Friday, October 3, 2025
Homeজীবনীড মুহম্মদ শহীদুল্লাহর জীবনী

ড মুহম্মদ শহীদুল্লাহর জীবনী

ড মুহম্মদ শহীদুল্লাহর জীবনী

বাংলা ভাষা ও সাহিত্য, দর্শন, ইতিহাস, সংস্কৃতি ও বহুভাষা-অধ্যয়নে যাঁরা অবিস্মরণীয় অবদান রেখেছেন, তাঁদের মধ্যে ড মুহম্মদ শহীদুল্লাহ (১৮৮৫–১৯৬৯) সর্বাগ্রে স্থান অধিকার করে আছেন। তিনি ছিলেন আধুনিক বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মনীষী, যিনি একাধারে শিক্ষক, গবেষক, ভাষাবিদ, আইনজ্ঞ, শিক্ষানুরাগী, লেখক ও দার্শনিক। তাঁর জ্ঞানপিপাসা ছিল সীমাহীন এবং জীবনব্যাপী তিনি জ্ঞানের সাধনায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন।

ড মুহম্মদ শহীদুল্লাহ কে ছিলেন

ড মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের একজন প্রখ্যাত বাঙালি ভাষাবিদ, দার্শনিক, শিক্ষাবিদ ও লেখক, যিনি ১০ জুলাই ১৮৮৫ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনার পেয়ারা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৩ জুলাই ১৯৬৯ সালে মারা যান। তিনি বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন, ভাষা আন্দোলনে ভূমিকা রাখেন এবং “আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি” – এই উক্তিটির মাধ্যমে বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনাকে তুলে ধরেন। বহুভাষী এই মনীষী ২৪টিরও বেশি ভাষা জানতেন এবং ভাষাতত্ত্ব ও বাংলা সাহিত্যের গবেষণায় অদ্বিতীয় অবদান রাখেন।

ড মুহম্মদ শহীদুল্লাহর শৈশব ও পারিবারিক পটভূমি

ড মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ১৮৮৫ সালের ১০ জুলাই চব্বিশ পরগনার (বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ, ভারত) ২৪ পরগনা জেলার পেয়ারা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ড মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ এর পিতার নাম মফিজউদ্দীন আহমদ। তিনি মধ্যযুগীয় পীর গোরাচাঁদের দরবার শরিফের খাদেম ছিলেন। মাতা ছিলেনহুরুন্নেসা। তিনি ছিলেন একজন সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের গৃহিণী, যিনি সন্তানকে নৈতিকতা ও মানবিক গুণাবলিতে গড়ে তুলতে ভূমিকা রাখেন। ছেলেবেলা থেকেই তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী, কৌতূহলী এবং অধ্যবসায়ী, গ্রামীণ পরিবেশে বেড়ে ওঠা ড মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ প্রাথমিক শিক্ষায় অসাধারণ কৃতিত্ব অর্জন করেছিলেন।

ড মুহম্মদ শহীদুল্লাহর শিক্ষাজীবন

ড মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তাঁর শিক্ষাজীবনে প্রাথমিক পড়াশোনার পর হাওড়া জেলা স্কুলে ভর্তি হন এবং ১৯০৪ সালে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন এবং ১৯০৬ সালে এফ.এ পাশ করেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯১২ সালে তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ড মুহম্মদ শহীদুল্লাহর শিক্ষাজীবন ছিল বৈচিত্র্য ও দীপ্তিময়। ভাষার প্রতি গভীর অনুরাগ থেকে তিনি সংস্কৃত, ফার্সি, ফরাসি ও ইংরেজি ভাষায় বিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠেন। কিন্তু তাঁর জ্ঞানতৃষ্ণা এখানেই শেষ হয়নি। তিনি প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য যান। সেখানে ১৯২৮ সালে তিনি পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল “Contribution à l’Histoire du Charya-pada” অর্থাৎ “চর্যাপদের ইতিহাসে অবদান”। এটি বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন নিয়ে এক যুগান্তকারী গবেষণা।

ড মুহম্মদ শহীদুল্লাহর কর্মজীবন

শিক্ষাজীবন শেষে ড মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করেন।

আইন পেশা – ডিগ্রি অর্জনের পর তিনি কিছুদিন আইন পেশায় যুক্ত ছিলেন। তবে তাঁর আসল আগ্রহ ছিল শিক্ষকতা ও গবেষণায়।

শিক্ষকতা – তিনি প্রথমে কলকাতার আলিয়া মাদরাসায় শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ও সংস্কৃত বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ পান।

প্রশাসনিক কাজ – তিনি বহু শিক্ষা কমিশন, একাডেমি ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

ড মুহম্মদ শহীদুল্লাহর গবেষণা ও সাহিত্যকর্ম

ড মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ছিলেন একজন স্বনামধন্য ভাষাবিদ, ভাষাতত্ত্ববিদ, শিক্ষাবিদ, গবেষক এবং লেখক, যিনি বাংলা ভাষার গবেষণা ও সাহিত্যকর্মে অসামান্য অবদান রেখেছেন। তাঁর গবেষণার মধ্যে বাংলা ভাষার প্রাচীন নিদর্শন চর্যাপদ নিয়ে কাজ এবং গৌড়ী বা মাগধী প্রাকৃত থেকে বাংলা ভাষার উৎপত্তির প্রমাণ অন্যতম। তাঁর উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্মের মধ্যে রয়েছে বাংলা ব্যাকরণ, ভাষা-বিষয়ক প্রবন্ধ, সমালোচনা এবং চর্যাপদ বিষয়ক গবেষণা ও অনুবাদ গ্রন্থ। শহীদুল্লাহর রচনা ও গবেষণা বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও ইতিহাসে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।

ড মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর মতে চর্যাপদের ভাষা

ড মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর মতে চর্যাপদের ভাষা হলো বঙ্গকামরূপী বা বঙ্গ-কামরূপী ভাষা। তিনি এই ভাষাকে বাংলা ও কামরূপীর (অসমীয়া ও বাংলা উপভাষা) মিশ্রণ হিসেবে অভিহিত করেছেন। বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন চর্যাপদ তিনি গভীরভাবে অধ্যয়ন করেন। তাঁর গবেষণা বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন উৎস নির্ধারণে বৈপ্লবিক অবদান রেখেছে।

ড মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ কয়টি ভাষা জানতেন

ড মুহম্মদ শহীদুল্লাহ প্রায় ২৪টি ভাষা জানতেন এবং এর মধ্যে ১৮টি ভাষায় তিনি সুপণ্ডিত ছিলেন। তিনি বাংলা, উর্দু, ফার্সি, আরবি, ইংরেজি, ফরাসি, অসমীয়া, ওড়িয়া, মৈথিলী, হিন্দি, পাঞ্জাবি, গুজরাটি, মারাঠি, কাশ্মীরি, নেপালি, সিংহলী, তিব্বতি, সিন্ধি, সংস্কৃত, পালি ইত্যাদি অনেক ভাষা আয়ত্ত করেছিলেন। এছাড়াও তিনি ল্যাটিন, গ্রিক ও জার্মান ভাষা জানতেন।

ড মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর প্রধান গ্রন্থসমূহ

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, বাংলাভাষার ইতিবৃত্ত, মুসলিম সাহিত্য ও সংস্কৃতি, সংক্ষিপ্ত বাঙলা ব্যাকরণ, চর্যাপদ বিষয়ক গবেষণা, বৈষ্ণব পদাবলী সংকলন

ড মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ উক্তি

ড মুহম্মদ শহীদুল্লাহর দুটি উল্লেখযোগ্য উক্তি হলো: “আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি” এবং “যে জাতি তার ভাষাকে শ্রদ্ধা করে না, সে জাতির উন্নয়ন সম্ভব নয়”। এই উক্তিগুলো বাঙালি সত্তা এবং ভাষা আন্দোলনের প্রতি তাঁর গভীর চেতনা ও গুরুত্বকে তুলে ধরে।

ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি অবদান

ড মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ভাষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে একজন অগ্রণী ভাষাবিদ, শিক্ষাবিদ এবং লেখক ছিলেন। তিনি বাংলা ভাষার উৎপত্তি ও বিবর্তন নিয়ে মৌলিক গবেষণা করেন, চর্যাপদ নিয়ে ডক্টরেট অর্জন করেন এবং ভাষা আন্দোলনের সময় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে জোরালো বক্তব্য দেন। তিনি বহুভাষাবিদ ছিলেন, বাংলাসহ মোট ২৪টি ভাষা আয়ত্ত করেন এবং বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতি ও লোকবিজ্ঞানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। ড মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বাংলা ভাষাকে আন্তর্জাতিক মানে প্রতিষ্ঠিত করার স্বপ্ন দেখেছিলেন। পাকিস্তান আমলে যখন শাসকগোষ্ঠী উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করতে চাইল, তখন তিনি যুক্তি ও প্রমাণের মাধ্যমে বাংলা ভাষার প্রাচীনতা ও সমৃদ্ধি তুলে ধরেন। তাঁর অন্যতম অবদান হলো ভাষার শিকড় খুঁজে বের করা এবং বাংলা ভাষাকে আরবি-ফার্সি ও সংস্কৃত প্রভাব থেকে আলাদা করে নিজস্ব ঐতিহ্য তুলে ধরা।

ড মুহম্মদ শহীদুল্লাহর শিক্ষাদর্শন

ড মুহম্মদ শহীদুল্লাহর শিক্ষাদর্শন ছিল মূলত ভাষা, সংস্কৃতি ও বাঙালি সত্তার উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা এক গভীর মননশীল ও প্রগতিশীল দর্শন। তাঁর মতে, মানুষের প্রথম পরিচয় বাঙালি সত্তা, যা ধর্ম-বর্ণের ঊর্ধ্বে। এই চেতনাকে লালন করার জন্য তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের চর্চাকে অপরিহার্য মনে করতেন এবং ভাষা আন্দোলনের প্রতি সমর্থন যুগিয়েছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, শিক্ষাব্যবস্থায় স্থানীয় ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং জনগণের নিজস্বতা প্রতিফলিত হওয়া উচিত, যা গ্রামীণ মানুষের সংস্কৃতিকেও গুরুত্ব দেয়। ড মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বিশ্বাস করতেন, শিক্ষা হলো মানুষের আত্মিক ও নৈতিক উন্নয়নের প্রধান মাধ্যম। তাঁর শিক্ষাদর্শন ছিল—মাতৃভাষাভিত্তিক শিক্ষা, জ্ঞানচর্চার স্বাধীনতা, ধর্মীয় সহিষ্ণুতা, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সমন্বয়।

পুরস্কার ও স্বীকৃতি

ড মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তার কর্মজীবনের স্বীকৃতিস্বরূপ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেছেন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো পাকিস্তান সরকার প্রদত্ত ‘প্রাইড অফ পারফরমেন্স’ ও ‘হিলাল-ই-ইমতিয়াজ’ (মরণোত্তর), ফ্রান্স সরকার কর্তৃক ‘নাইট অফ দি অর্ডারস অফ আর্টস অ্যান্ড লেটার্স’, ঢাকা সংস্কৃত পরিষদ কর্তৃক ‘বিদ্যাবাচস্পতি’ উপাধি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ‘এমেরিটাস অধ্যাপক’ পদ, এবং বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ‘স্বাধীনতা পদক’ (মরণোত্তর) ও একুশে পদক (মরণোত্তর)। এছাড়াও, তিনি ২০০৪ সালে বিবিসি বাংলার একটি জরিপে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালির তালিকায় স্থান করে নেন। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ, বাংলা একাডেমিসহ অসংখ্য প্রতিষ্ঠান তাঁকে সম্মানিত করে। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁকে “জাতির মনীষী” হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

ব্যক্তিজীবন

ড মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ছিলেন একজন বাঙালি বহুভাষাবিদ, ভাষাবিদ, শিক্ষাবিদ, গবেষক ও সাহিত্যিক, যিনি ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন এবং ভাষাবিজ্ঞান, ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে বহু গবেষণা ও কাজ করেছেন। ড মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ ছিলেন নীতিবান, সহজ-সরল ও বিনয়ী মানুষ। তিনি সর্বদা সাধারণ জীবনযাপন করতেন এবং শিক্ষার্থীদের প্রতি আন্তরিক ছিলেন। ড.মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ছিলেন একজন বাঙালি বহুভাষাবিদ, ভাষাবিদ, শিক্ষাবিদ, গবেষক ও সাহিত্যিক, যিনি ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন এবং ভাষাবিজ্ঞান, ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে বহু গবেষণা ও কাজ করেছেন।

মৃত্যুবরণ

ড মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ১৩ জুলাই ১৯৬৯ সালে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। তিনি ছিলেন একজন ভাষাবিদ, ভাষাতত্ত্ববিদ, শিক্ষাবিদ এবং লেখক। তাঁর জন্ম ১৯৫৫ সালের ১০ জুলাই পশ্চিমবঙ্গের পেয়ারা গ্রামে এবং মৃত্যুর পর তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের পাশে সমাহিত করা হয়। তাঁর মৃত্যুতে সমগ্র বাংলাদেশ গভীরভাবে শোকাহত হয়।

উত্তরাধিকার ও প্রভাব

ড মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ভাষা আন্দোলন, বাংলা ভাষা গবেষণা এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের এক কিংবদন্তী ব্যক্তিত্ব ছিলেন, যাঁর উত্তরাধিকার ও প্রভাব সুদূরপ্রসারী। তিনি বাংলা ভাষার উৎপত্তি, বিকাশ এবং আঞ্চলিক উপভাষা নিয়ে কাজ করেছেন, চর্যাপদের পরিচয় উন্মোচন করেছেন এবং বাংলা একাডেমী প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রেখেছেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তাঁর জোরালো বক্তব্য বাংলা ভাষার স্বীকৃতি আদায়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল এবং বাংলা ভাষাভাষী মানুষের কাছে তিনি এক অনুসরণীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন। ড মুহম্মদ শহীদুল্লাহর অবদান কেবল তাঁর সময়ে সীমাবদ্ধ ছিল না; আজও তাঁর গবেষণা, রচনা ও দৃষ্টিভঙ্গি প্রাসঙ্গিক। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাস রচনায় তিনি যে ভিত্তি গড়ে দিয়েছেন, তার ওপরই আধুনিক গবেষকরা এগিয়ে চলেছেন। বাংলাদেশে মাতৃভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা ও সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয় গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য।

ড মুহম্মদ শহীদুল্লাহ কেবল একজন শিক্ষাবিদ বা গবেষকই ছিলেন না, তিনি ছিলেন বাংলার আত্মপরিচয়ের প্রতীক। তাঁর বহুমাত্রিক অবদান বাংলাভাষা, সাহিত্য, ইতিহাস, সংস্কৃতি, শিক্ষা ও গবেষণায় আজও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলা ভাষার প্রাচীনতা ও সমৃদ্ধি তিনি বিশ্বমঞ্চে প্রমাণ করেছিলেন। তাঁর চর্যাপদবিষয়ক গবেষণা বাংলা সাহিত্যের সূচনালগ্নকে নতুনভাবে চিনতে সাহায্য করে। তিনি শুধু অতীতকে আবিষ্কার করেননি, বর্তমানের জন্যও পথ নির্দেশ করেছেন। তাঁর কলম ও চিন্তার মাধ্যমে আমরা শিখেছি— নিজের মাতৃভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতি ভালোবাসা ছাড়া কোনো জাতি তার আত্মপরিচয় খুঁজে পায় না।

ড মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর জীবন আমাদের শেখায় যে শিক্ষা কেবল ব্যক্তিগত উন্নতির জন্য নয়; বরং জাতির সার্বিক অগ্রগতির জন্য। তাঁর শিক্ষাদর্শনে যেমন মানবিকতা, নৈতিকতা ও সহিষ্ণুতা ছিল, তেমনি ছিল স্বাধীন চিন্তা ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি। তিনি প্রমাণ করেছিলেন, জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্র সীমাহীন; ভাষা, সাহিত্য, আইন, দর্শন কিংবা ইতিহাস—সবখানেই তিনি সমান স্বচ্ছন্দ।

ড মুহম্মদ শহীদুল্লাহ আজ আর আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু তাঁর রচনা, গবেষণা, দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তাধারা যুগের পর যুগ আমাদের পথ দেখিয়ে যাবে। আধুনিক বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ও ভাষার ভিত্তি গড়ে উঠেছে তাঁর মতো মনীষীদের অবদানেই।

তাই তাঁকে কেবল একজন ভাষাবিদ বা গবেষক নয়, বরং বাংলা জাতিসত্তার অন্যতম নির্মাতা হিসেবেই অভিহিত করা যায়। তাঁর প্রতি জাতির কৃতজ্ঞতা চিরন্তন, আর তাঁর স্মৃতি আমাদের জন্য প্রেরণার বাতিঘর হয়ে থাকবে।

তথ্যসূত্র

আহমদ শরীফ, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনা।

মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, বাংলাভাষার ইতিবৃত্ত, বাংলা একাডেমি, ঢাকা।

মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, মুসলিম সাহিত্য ও সংস্কৃতি, বাংলা একাডেমি।

মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, সংক্ষিপ্ত বাঙলা ব্যাকরণ, কলকাতা।

আবদুল মান্নান সৈয়দ, বাংলা ভাষার ইতিহাসচর্চা, সাহিত্য প্রকাশ।

Itihasar Golpo
Itihasar Golpohttps://itihasargolpo.com
Step into the past with our unforgettable historical journey. Discover the secrets of history on our captivating journey.
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments