ্রহণ করেন ও প্রারম্ভিক জীবন
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ১৮৯২ সালের ৮ সেপ্টেম্বর পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা স্যার জাহিদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি এবং মা খুজিস্তা আখতার বানু ছিলেন শিক্ষিতা ও প্রভাবশালী নারী। পরিবারটি ছিল সংস্কৃতিমনা ও শিক্ষানুরাগী। ফলে ছোটবেলা থেকেই সোহরাওয়ার্দী শিক্ষার প্রতি গভীর আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তিনি কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। পরবর্তীতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনশাস্ত্রে পড়াশোনা করেন এবং প্রথম স্থান অর্জন করে স্বর্ণপদক পান। এরপর তিনি ইংল্যান্ডে যান এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট ক্যাথরিন্স কলেজে পড়াশোনা করেন। সেখান থেকে তিনি জুরিসপ্রুডেন্স ও আইনশাস্ত্রে ডিগ্রি অর্জন করেন। পরে গ্রেজ ইন থেকে ব্যারিস্টারি সম্পন্ন করে দেশে ফিরে আসেন।
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর আইন পেশায় প্রবেশ
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী দেশে ফিরে তিনি কলকাতা হাইকোর্টে আইন পেশা শুরু করেন। তাঁর যুক্তি ও স্পষ্ট বক্তব্য দ্রুতই আইনজীবী মহলে তাঁকে বিশেষ খ্যাতি এনে দেয়। আইনজীবী হিসেবেই তিনি সমাজের নানা স্তরের মানুষের সাথে যোগাযোগ গড়ে তোলেন। এর ফলে তিনি সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্ট ও বাস্তব পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রত্যক্ষ ধারণা লাভ করেন।
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর রাজনীতিতে প্রবেশ
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের মাধ্যমে। তবে অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি মুসলিম লীগে যোগ দেন এবং মুসলিমদের রাজনৈতিক অধিকারের প্রশ্নে সক্রিয় হন। ১৯২৪ সালে তিনি বেঙ্গল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে নির্বাচিত হন। এরপর ধীরে ধীরে তিনি বাংলার মুসলমানদের রাজনৈতিক নেতা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। ১৯৩৭ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে মুসলিম লীগ বাংলায় উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করে এবং এ.কে. ফজলুল হক প্রিমিয়ার হলে সোহরাওয়ার্দী তাঁর মন্ত্রিসভায় গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হন। পরবর্তীতে তিনি নিজেও প্রিমিয়ার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ভাষা আন্দোলনে ভূমিকা
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পূর্ব বাংলার মানুষের অন্যতম বড় দাবি ছিল বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া। এই দাবি দমনের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী দমননীতি গ্রহণ করলে সোহরাওয়ার্দী প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করেন। তিনি যুক্তি দেন, পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ বাংলা ভাষাভাষী, সুতরাং বাংলাকেই রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। তাঁর রাজনৈতিক ভূমিকা ভাষা আন্দোলনকে শক্তিশালী করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দ্বায়িত্ব পালন
১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের নতুন সংবিধান প্রবর্তনের পর গণপরিষদের সদস্যরা সোহরাওয়ার্দীকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত করেন। তাঁর শাসনামলে তিনি গণতন্ত্র, নাগরিক অধিকার এবং জনগণের রাজনৈতিক অংশগ্রহণকে গুরুত্ব দেন। তবে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তাঁর নীতি ও বাঙালি জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গিকে ভালোভাবে গ্রহণ করতে পারেনি। ফলে তাঁর সরকারের ওপর নানা চাপ সৃষ্টি হয়। তবুও তিনি কেন্দ্রীয় সরকারে পূর্ব পাকিস্তানের স্বার্থ প্রতিষ্ঠায় অবিচল ছিলেন।
রাজনৈতিক দর্শন
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর রাজনৈতিক দর্শনের মূল ভিত্তি ছিল—গণতন্ত্র ও জনগণের অধিকার, বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও সাংস্কৃতিক পরিচয় রক্ষা,অর্থনৈতিক সমতা, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সহনশীলতা। তিনি বিশ্বাস করতেন, একটি রাষ্ট্র কেবল তখনই টিকে থাকতে পারে যখন জনগণের প্রকৃত অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়।
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর উক্তি
আমি বরাবরই বাংলার ভবিষ্যৎ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে কল্পনা করে আসছি, কোনরূপ ভারতীয় রাষ্ট্রসংঘের অংশ হিসেবে নয়। অনুরূপ কোন রাষ্ট্র একবার সংস্থাপিত হলে, তার ভবিষ্যৎ নির্ভর করে তার ওপর। … বাংলা যদি মহান হতে চায় তবে সে শুধু তার নিজের পায়ে দাঁড়িয়েই তা হতে পারবে। তাকেই নিজের সম্পদের অধিকারী ও নিজের ভাগ্যের নিয়ন্তা হতে হবে।
বাংলাদেশ (অখণ্ডরূপে) স্বাধীন না হলে বাংলার হিন্দুদের বিশেষ মর্যাদা থাকবে না। (ভারতে) তাদের ভাষা ও কৃষ্টি ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং অন্যান্য প্রদেশ বাংলাদেশকে শোষণ করবে।
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সন্তান ও ব্যক্তিগত জীবন
রাশেদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও ভেরা আলেক্সান্দ্রভনা ট্রিসেঙ্কোর সন্তান। তিনি পড়াশোনা করেছেন চার্টার হাউস অক্সফোর্ড এবং লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে।তিনি রয়েল একাডেমি অব ড্রামাটিক আর্ট থেকে পড়াশোনা করে অভিনয় পেশায় যোগ দেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে ছিলেন। তিনি ১৯৭১ সালের ৭ অক্টোবর বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রতি তার সমর্থনের কথা জানিয়ে অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের নিকট একটি পত্র লেখেন যা পরবর্তীতে সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। রাশেদ সোহরাওয়ার্দী ২০১৯ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি ৭৯ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ব্যক্তিজীবনে ছিলেন সাদাসিধে ও মুক্তচিন্তার মানুষ। তিনি সাহিত্য, সংগীত ও সংস্কৃতির প্রতি গভীর অনুরাগী ছিলেন। তাঁর ভাষণ ছিল অত্যন্ত প্রাঞ্জল ও যুক্তিসঙ্গত, যা মানুষের হৃদয় স্পর্শ করত।
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর কারাবাস ও রাজনৈতিক সংগ্রাম
পাকিস্তানের সামরিক শাসক আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল করলে গণতন্ত্রকামী সোহরাওয়ার্দী তাঁকে প্রকাশ্যে চ্যালেঞ্জ করেন। এর ফলস্বরূপ ১৯৬২ সালে তাঁকে কারারুদ্ধ করা হয়। কিন্তু জনমতের চাপে সরকার তাঁকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যু
স্বাস্থ্যগত সমস্যার কারণে তিনি ১৯৬৩ সালে দেশের বাইরে যান এবং লেবাননের রাজধানী বৈরুতে অবস্থানকালে ৫ ডিসেম্বর ১৯৬৩ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। পরে তাকে ঢাকায় আনা হয় ও ৮ ডিসেম্বর রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে) তার জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজা শেষে তাকে ঢাকা হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে শেরেবাংলা একে ফজলুল হকের কবরের পাশে সমাহিত করা হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর রমনা রেসকোর্স নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়েছিল সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। ১৯৬৩ সালের ৫ ডিসেম্বর বৈরুতের একটি হোটেল কক্ষে তিনি আকস্মিক মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুকে অনেকেই রহস্যজনক মনে করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭১ বছর। তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে দাফন করা হয়।
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী শুধু একজন রাজনীতিবিদই ছিলেন না, তিনি ছিলেন জনগণের কণ্ঠস্বর, এক নির্ভীক সংগ্রামী এবং গণতান্ত্রিক চেতনার প্রতীক। তাঁর জীবনের প্রতিটি অধ্যায় একেকটি শিক্ষা দেয়—যেখানে সাহস, প্রজ্ঞা এবং দেশপ্রেমের মিশ্রণ ছিল স্পষ্ট। তিনি জানতেন, কেবল স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের মধ্যেই জনগণের মুক্তি নিহিত নয়, বরং সেই রাষ্ট্রে গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার, অর্থনৈতিক সমতা ও সাংস্কৃতিক মর্যাদার নিশ্চয়তাই প্রকৃত মুক্তি এনে দিতে পারে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পূর্বপটভূমি বোঝার জন্য হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ভূমিকা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ভাষা আন্দোলনে তাঁর প্রকাশ্য সমর্থন এবং পূর্ব পাকিস্তানের স্বার্থ রক্ষায় দৃঢ় অবস্থান ভবিষ্যতে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি সুদৃঢ় করে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর সময়কাল দীর্ঘ না হলেও, সেই সময়ে তিনি যে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও জনগণের অংশগ্রহণের উপর জোর দেন, তা পাকিস্তানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে পরবর্তী আন্দোলনের জন্য শক্তিশালী ভিত্তি তৈরি করে।
তাঁর মৃত্যুকে আজও অনেকেই রহস্যজনক মনে করেন, তবে এটি অস্বীকার করার উপায় নেই যে, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি ছিলেন জনগণের নেতা। তাঁর অনুপস্থিতি বাঙালি রাজনীতিতে একটি বিশাল শূন্যতা তৈরি করেছিল। তবে তাঁর রোপিত বীজ থেকেই পরবর্তীতে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাঙালি জাতীয়তাবাদ আরও সুসংহত হয়ে ওঠে এবং অবশেষে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে।
আজকের দিনে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর জীবন আমাদের জন্য প্রেরণা। গণতন্ত্র যখন বিপন্ন হয়, তখন তাঁর দৃঢ় অবস্থান আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে জনগণের অধিকার রক্ষা করা নেতার প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব। রাজনৈতিক মতাদর্শ যাই হোক না কেন, ন্যায় ও সত্যের পথে অবিচল থাকা একজন নেতার প্রকৃত পরিচয়।
অতএব বলা যায়, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন উপমহাদেশের ইতিহাসে এক আলোকবর্তিকা, যিনি গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং সাংস্কৃতিক পরিচয়ের প্রশ্নে আপসহীন ছিলেন। তাঁর সংগ্রামী জীবন ও কর্ম শুধু ইতিহাসের পাতায় সীমাবদ্ধ নয়, বরং আগামী প্রজন্মের জন্য পথনির্দেশক হিসেবে চিরকাল বেঁচে থাকবে।
তথ্যসূত্র
আহমদ সাফা, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস
মোজাফফর হোসেন, সোহরাওয়ার্দীর জীবন ও কর্ম
সেলিনা হোসেন, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী
বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষদ প্রকাশনা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর্কাইভ