মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর পরিচয়
মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী (১২ ডিসেম্বর ১৮৮০ – ১৭ নভেম্বর ১৯৭৬), যিনি মওলানা ভাসানী নামেও পরিচিত, একজন বাংলাদেশী রাজনীতিবিদ এবং রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন যিনি বাংলাদেশের প্রাচীনতম এবং প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন যেটি পাকিস্তান থেকে শেষ পর্যন্ত দেশটিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল। মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ছিলেন দক্ষিণ এশিয়ার একজন কিংবদন্তি রাজনীতিবিদ, ধর্মপ্রচারক, কৃষকনেতা এবং নির্যাতিত মানুষের মুক্তির প্রতীক। তাঁকে বলা হয় “মজলুম জননেতা”। কারণ তিনি সর্বদা শোষিত, নিপীড়িত, দরিদ্র কৃষক-শ্রমিক মানুষের পক্ষে সংগ্রাম করেছেন। তাঁর রাজনৈতিক আদর্শ ছিল সমাজতন্ত্র, সাম্য, ন্যায়বিচার ও মানবমুক্তি।
মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর জন্মস্থান
মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ১৮৮০ সালের ১২ই ডিসেম্বর ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির পাবনা জেলার সয়াধানগড়া পল্লীতে (বর্তমানে বাংলাদেশের সিরাজগঞ্জ জেলায়) জন্মগ্রহণ করেন।
মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী কে ছিলেন
মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী (১২ ডিসেম্বর ১৮৮০ – ১৭ নভেম্বর ১৯৭৬), যিনি মাওলানা ভাসানী নামেই সমধিক পরিচিত, ছিলেন বিংশ শতাব্দীর ব্রিটিশ ভারতের অন্যতম তৃণমূল রাজনীতিবিদ ও গণআন্দোলনের নেতা, যিনি জীবদ্দশায় ১৯৪৭-এ সৃষ্ট পাকিস্তান ও ১৯৭১-এ প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর শৈশব ও প্রারম্ভিক জীবন
তাঁর পিতার নাম শরাফত আলী খান এবং মাতার নাম মোসাম্মৎ মজিরন বিবি। জন্মের কিছুদিন পরই তিনি পিতৃহারা হন এবং শৈশবে জীবনে প্রচণ্ড দারিদ্র্য ও অনিশ্চয়তা ভোগ করেন। এই দুঃখ-কষ্টের মধ্য দিয়েই তিনি বড় হন এবং পরবর্তীতে দরিদ্র মানুষের প্রতি গভীর সহমর্মিতা অর্জন করেন। তিনি শৈশবে দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন হয়েছিলেন এবং তার অনেক ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে দুর্ভিক্ষের কবলে পড়তে দেখেছিলেন। মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর পরিবেশ ছিল দরিদ্র বর্গাচাষী কৃষকদের নিয়ে। মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী তার গ্রামের পাঠশালা, যা একটি ঐতিহ্যবাহী প্রাথমিক বিদ্যালয়, সেখান থেকে তিনি প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। তিনি সিরাজগঞ্জে মাওলানা আব্দুল বারী চিশতীর মাদ্রাসায় (আনুমানিক ১৮৮৭ ) তার ছাত্র ছিলেন। তাঁর গভীর জ্ঞান, তীক্ষ্ণ মেধা ও রাজনৈতিক চেতনা ছোটবেলা থেকেই প্রকাশ পেতে শুরু করে।
মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর শিক্ষা ও ধর্মীয় জীবন
মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ছিলেন মূলত একজন আলেম। তিনি সিলেট, ঢাকা ও ভারতের বিভিন্ন মাদরাসায় শিক্ষা লাভ করেন। আরবি, ফারসি ও উর্দুতে দক্ষ ছিলেন। তিনি কেবল ধর্মীয় জ্ঞানই অর্জন করেননি, বরং ইসলামকে সামাজিক ন্যায়বিচারের হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করেন। ফলে তিনি ইসলামের মুক্তির দিকটিকে গুরুত্ব দিয়ে মানুষের কাছে প্রচার করতে থাকেন।
মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর রাজনৈতিক জীবন
মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় ঔপনিবেশিক আমলে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট গঠনকারী প্রধান নেতাদের মধ্যে তিনি অন্যতম। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায়ও তিনি বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। রাজনৈতিক জীবনের বেশিরভাগ সময়ই তিনি চীনের মাওপন্থী কম্যুনিস্ট তথা বামধারার রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। তাছাড়াও উপমহাদেশে কম্যুনিস্ট ধারার রাজনীতির প্রসারে তার বিশেষ অবদান ছিল। তিনি খিলাফত আন্দোলন ও অসহযোগ আন্দোলনে অংশ নেন এবং সাধারণ মানুষকে জাগ্রত করার কাজ করেন। ১৯২০ এর দশকে তিনি আসামে কৃষক আন্দোলন শুরু করেন। মুসলিম কৃষকদের জমি-জমা রক্ষা, ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য তিনি সংগ্রাম করেন। কৃষক-শ্রমিকের সঙ্গে মিশে তাঁদের ভাষায় কথা বলে তিনি জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন।
মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর কৃষক আন্দোলন ও নেতৃত্ব
মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো কৃষক আন্দোলন। তিনি বিশ্বাস করতেন, কৃষক হলো সমাজের মেরুদণ্ড। কৃষক যদি শোষিত থাকে তবে রাষ্ট্র কখনো স্বাধীন বা সমৃদ্ধ হতে পারবে না। তিনি “কৃষক প্রজা পার্টি” এবং পরবর্তীতে বিভিন্ন কৃষক সমিতি গড়ে তোলেন। আসামে কৃষকদের জমির অধিকার রক্ষায় কঠোর আন্দোলন চালান। তাঁর নেতৃত্বে কৃষকেরা ঋণমুক্তির দাবি, খাজনা হ্রাস, জমিদারি প্রথার বিলোপ ইত্যাদি দাবি তোলে।
মুসলিম লীগ ও পাকিস্তান আন্দোলনে ভাসানী
মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী পাকিস্তান আন্দোলনের অন্যতম প্রবল সমর্থক ছিলেন। তিনি মুসলিম লীগের হয়ে কাজ করেন এবং বাংলার গ্রামে-গঞ্জে সাধারণ মানুষকে পাকিস্তান আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করেন। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তিনি ভেবেছিলেন মুসলমানদের মুক্তি আসবে। কিন্তু শীঘ্রই তিনি উপলব্ধি করেন, পাকিস্তানও একটি শোষণমূলক রাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছে যেখানে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রভুত্ব কায়েম হয়েছে।
আওয়ামী মুসলিম লীগ ও ভাষা আন্দোলন
১৯৪৯ সালে গঠিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ–এর তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। তাঁর নেতৃত্বেই আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের মূল বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ভাষা আন্দোলনের সময় ভাসানী বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিকে সমর্থন করেন। ১৯৫২ সালে ছাত্রদের ওপর পুলিশি গুলিবর্ষণের ঘটনায় তিনি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান। এর ফলে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা দ্রুত বৃদ্ধি পায়।
১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন
১৯৫৪ সালে মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মিলে যুক্তফ্রন্ট গঠন করেন। এই জোটে আওয়ামী লীগ, কৃষক প্রজা পার্টি এবং অন্যান্য দল একত্র হয়। ১৯৫৪ সালের মার্চের ৮ থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান পরিষদের নির্বাচনে ২৩৭ টি মুসলিম (মোট আসন ছিল ৩০৯ টি) আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট ২২৩টি আসন অর্জন করে। তন্মধ্যে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী মুসলিম লীগ ১৪৩ টি। এই নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট অভূতপূর্ব জয়লাভ করে এবং মুসলিম লীগ পরাজিত হয়। এটি ছিল ভাসানীর রাজনৈতিক জীবনের এক ঐতিহাসিক সাফল্য।
পলিটিক্যাল টার্ন বামপন্থা ও সাম্যবাদ
১৯৫০ এর দশকের শেষের দিকে মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী সমাজতন্ত্র ও বামপন্থার দিকে ঝুঁকে পড়েন। তিনি মনে করতেন, পাকিস্তান কেবল সামরিক-আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছে যেখানে দরিদ্র কৃষক-শ্রমিকের মুক্তি নেই। তিনি মস্কো সফর করেন এবং সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির সঙ্গে সম্পর্ক বাড়ান। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী অবস্থান নেন। ১৯৫৭ সালের কাগমারী সম্মেলনে তিনি পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদকে তীব্র সমালোচনা করেন এবং বিখ্যাতভাবে বলেছিলেন: “আসসালামু আলাইকুম, আমেরিকা।”
পাকিস্তান সরকার ও সামরিক শাসনের বিরোধিতা
মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সর্বদা সোচ্চার। তিনি আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেন। শোষিত জাতিসমূহের মুক্তির পক্ষে “ন্যাপ” (ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি) প্রতিষ্ঠা করেন। ন্যাপ ভাসানী গোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানে গণআন্দোলনের অন্যতম নেতৃত্বে পরিণত হয়।
মুক্তিযুদ্ধ ও ভাসানীর ভূমিকা
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী বয়সে বৃদ্ধ হলেও মানসিকভাবে ছিলেন দৃঢ়। তিনি ১৯৭১ সালের মার্চে অসহযোগ আন্দোলনকে সমর্থন করেন। পাকিস্তানি সেনাদের হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সমর্থন জানিয়ে ভারত সফর করেন এবং আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার দাবি প্রচার করেন। যুদ্ধকালীন সময়ে তিনি বাংলাদেশ সরকারের অনানুষ্ঠানিক উপদেষ্টার ভূমিকা পালন করেন। স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের প্রস্তুতি পর্ব থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয় অর্জন পর্যন্ত দীর্ঘ সংগ্রামের প্রতিটি পর্যায়ে মওলানা ভাসানী অগ্রবর্তী অবস্থানে থেকেছেন। সরকারের নির্যাতন, দলের ভাঙন ও সহকর্মীদের পক্ষত্যাগের মতো কোনো বাধা বা প্রতিকূলতাই তাকে স্বাধীনতার লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। স্বাধীনতার পরও তার সে দেশপ্রেমিক ভূমিকা অব্যাহত ছিল। দেশ ও জাতির স্বার্থে মওলানা ভাসানী আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। সবমিলিয়ে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, একজন প্রধান জাতীয় নেতার ভূমিকা পালন করে গেছেন মওলানা ভাসানী।
স্বাধীন বাংলাদেশে ভূমিকা
তিনি বাংলাদেশের মানুষের কাছে “মজলুম জননেতা” হিসাবে সমধিক পরিচিত। ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট গঠনকারী প্রধান নেতাদের মধ্যে তিনি অন্যতম। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায়ও তিনি বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। রাজনৈতিক জীবনের বেশিরভাগ সময়ই তিনি চীনের মাওপন্থী কম্যুনিস্ট তথা বামধারার রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। স্বাধীনতার পর মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীও সমালোচনার মুখে পড়েন। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন সরকারের সমালোচনা করতেন এবং বিশেষ করে অর্থনৈতিক বৈষম্য ও রাজনৈতিক স্বৈরতান্ত্রিক প্রবণতার বিরুদ্ধে কথা বলতেন। তবে তাঁর সমালোচনার উদ্দেশ্য ছিল রাষ্ট্রকে সত্যিকারের জনমুখী করা।
মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর উক্তি
আমার নেতা কোন ব্যক্তি বিশেষ নয় । আমার নেতা দেশের জনতা । দেশের অধিবাসী । আপামর জনসাধারণ।
নিজেকে জয় কর; জগৎ তোমার পদানত হইবে । দুনিয়ার পিছনে ঘুরিও না । দুনিয়াই তোমার পশ্চাতে ঘুরিবে।
ইসলাম সকল মানুষকে,সে মুসলমান হউক বা না হউক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তা দান করিয়াছে।
মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর মৃত্যু
মজলুম জননেতা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ১৯৭৬ সালের ১৭ নভেম্বর ঢাকার তৎকালীন পিজি হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন। তাঁকে টাঙ্গাইলের সন্তোষে দাফন করা হয়। মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স ছিল প্রায় ৯৬ বছর।
মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর আদর্শ ও দর্শন
মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর দর্শন কয়েকটি মূল দিক ঘিরে গড়ে উঠেছিল—
কৃষক-শ্রমিকের মুক্তি – তিনি সর্বদা গ্রামীণ দরিদ্র মানুষের অধিকার রক্ষায় সংগ্রাম করেছেন।
সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতা – তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ সকল প্রকার সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদ বিরোধিতা করতেন।
ধর্মভিত্তিক মানবতাবাদ – ইসলামকে তিনি ন্যায়, সমতা ও ভ্রাতৃত্বের দর্শন হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন।
গণতন্ত্র ও সাম্যবাদ – তিনি গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ও সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পক্ষে ছিলেন।
মূল্যায়ন ও উত্তরাধিকার
মাওলানা আব্দুল হামিদ খান আজও বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক অনন্য চরিত্র। তাঁকে “গণমানুষের নেতা” বলা হয়। তাঁর আন্দোলন বাংলাদেশে বামপন্থী রাজনীতির ভিত গড়ে দেয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীসহ অনেক নেতার উপর তাঁর প্রভাব ছিল গভীর। মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী আজও কৃষক-শ্রমিকের মুক্তির প্রতীক, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামের প্রেরণা এবং জনমানুষের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে স্মরণীয়।
মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ছিলেন এমন এক নেতা যিনি ব্যক্তিগত স্বার্থ, বিলাসিতা বা ক্ষমতার রাজনীতি থেকে সর্বদা দূরে থেকেছেন। তাঁর জীবন ছিল একেবারেই ভিন্নধর্মী—তিনি সাধারণ মানুষের সঙ্গে থেকেছেন, তাঁদের কষ্ট ভাগ করেছেন, তাঁদের অধিকারের জন্য অদম্য সংগ্রাম করেছেন। ইতিহাসে এমন রাজনৈতিক নেতা খুব কমই দেখা যায়, যিনি দরিদ্র ও নিপীড়িত মানুষের জন্য জীবনভর সংগ্রাম করেও কখনো ক্ষমতার লোভে নিজেকে বিকিয়ে দেননি।
মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর রাজনৈতিক দর্শনের মূলকথা ছিল—“জনগণের জন্য রাজনীতি, জনগণের মুক্তির জন্য সংগ্রাম।” তিনি মানতেন, রাজনীতি কেবল একটি ক্ষমতার খেলা নয়; বরং এটি মানুষের জীবনমান উন্নয়ন, সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং শোষণমুক্ত একটি রাষ্ট্র গঠনের জন্য হাতিয়ার। এই দর্শন থেকেই তিনি কৃষক-শ্রমিক, গ্রামীণ দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষের মুক্তির সংগ্রামকে রাজনৈতিক জীবনের কেন্দ্রবিন্দুতে রেখেছিলেন।
বাংলাদেশের ইতিহাসে তিনি ছিলেন এক প্রকার “অভিভাবক চরিত্র”—যিনি রাজনীতিতে নতুন নেতৃত্বকে পথ দেখিয়েছেন। শেখ মুজিবুর রহমান থেকে শুরু করে বাংলাদেশের অনেক বড় নেতার রাজনৈতিক বিকাশে ভাসানীর প্রভাব ছিল গভীর। তিনি যেমন পাকিস্তান আমলে পূর্ব বাংলার মুক্তির প্রশ্নে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তেমনি স্বাধীন বাংলাদেশেও শাসকের ভুলত্রুটি সাহসের সঙ্গে তুলে ধরেছেন।
মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর অন্যতম বড় গুণ ছিল তাঁর অসাধারণ দূরদর্শিতা। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অল্প কিছুদিন পরেই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, পূর্ববাংলার মানুষ পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর দ্বারা শোষিত হতে থাকবে। আবার ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের আগেই তিনি পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার সম্ভাবনার কথা বলেছেন, যা পরে সত্য হয়ে দাঁড়ায়।
আজকের বাংলাদেশে সামাজিক বৈষম্য, দুর্নীতি, দারিদ্র্য ও শোষণ এখনো রয়ে গেছে। তাই মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর আদর্শ আজও সমান প্রাসঙ্গিক। যদি আমরা তাঁর মতো করে মানুষের প্রকৃত মুক্তির জন্য সংগ্রাম করতে পারি, তবে একটি ন্যায়ভিত্তিক, সমতা ও কল্যাণমুখী সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব হবে। সুতরাং, বলা যায়—মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী শুধু একজন রাজনীতিবিদ ছিলেন না; তিনি ছিলেন এক যুগের প্রেরণা, এক শোষিত জাতির মুক্তির প্রতীক, এক জননেতা যিনি ইতিহাসে চিরকাল “মজলুম জননেতা” হিসেবেই স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
তথ্যসূত্র
আব্দুল গফুর, মজলুম জননেতা মাওলানা ভাসানী, ঢাকা: মাওলানা ভাসানী গবেষণা পরিষদ, ১৯৮৩।
সেলিনা হোসেন, মাওলানা ভাসানী: সংগ্রামী জীবনের দলিল, ঢাকা: সাহিত্য প্রকাশ, ২০০৫।
আহমদ রফিক, বাংলাদেশের রাজনীতি ও ভাসানীর ভূমিকা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনা, ১৯৯৬।
মেট্রোপলিটন লাইব্রেরি আর্কাইভস, ঢাকা (ভাষা আন্দোলন ও ভাসানীর রাজনৈতিক ভূমিকার দলিল)।
Banglapedia: National Encyclopedia of Bangladesh – Entry: Maulana Abdul Hamid Khan Bhashani।
Newspapers Archive – The Daily Ittefaq, The Daily Azad, (১৯৫০–১৯৭৬ সময়কালে প্রকাশিত প্রতিবেদন)।