Friday, October 3, 2025
Homeইতিহাসবরেন্দ্র জাদুঘর রাজশাহী

বরেন্দ্র জাদুঘর রাজশাহী

বরেন্দ্র জাদুঘর এর ইতিহাস

বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের প্রাচীনতম ও অন্যতম ঐতিহাসিক শহর রাজশাহীতে অবস্থিত বরেন্দ্র জাদুঘর কেবল একটি জাদুঘরই নয়, এটি এক অমূল্য ঐতিহ্যের ভাণ্ডার। এ জাদুঘরকে বলা হয় বাংলাদেশ তথা উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘর। বরেন্দ্র অঞ্চলের প্রাচীন সভ্যতা, ইতিহাস, সংস্কৃতি ও শিল্পকলা সংরক্ষণে এই জাদুঘরের ভূমিকা অসামান্য। এখানে প্রদর্শিত নিদর্শনসমূহ প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে শুরু করে মুসলিম শাসনকাল পর্যন্ত বিস্তৃত।

বরেন্দ্র জাদুঘর এর প্রতিষ্ঠাতা

বরেন্দ্র জাদুঘরের ইতিহাস শুরু হয় উনিশ শতকের শেষদিকে। ১৯১০ সালে রাজশাহী অঞ্চলের তিনজন পুরতত্ত্ববিদ ও বিদ্যানুরাগী ব্যক্তি, যেমন শরৎ কুমার রায়, অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় এবং রমাপ্রসাদ চন্দ, এই বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন। এই সমিতির অধীনেই জাদুঘরটি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এটি ছিল পূর্ব বাংলায় (বর্তমান বাংলাদেশ) প্রথম জাদুঘর। মূল উদ্দেশ্য ছিল উত্তরবঙ্গ তথা বরেন্দ্রভূমির ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা এবং প্রত্ননিদর্শন সংগ্রহ।

বরেন্দ্র জাদুঘর কবে প্রতিষ্ঠিত হয়

১৯১০ সালে এই সমাজের উদ্যোগেই রাজশাহীতে বরেন্দ্র জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীকালে রাজশাহীর মহারাজা প্রতাপ চন্দ্র রায়ের সহযোগিতায় ভবনের সম্প্রসারণ ঘটে। ১৯১৬ সালের ১৩ নভেম্বর লর্ড কারমাইকেল ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন এবং ১৯১৯ সালের ২৭ নভেম্বর গভর্নর লর্ড রোনাল্ডসে এটি উদ্বোধন করেন।পাকিস্তান আমলে এটি সরকারিভাবে পরিচালিত হতে থাকে এবং ১৯৬৪ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আসে। বর্তমানে এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে। এটি প্রত্নতাত্ত্বিক সংগ্রহে সমৃদ্ধ এবং রাজশাহী শহরের একটি গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র।

বরেন্দ্র জাদুঘর এর স্থাপত্য ও ভবনের বৈশিষ্ট্য

বরেন্দ্র জাদুঘরের স্থাপত্যশৈলী ঐতিহ্যবাহী, যা এর নান্দনিকতার পাশাপাশি এর ঐতিহাসিক গুরুত্বকেও তুলে ধরে। এটি প্রাচীন নিদর্শন ও সংস্কৃতির সংরক্ষণে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। বরেন্দ্র জাদুঘরের স্থাপত্যে প্রাচীন ও আধুনিকের সমন্বয় লক্ষ্য করা যায়। প্রধান ভবনটি লাল ইটের তৈরি, ঔপনিবেশিক ধাঁচের হলেও আঞ্চলিক নকশার ছাপও রয়েছে। ভেতরে রয়েছে প্রশস্ত গ্যালারি, প্রদর্শনী কক্ষ, গবেষণা কক্ষ ও সংরক্ষণাগার। ভবনের বাহ্যিক দেয়ালে খচিত আছে বিভিন্ন প্রত্নচিহ্ন, যা প্রাচীন মন্দির ও ভাস্কর্য থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।

বরেন্দ্র জাদুঘরের নিদর্শন সংগ্রহ

বরেন্দ্র জাদুঘরের নিদর্শনের সংগ্রহে হাজার হাজার বছরের প্রাচীন নিদর্শন রয়েছে, যার মধ্যে পাল, সেন, মৌর্য ও গুপ্ত যুগের প্রত্নতাত্ত্বিক সামগ্রী অন্তর্ভুক্ত। এটি বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন ও সমৃদ্ধ একটি প্রত্ন সংগ্রহশালা, যেখানে মূলত বরেন্দ্র অঞ্চলের বিভিন্ন সময়ের ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক নিদর্শন সংরক্ষিত আছে। বরেন্দ্র জাদুঘরের সংগ্রহ অসাধারণ। বর্তমানে এখানে প্রায় ১৫,০০০-এর বেশি নিদর্শন সংরক্ষিত রয়েছে। এ নিদর্শনসমূহকে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত:

বরেন্দ্র জাদুঘরের প্রাগৈতিহাসিক নিদর্শন

এখানে বিভিন্ন সময়ের শিল্পকলা, ভাস্কর্য এবং অন্যান্য ঐতিহাসিক সামগ্রী সংরক্ষিত আছে, যা বরেন্দ্র অঞ্চলের সমৃদ্ধ ঐতিহ্যকে প্রকাশ করে।আদিম যুগের প্রস্তর সরঞ্জাম, অগ্নিকুণ্ড ও মৃত্তিকা পাত্রের টুকরো।

বৌদ্ধ ও হিন্দু যুগের নিদর্শন

পাল ও সেন আমলের অসংখ্য ভাস্কর্য,বুদ্ধমূর্তি, বোধিসত্ত্ব মূর্তি, বিষ্ণু, শিব, দুর্গা, গণেশ প্রভৃতি দেব-দেবীর মূর্তি, টেরাকোটা ফলক, স্তূপের অবশেষ।

মুসলিম যুগের নিদর্শন

বরেন্দ্র জাদুঘরে মুসলিম যুগের যেসব নিদর্শন পাওয়া যায় তার মধ্যে রয়েছে সুলতানি ও মুঘল আমলের মুদ্রা, Islamic manuscripts এবং Muslim যুগের স্থাপত্যের অংশ। এই নিদর্শনগুলো বাংলাদেশের মুসলিম শাসনামলের শিল্পকলা, মুদ্রা ব্যবস্থা ও সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ চিত্র তুলে ধরে।

মুসলিম যুগের উল্লেখযোগ্য নিদর্শন:

মুদ্রা: সুলতানি ও মুঘল আমলে তৈরি বিভিন্ন ধরনের মুদ্রা এই জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে, যা তৎকালীন অর্থনীতি ও শাসনব্যবস্থার পরিচয় দেয়।

ইসলামিক পাণ্ডুলিপি: মুসলিম যুগে লিখিত বিভিন্ন পাণ্ডুলিপি বা পুথিও জাদুঘরে রাখা হয়েছে। এই পাণ্ডুলিপিগুলো সেই সময়ের সাহিত্য, জ্ঞানচর্চা ও ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রমাণ বহন করে। সুলতানি ও মুঘল আমলের শিলালিপি, কুরআনের আয়াত খচিত শিলালেখ

লোকজ ও সাংস্কৃতিক নিদর্শন

বাংলার গ্রামীণ জীবনের নিত্যপ্রয়োজনীয় উপকরণ,বয়নযন্ত্র, কৃষিজ উপকরণ, মৃৎপাত্র, গহনা,বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক নিদর্শন।

বরেন্দ্র জাদুঘরের উল্লেখযোগ্য নিদর্শন

বরেন্দ্র জাদুঘরের উল্লেখযোগ্য নিদর্শনগুলোর মধ্যে রয়েছে সিন্ধু ও মহেঞ্জোদারো সভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, পাথরের মূর্তি, একাদশ শতকের বুদ্ধ মূর্তি, ভৈরবের মাথা, গঙ্গা মূর্তি, মহাস্থান ও মহেনজোদারোর বিভিন্ন নিদর্শন, গুপ্ত সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের গোলাকার স্বর্ণমুদ্রা, মোঘল আমলের রৌপ্য মুদ্রা, প্রাচীন আমলের ঢাল-তলোয়ার, ধাতব পাত্র এবং সম্রাট অশোক থেকে ব্রিটিশ আমল পর্যন্ত নির্মিত বিভিন্ন ধরনের মূর্তি।

বোধিসত্ত্ব মূর্তি (৮ম শতক) – পাল যুগের উৎকৃষ্ট শিল্পকর্ম।

বুদ্ধের ভাস্কর্য – পাথরে খোদাই করা শান্ত ও ধ্যানমগ্ন বুদ্ধমূর্তি।

শিবলিঙ্গ ও বিষ্ণুমূর্তি – হিন্দু ধর্মীয় ভাস্কর্যের নিদর্শন।

সুলতানি যুগের মুদ্রা ও শিলালিপি – মুসলিম শাসনের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় ইতিহাসের দলিল।

লোকজ শিল্পকর্ম – গ্রামীণ জীবনের চিত্র তুলে ধরে।

বরেন্দ্র জাদুঘরের গুরুত্ব

বরেন্দ্র জাদুঘর বাংলাদেশের প্রথম জাদুঘর ও দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রধান প্রত্নতাত্ত্বিক সংগ্রহশালা, যা দেশের ও মহাদেশের প্রাচীন ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিল্পকলা ও সংস্কৃতির অমূল্য নিদর্শনাদি ধারণ করে। এটি হাজার হাজার বছরের প্রাচীন সভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, পাল ও সেন যুগের ঐতিহাসিক মূর্তি, আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সামগ্রী এবং বিভিন্ন ভাষার পাথরের শিলালিপি প্রদর্শন করে, যা গবেষক, ইতিহাসবিদ ও তরুণ প্রজন্মের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই জাদুঘরটি কেবল রাজশাহী অঞ্চলের জন্যই নয়, বরং গোটা ভারতীয় উপমহাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

বরেন্দ্র জাদুঘর শুধু প্রদর্শনীর জন্য নয়, গবেষণার ক্ষেত্র হিসেবেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

প্রত্নতত্ত্ব ও ইতিহাসের শিক্ষার্থীদের জন্য এটি এক অনন্য তথ্যভাণ্ডার।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এখানে গবেষণা ও মাঠকর্ম পরিচালনা করে।

বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গবেষকও এ জাদুঘরের সংগ্রহ নিয়ে গবেষণা করেছেন।

বরেন্দ্র জাদুঘর ইতিহাসবিদ, প্রত্নতাত্ত্বিক এবং গবেষকদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র।

তরুণ প্রজন্ম ও ইতিহাসের গবেষকরা এখানকার সংগ্রহ দেখে নিজেদের গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য ও উপাদান সংগ্রহ করেন।

সাংস্কৃতিক ও সামাজিক গুরুত্ব

জাদুঘরটি বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক।

এটি উত্তরবঙ্গের মানুষের গৌরব, কারণ এর মাধ্যমে তাদের অতীত ইতিহাসের সাথে সংযোগ তৈরি হয়।

স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য এটি একটি শিক্ষা ও জ্ঞানের কেন্দ্র।

পর্যটকদের জন্যও এটি আকর্ষণীয় স্থান, যা বাংলাদেশের প্রত্নতত্ত্ব ও ইতিহাসকে তুলে ধরে।

এই জাদুঘরটি বাংলাদেশের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ধারণ ও প্রদর্শনের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরে।

এখানে বিভিন্ন আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ব্যবহৃত সামগ্রী সংরক্ষিত আছে, যা তাদের জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে সাহায্য করে।

চ্যালেঞ্জ ও সীমাবদ্ধতা

বরেন্দ্র জাদুঘরের প্রধান চ্যালেঞ্জগুলো হলো স্থান সংকট, যেখানে বিশাল সংগ্রহশালার খুব অল্প অংশই প্রদর্শনের সুযোগ পায়, এবং সংরক্ষণের অভাব, যা নিদর্শনগুলোর ক্ষতি করছে। এছাড়া, জনবল ও আর্থিক সংকট, গবেষণা ও লাইব্রেরি কার্যক্রম বন্ধ থাকা এবং সামগ্রিক অব্যবস্থাপনা জাদুঘরের কার্যক্রমে বড় সীমাবদ্ধতা তৈরি করেছে, যা অমূল্য প্রত্নসম্পদগুলো সঠিকভাবে উপস্থাপন ও সংরক্ষণে বাধা দিচ্ছে। 

যদিও বরেন্দ্র জাদুঘরের গুরুত্ব অপরিসীম, তবুও কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে:

স্থান সংকট ও প্রদর্শনের অভাব: বরেন্দ্র জাদুঘরে ১৭,০০০ এর বেশি প্রত্ননিদর্শন রয়েছে, কিন্তু জায়গা সংকুলানের অভাবে মাত্র ১,২০০ থেকে ১,৪০০ নিদর্শন প্রদর্শনীতে রাখা সম্ভব হয়। বাকি অধিকাংশ নিদর্শন স্টোর রুমে রাখা আছে, যার ফলে সেগুলো দর্শকদের সামনে তুলে ধরা যাচ্ছে না।

সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের সমস্যা: প্রত্ননিদর্শনগুলো যথাযথভাবে সংরক্ষিত হচ্ছে না এবং সংস্কারের সময় ধুলাবালি লেগে নিদর্শনগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সংরক্ষণাগারে থাকা নিদর্শনগুলো সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

জনবল ও আর্থিক সংকট: জাদুঘরে জনবলের অভাব রয়েছে, যার ফলে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করা কঠিন হয়ে পড়ছে। লোকবলের অভাবে লাইব্রেরী ও গবেষণা কার্যক্রম বন্ধ আছে, যা জাদুঘরের সামগ্রিক উন্নয়নে একটি বড় বাধা।

গবেষণা ও শিক্ষামূলক কার্যক্রমে বাধা: সংরক্ষণ ও জনবল সংকটের কারণে জাদুঘরের গবেষণা কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। প্রদর্শনীর সংখ্যা কম হওয়ায় এবং নিদর্শনগুলো সঠিকভাবে উপস্থাপনের অভাবে দর্শকদের জ্ঞানার্জন ও জাদুঘরের ঐতিহাসিক গুরুত্ব বোঝার সুযোগ সীমিত হচ্ছে।

নিরাপত্তা সংকট: নিরাপত্তার অভাবে মহামূল্যবান প্রত্নসামগ্রী হারিয়ে যাওয়ার বা চুরি হওয়ার ঝুঁকি থাকে, যা জাদুঘরের অমূল্য সম্পদ নষ্ট করতে পারে।

বরেন্দ্র জাদুঘরের উন্নয়ন সম্ভাবনা

বরেন্দ্র জাদুঘরের উন্নয়ন সম্ভাবনা নির্ভর করছে প্রত্নসম্পদের যথাযথ সংরক্ষণ, আধুনিক প্রদর্শনী ব্যবস্থা, পর্যাপ্ত জনবল, তহবিল ও গবেষণার সুযোগ বৃদ্ধির উপর। জাদুঘরের বিশাল প্রত্নভান্ডার থাকা সত্ত্বেও জায়গার অভাবে মাত্র অল্প কিছু নিদর্শন প্রদর্শন করা যায়, যা উন্নয়নের প্রধান বাধা। আধুনিক সংরক্ষণাগার তৈরি, ডিজিটাল গ্যালারির ব্যবস্থা, গবেষণা ও প্রকাশনা বৃদ্ধি এবং পর্যটনের বিকাশে জোর দিলে জাদুঘরটি আরও কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারবে। ডিজিটাল প্রদর্শনী চালু করলে দর্শনার্থীরা আরও আকৃষ্ট হবে। আন্তর্জাতিক সহযোগিতায় সংরক্ষণ প্রযুক্তি উন্নত করা সম্ভব। অনলাইন ক্যাটালগ তৈরি করলে গবেষণা সহজ হবে।

বরেন্দ্র জাদুঘর শুধুমাত্র একটি জাদুঘর নয়, বরং এটি এক জীবন্ত ইতিহাসের আখ্যান। এই জাদুঘরের প্রতিটি নিদর্শন যেন আমাদের প্রাচীন সভ্যতা, ধর্মীয় ঐতিহ্য, শিল্পকলা ও সাংস্কৃতিক বিকাশের নীরব সাক্ষী হয়ে আছে। বরেন্দ্রভূমি ছিল বাংলার এক গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কেন্দ্র, যা পাল, সেন, মুসলিম শাসনকাল থেকে শুরু করে ঔপনিবেশিক আমল পর্যন্ত সমৃদ্ধ ইতিহাস বহন করেছে। সেই ইতিহাসের ধারাবাহিকতা আজ আমরা বরেন্দ্র জাদুঘরের সংগ্রহের মধ্য দিয়ে দেখতে পাই।

জাদুঘরটির বৈশিষ্ট্য হলো এর বৈচিত্র্যপূর্ণ নিদর্শন। এখানে যেমন প্রাগৈতিহাসিক যুগের প্রস্তর সরঞ্জাম রয়েছে, তেমনি পাল ও সেন আমলের ভাস্কর্য, বৌদ্ধ স্তূপ, দেবদেবীর মূর্তি এবং মুসলিম যুগের শিলালিপি, মুদ্রা, অলঙ্কারও পাওয়া যায়। এর মাধ্যমে বোঝা যায় যে, বরেন্দ্র অঞ্চল কেবল একটি নির্দিষ্ট সংস্কৃতির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং বহু সভ্যতা ও সংস্কৃতির মিলনস্থল হিসেবে বিকশিত হয়েছিল।

অন্যদিকে, বরেন্দ্র জাদুঘর কেবল ইতিহাস সংরক্ষণ করছে না, বরং বর্তমান প্রজন্মকে অতীতের সাথে পরিচিত করিয়ে দিচ্ছে। শিক্ষার্থীরা এখানে এসে প্রত্নতত্ত্ব ও ইতিহাসের বাস্তব নিদর্শন স্পর্শ করতে পারে, গবেষকরা গভীরতর অনুসন্ধানের সুযোগ পান, আর সাধারণ দর্শনার্থীরা নিজেদের শেকড়ের সাথে সংযোগ অনুভব করতে পারেন।

তবে এ জাদুঘরের সীমাবদ্ধতাও অস্বীকার করা যায় না। পর্যাপ্ত সংরক্ষণ প্রযুক্তির অভাব, আধুনিক প্রদর্শনী ব্যবস্থা না থাকা এবং আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন ব্যবস্থাপনার ঘাটতির কারণে এর সম্ভাবনা পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। এই কারণে অনেক মূল্যবান নিদর্শন ক্ষয়প্রাপ্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়ে গেছে।

তবুও বলা যায়, বরেন্দ্র জাদুঘর বাংলাদেশের এক অমূল্য সম্পদ। এটিকে সঠিকভাবে সংরক্ষণ ও আধুনিকায়নের মাধ্যমে কেবল জাতীয় নয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়েও তুলে ধরা সম্ভব। বরেন্দ্র জাদুঘরকে ঘিরে গড়ে উঠতে পারে এক সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক পর্যটন শিল্প, যা দেশের অর্থনীতি ও ভাবমূর্তিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

সবশেষে বলা যায়, বরেন্দ্র জাদুঘর হলো বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের ইতিহাসের দর্পণ। এটি কেবল অতীতের নিদর্শন সংরক্ষণ করে না, বরং বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অতীতের সাথে যুক্ত করে। এই জাদুঘর যতদিন থাকবে, ততদিন আমাদের সাংস্কৃতিক পরিচয় ও ঐতিহ্যের শেকড়কে শক্তভাবে ধরে রাখবে এবং বিশ্ববাসীর কাছে বাঙালির সমৃদ্ধ ইতিহাসকে তুলে ধরবে।

তথ্যসূত্র

রহমান, মুহাম্মদ হাবিবুর। বাংলাদেশের প্রত্নতত্ত্ব ও জাদুঘর। ঢাকা: বাংলা একাডেমি, ২০০৫।

Chowdhury, A.M. Archaeology of Bengal. Rajshahi: Varendra Research Museum Publications, 1995.

ইসলাম, সেলিমুল। বরেন্দ্রভূমির প্রত্নতত্ত্ব। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনা, ২০১২।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ। বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়ামের ইতিহাস। (আধিকারিক প্রকাশনা, ২০২০)।

সরকার, অশোক কুমার। “বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর ও তার গুরুত্ব।” ইতিহাস জার্নাল, খণ্ড ১২, সংখ্যা ২, ২০১৫।

Rajshahi University Archive – Varendra Research Museum official documents (Accessed 2023)।

Itihasar Golpo
Itihasar Golpohttps://itihasargolpo.com
Step into the past with our unforgettable historical journey. Discover the secrets of history on our captivating journey.
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments