হাজী শরীয়ত উল্লাহর পরিচয়
হাজী শরীয়ত উল্লাহ (১৭৮১-১৮৪০) ধর্মীয় সংস্কারক, নীলকর ও সামন্তবাদ বিরোধী নেতা এবং ভারতবর্ষে সংঘটিত ফরায়েজি আন্দোলনের মুখপাত্র। তিনি শুধু ধর্মীয় সংস্কারক ছিলেন না, বরং কৃষক, তাঁতি এং অন্যান্য শ্রমজীবী মানুষকে শোষণ থেকে মুক্ত করার জন্য সংস্কার আন্দোলন পরিচালনা করেছিলেন। বাংলার ইতিহাসে ইসলামি সংস্কার আন্দোলনের ক্ষেত্রে উনিশ শতক এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। এই সময় মুসলমান সমাজ নানা কুসংস্কার, অজ্ঞতা, হিন্দু-মুসলিম সংস্কৃতির মিশ্রণে গড়ে ওঠা অনুশীলন ও ঔপনিবেশিক শাসনের শোষণের মধ্যে নিমজ্জিত ছিল। ঠিক তখনই হাজী শরীয়ত উল্লাহ (১৭৮১–১৮৪০) মুসলমানদের আত্মসচেতনতা জাগ্রত করার জন্য ফরায়েজি আন্দোলনের সূচনা করেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল কোরআন-সুন্নাহর ভিত্তিতে মুসলিম সমাজকে পুনর্গঠন করা, অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া এবং মুসলমানদের আত্মপরিচয় ফিরিয়ে দেওয়া।
হাজী শরীয়ত উল্লাহ কে ছিলেন
হাজী শরীয়ত উল্লাহ ছিলেন পূর্ব উপমহাদেশের বাংলার একজন বিশিষ্ট ধর্মীয় নেতা এবং ইসলামী পন্ডিত,যিনি ফরায়েজি আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে সর্বাধিক পরিচিত। ১৮৮৪ সালে, শরীয়তপুর জেলা গঠিত হয় এবং তার নামে নামকরণ করা হয়।
হাজী শরীয়ত উল্লাহ কোথায় জন্মগ্রহণ করেন
হাজী শরীয়ত উল্লাহ ১৭৮১ সালে ফরিদপুরের মাদারীপুর জেলার তৎকালীন মহকুমাধীন শ্যামাইল গ্রামে (বর্তমানে শরীয়তপুর জেলার অন্তর্ভুক্ত) জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন একজন ইসলামি ধর্মীয় সংস্কারক এবং ফরায়েজি আন্দোলনের প্রবর্তক।
হাজী শরীয়ত উল্লাহর প্রারম্ভিক জীবন
১৭৮১ সালে বাংলাদেশের মাদারীপুর জেলার মহকুমাধীন শ্যামাইল(বর্তমানে শিবচর উপজেলার বাহাদুরপুর গ্রাম) গ্রামে একটি তালুকদার পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ছিলেন আবদ আল-জলিল তালুকদার, যিনি একজন কৃষক ও সীমিত সম্পদের জমির মালিক ছিলেন। পরিবারটি ছিল দরিদ্র, কৃষিনির্ভর এবং ধর্মবিশ্বাসে দৃঢ়। ছোটবেলা থেকেই তিনি মেধাবী ও ধর্মপরায়ণ ছিলেন। শিশু বয়সে তিনি প্রাথমিক শিক্ষালাভ করেন স্থানীয় মক্তবে। পরবর্তীতে উন্নত শিক্ষার জন্য কলকাতায় যান এবং সেখানে আরবি, ফারসি ও ইসলামি শিক্ষার প্রতি গভীর আগ্রহী হয়ে ওঠেন। পরবর্তীতে তিনি ইসলামি বিদ্যা অর্জনের উদ্দেশ্যে আরব ভ্রমণের সিদ্ধান্ত নেন।
হাজী শরীয়ত উল্লাহর মক্কা যাত্রা ও শিক্ষা
হাজী শরীয়ত উল্লাহ ১৭৯৯ সালে মক্কায় যান এবং প্রায় ২০ বছর সেখানে অবস্থান করেন। মক্কায় তিনি আরবি, ফারসি, এবং ধর্মীয় বিষয়ে গভীর জ্ঞান অর্জন করেন এবং মাওলানা মুরাদের মতো বিখ্যাত আলেমদের কাছে ফিকাহ (ইসলামি আইনশাস্ত্র) ও অন্যান্য বিষয় অধ্যয়ন করেন। তাঁর এই শিক্ষা পরবর্তীকালে বাংলাদেশে ফরায়েজি আন্দোলনের ভিত্তি স্থাপন করে, যা ধর্মীয় সংস্কারের পাশাপাশি কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষের শোষণ মুক্তির জন্য পরিচালিত হয়েছিল। তিনি মক্কার বিভিন্ন বিখ্যাত আলেম ও শিক্ষকের কাছে শিক্ষা লাভ করেন। ফিকাহ (ইসলামি আইনশাস্ত্র) এবং সাহিত্য অধ্যয়নের মাধ্যমে তাঁর পাণ্ডিত্য বাড়ে। তিনি ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রতি আকৃষ্ট হন, যা তাঁর সংস্কারক চিন্তাভাবনাকে আরও প্রভাবিত করে।
মক্কায় অর্জিত জ্ঞান ও সংস্কারমূলক ধারণাগুলো হাজী শরীয়ত উল্লাহ বাংলায় ফিরে আসার পর ফরায়েজি আন্দোলনের সূচনা করে। আরব উপদ্বীপে মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওয়াহাব পরিচালিত সংস্কার আন্দোলন মুসলমানদের মধ্যে শিরক, বিদআত ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছিল। হাজী শরীয়ত উল্লাহ এই চিন্তাধারাকে নিজের মনে ধারণ করেন। ১৮১৮ সালে তিনি বাংলায় প্রত্যাবর্তন করেন। ফিরে এসে তিনি লক্ষ্য করেন যে, বাংলার মুসলমান সমাজ হিন্দু সংস্কৃতির প্রভাব ও স্থানীয় কুসংস্কারের কারণে প্রকৃত ইসলামী জীবনধারা থেকে অনেকটাই বিচ্যুত হয়েছে। তখন তিনি সংস্কার আন্দোলনের উদ্যোগ নেন।
হাজী শরীয়ত উল্লাহর ফরায়েজি আন্দোলন
বাংলায় ফিরে এসে হাজী শরীয়ত উল্লাহ “ফরায়েজি আন্দোলন” শুরু করেন। “ফরায়েজ” অর্থ হলো ইসলামে ফরজ বা আবশ্যকীয় কাজ। তিনি মুসলমানদেরকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, রোজা, হজ, যাকাতসহ সব ফরজ কাজ পালন করার জন্য আহ্বান জানাতে থাকেন। হাজী শরীয়ত উল্লাহ ছিলেন ফরায়েজি আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা এবং একজন ধর্মীয় সংস্কারক। ১৮১৮ সালে পূর্ব বাংলায় এই আন্দোলনের সূচনা হয়, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল Muslims দের মধ্যে ইসলামের ফরজ (বাধ্যতামূলক) বিধানগুলো পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা এবং অনৈসলামিক প্রথা বর্জন করা। পরবর্তীতে এই আন্দোলন জমিদার ও নীলকরদের শোষণ থেকে কৃষকদের মুক্তি দেওয়ার সামাজিক ও অর্থনৈতিক রূপ লাভ করে আন্দোলনটি মূলত ধর্মীয় সংস্কারের মাধ্যমে বাংলার মুসলমানদের ইসলামের মূল নীতির দিকে ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্যে শুরু হয়েছিল।
তিনি যে প্রধান বিষয়গুলোর বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেছিলেন সেগুলো হলো:
বিদআত – ধর্মে নতুনভাবে যুক্ত অযৌক্তিক আচার-অনুষ্ঠান।
শিরক – আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও উপাসনা বা সাহায্য প্রার্থনা।
অশুদ্ধ রীতি – হিন্দু প্রথা ও লোকাচারের অনুকরণ।
কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস – পীরপন্থা, দরগাহপূজা, মাজারের চাদর ও অর্পণ ইত্যাদি।
তাঁর আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল ধর্মীয় সংস্কারের পাশাপাশি, এই আন্দোলন কৃষক, তাঁতি এবং অন্যান্য শ্রমজীবী মানুষকে ব্রিটিশ ও জমিদারদের শোষণ ও নিপীড়ন থেকে মুক্ত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করে।
ফরায়েজি আন্দোলনের বিস্তার
হাজী শরীয়ত উল্লাহর হাত ধরে বাংলায় শুরু হওয়া ফরায়েজী আন্দোলনের বিস্তার ছিল মূলত ধর্মীয় সংস্কার থেকে শুরু করে সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপান্তর। ১৮১৮ সালে এর সূচনা হয় এবং ফরিদপুর ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলকে কেন্দ্র করে এর বিস্তার ঘটে। এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল অনৈসলামিক প্রথা বর্জন করা, ইসলামের মূলনীতি অনুসরণ করা, এবং ব্রিটিশ নীলকর ও জমিদারদের শোষণ থেকে কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষকে মুক্তি দেওয়া। হাজী শরীয়ত উল্লাহ প্রথমে ফরিদপুর, মাদারীপুর, বরিশাল অঞ্চলে তাঁর আন্দোলন শুরু করেন। খুব দ্রুত এটি বাংলার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। কৃষক শ্রেণি তাঁর আন্দোলনের প্রধান সমর্থক হয়ে ওঠে। তিনি কৃষকদের বোঝান যে, জমিদার ও ব্রিটিশ শাসকের অত্যাচার মেনে নেওয়া ইসলামের শিক্ষা নয়। ফলে ফরায়েজি আন্দোলন কেবল ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং সামাজিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির আন্দোলনেও পরিণত হয়।
হাজী শরীয়ত উল্লাহর শিক্ষা ও দর্শন
হাজী শরীয়ত উল্লাহর দর্শন ছিল মূলত ইসলামি মৌলিক বিধিবিধান (ফরজ) পালনের উপর জোর দেওয়া, যার মাধ্যমে তিনি মুসলমানদের ধর্মীয় ও সামাজিক কুসংস্কার থেকে মুক্ত করে ইসলামের মূলধারায় ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলেন। তার শিক্ষা ও দর্শন ছিল ফরায়েজি আন্দোলনের মূল ভিত্তি, যা কেবল ধর্মীয় সংস্কারই নয়, বরং ব্রিটিশ শাসনামলে কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষের অর্থনৈতিক ও সামাজিক শোষণ থেকে মুক্তি এবং সামন্তবাদ বিরোধী একটি সামাজিক আন্দোলনের রূপ নিয়েছিল। হাজী শরীয়ত উল্লাহর শিক্ষার মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল কোরআন ও হাদিস। তাঁর মতে, ইসলামকে বুঝতে হলে মূলে ফিরতে হবে। তিনি কিছু গুরুত্বপূর্ণ নীতি প্রচার করেছিলেন:
মুসলমানদের অবশ্যই ফরজ কাজগুলো যথাযথভাবে পালন করতে হবে।
মুসলমানরা এক আল্লাহর উপাসনা করবে; শিরক বা বিদআতের স্থান নেই।
ইসলামের নামে হিন্দু প্রথা অনুসরণ করা যাবে না।
ঔপনিবেশিক শাসকের অন্যায় ও জমিদারদের শোষণের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে।
মুসলমানদের সামাজিক ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ব বজায় রাখতে হবে।
ফরায়েজি আন্দোলনের বিরোধিতা ও প্রতিবন্ধকতা
ফরায়েজি আন্দোলনের বিরোধিতা ও প্রতিবন্ধকতার মধ্যে প্রধান ছিল ব্রিটিশ সরকার ও হিন্দু জমিদারদের ক্ষমতা ও শোষণের বিরুদ্ধে আন্দোলনকে দমন করার চেষ্টা এবং আন্দোলনের নেতৃত্ব সংকট, বিশেষ করে দুদু মিয়ার মৃত্যুর পর আন্দোলনের দুর্বল হয়ে পড়া। আন্দোলনে যোগ্য নেতৃত্বের অভাব ও ব্রিটিশ সরকারের দমন-পীড়ন ছিল মূল প্রতিবন্ধকতা যা শেষ পর্যন্ত আন্দোলনকে দুর্বল করে দেয়। ব্রিটিশ সরকার ফরায়েজি আন্দোলনকে নিজেদের ঔপনিবেশিক শাসনের জন্য হুমকি হিসেবে দেখত এবং আন্দোলনকে দমন করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে। তারা দুদু মিয়াকে রাজনৈতিক বন্দী হিসেবে আটক করে এর তীব্রতা কমানোর চেষ্টা করেছিল। হিন্দু জমিদার ও ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী উভয়েই ফরায়েজি আন্দোলনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। এছাড়া মুসলমান সমাজের কিছু প্রভাবশালী মৌলভীও তাঁর বিরুদ্ধে দাঁড়ান। কারণ হাজী শরীয়ত উল্লাহ তাদের প্রচলিত রীতি-নীতি ও দরগাহপূজার মতো প্রথার বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু এসব বাধা সত্ত্বেও তিনি আন্দোলন চালিয়ে যান।
উত্তরাধিকার ও নেতৃত্ব
১৮৪০ সালে হাজী শরীয়ত উল্লাহ মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র দুদু মিয়া (মুহসিন উদ্দিন আহমদ) ফরায়েজি আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। দুদু মিয়ার নেতৃত্বে আন্দোলন আরও সংগঠিত হয়ে ওঠে এবং কৃষক অধিকারের আন্দোলন হিসেবে তীব্র আকার ধারণ করে।ফরায়েজি আন্দোলনের প্রভাব উনিশ শতক ও বিশ শতকের শুরু পর্যন্ত টিকে ছিল। এটি মুসলমান সমাজে এক নতুন আত্মসচেতনতা তৈরি করে, যা পরবর্তীতে পাকিস্তান আন্দোলন ও মুসলমান জাতিসত্তার বিকাশে ভূমিকা রাখে।
ফরায়েজি আন্দোলনের প্রভাব ও গুরুত্ব
ফরায়েজি আন্দোলনের প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী; এটি বাংলায় ধর্মীয় সংস্কার ও সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করে, কৃষকদের শোষণ থেকে মুক্তি দিয়ে তাদের সংগঠিত করে এবং জমিদার ও নীলকরদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের পথ খুলে দেয়, যা বাংলার সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
হাজী শরীয়ত উল্লাহর জীবন ও আন্দোলনের গুরুত্ব কয়েকভাবে ব্যাখ্যা করা যায়:
ধর্মীয় প্রভাব – মুসলমান সমাজকে কোরআন-হাদিসভিত্তিক জীবনধারায় ফিরিয়ে আনা।
সামাজিক প্রভাব – মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য সৃষ্টি এবং কুসংস্কার থেকে মুক্তির চেষ্টা।
অর্থনৈতিক প্রভাব – কৃষক শ্রেণির মধ্যে শোষণবিরোধী মনোভাব জাগিয়ে তোলা।
রাজনৈতিক প্রভাব – ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের জন্য ভিত্তি তৈরি।
শিক্ষাগত প্রভাব – ইসলামী শিক্ষার পুনর্জাগরণ এবং সমাজকে আধুনিক চিন্তার দিকে আহ্বান।
হাজী শরীয়ত উল্লাহর নাম শুধু একটি ব্যক্তির নাম নয়; তিনি এক যুগের প্রতিচ্ছবি, যিনি অন্ধকারাচ্ছন্ন মুসলিম সমাজে আলোকবর্তিকা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। বাংলার মুসলমানরা তখন রাজনৈতিকভাবে পরাধীন, সামাজিকভাবে বিভক্ত, অর্থনৈতিকভাবে শোষিত এবং ধর্মীয়ভাবে কুসংস্কারে নিমজ্জিত ছিল। ঠিক এই সময়ে তিনি মক্কায় দীর্ঘ শিক্ষা ও সাধনার মাধ্যমে আত্মপ্রস্তুতি গ্রহণ করে ফিরে আসেন, এবং দেশবাসীর সামনে ইসলামের মৌলিক শিক্ষার সত্যিকার রূপ উন্মোচন করেন।
তাঁর আন্দোলন মূলত মুসলমানদের আত্মপরিচয় ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা। তিনি শিখিয়েছিলেন যে, মুসলমানকে প্রকৃত মুসলমান হতে হলে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা.)-এর নির্দেশিত পথে চলতে হবে, ফরজ আমলগুলো পালন করতে হবে, এবং অন্ধবিশ্বাস ও বিদআত থেকে মুক্ত থাকতে হবে। এ শিক্ষার মধ্যে কেবল ধর্মীয় শুদ্ধিই ছিল না; এর মধ্যে লুকিয়ে ছিল সামাজিক মুক্তি, ন্যায়বিচার ও সাম্য প্রতিষ্ঠার বীজ।
ফরায়েজি আন্দোলন কৃষকদের আত্মমুক্তির সংগ্রামে পরিণত হয়, যা জমিদারী শোষণ ও ঔপনিবেশিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। হাজী শরীয়ত উল্লাহ নিজে কখনো রাজনৈতিক বিপ্লবী হিসেবে পরিচিত না হলেও তাঁর আন্দোলন মুসলমান সমাজে রাজনৈতিক চেতনার ভিত্তি স্থাপন করে। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর উত্তরসূরিরা আন্দোলন চালিয়ে গেছেন, কিন্তু মূল ভিত্তি গড়ে দিয়েছিলেন তিনি নিজেই।
অতএব, হাজী শরীয়ত উল্লাহ ছিলেন বাংলার মুসলিম সমাজের পুনর্জাগরণের প্রথম সোপান নির্মাতা। তাঁর ফরায়েজি আন্দোলন কেবল উনিশ শতকের আন্দোলন নয়; এটি ছিল বাংলার মুসলমানদের আত্মমর্যাদা, আত্মপরিচয় ও আত্মসচেতনতার সূচনাপর্ব। তাই তিনি ইতিহাসে একজন মহান সংস্কারক, সমাজদ্রষ্টা এবং জাতিসত্তার জাগরণের স্থপতি হিসেবে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন।
তথ্যসূত্র
আবুল কাশেম, বাংলার সমাজ সংস্কার আন্দোলন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনী।
রফিকুল ইসলাম, বাংলাদেশের ইতিহাস, মুক্তধারা।
সাইফুদ্দীন আহমদ, ফরায়েজি আন্দোলন, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ।
আহমদ শরীফ, বাংলার চিন্তার ইতিহাস, চট্টগ্রাম প্রকাশনী।