Friday, October 3, 2025
Homeসংস্কৃতিব্যালে নৃত্য ও শাস্ত্রীয় সংগীত

ব্যালে নৃত্য ও শাস্ত্রীয় সংগীত

ব্যালে নৃত্য ও শাস্ত্রীয় সংগীত

ব্যালে নৃত্য ও শাস্ত্রীয় সংগীত—এই দুটি শৈল্পিক মাধ্যম বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের দুইটি অনন্য রত্ন। এগুলো শুধু শিল্প বা বিনোদনের মাধ্যমই নয়, বরং সমাজ, সংস্কৃতি এবং ইতিহাসের গভীর প্রতিফলন। ব্যালে এবং শাস্ত্রীয় সংগীত উভয়ই শৃঙ্খলা, সৌন্দর্য এবং আত্মপ্রকাশের এক বিশুদ্ধ রূপ, যা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বিকশিত হয়ে আজকের রূপ ধারণ করেছে।

ব্যালে হচ্ছে নৃত্য ও নৃত্যকলা কৌশলের এক সমন্বিত রূপ। ব্যালেতে নাচ, মূকাভিনয়, অভিনয় এবং সঙ্গীতের (কন্ঠ ও যন্ত্র) সমন্বয়ে শিল্প সৃষ্টি করা হয়। ব্যালে একক ভাবে বা অপেরার অংশ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। অভাবনীয় শারিরীক কৌশলের সাথে সঙ্গীতের এক অপূর্ব মিলন দেখা যায় ব্যালেতে। বিশেষ করে পায়ের কাজের তো তুলনাই হয়না।

ব্যালে নৃত্য: নীরব ভাষার শৈল্পিক রূপ

ব্যালের উৎপত্তি:
ব্যালের সূচনা হয় ১৫শ শতকের ইতালিতে, বিশেষত রাজদরবারে, যেখানে এটি একটি রাজকীয় বিনোদন হিসেবে বিকশিত হয়। পরবর্তীতে এটি ফ্রান্সে প্রবেশ করে এবং রাজা চতুর্দশ লুই-এর পৃষ্ঠপোষকতায় ব্যালের আধুনিক রূপ গড়ে ওঠে। ফরাসি রাজার সময়ে “অ্যাকাডেমি রোয়াল দ্যে দান্স” প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ব্যালে ধীরে ধীরে একটি প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পরূপে পরিণত হয়।

মূলতঃ পাশ্চাত্য এই শিল্পের ইতিহাসে দেখা যায় যে, দোমিনিকো ড্য পিয়াসেনজা ই (১৩৯০-১৪৭০) তার ব্যালেটি বা ব্যালি (baletti or balli)‘তে সর্বপ্রথম নাচের (dance) এর পরিবর্তে ব্যালো (ballo) শব্দটি ব্যবহার করেন; সেখান থেকেই ব্যালে শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে। তবে প্রথম সতিকারের ব্যালে অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৫৮১ সালে। বালথাসার ড্য ব্যজ্যঁইইউ এর ব্যালে কমিক ড্য লা রোয়েন । ১৫৮১ সালে ফ্যাব্রিটিও কারোসো ব্যালে নৃত্যের উপর একটি টেকনিক্যাল ম্যানুয়েল প্রকাশ করেন । এর নাম ছিল ইল ব্যালেরিনো ।

ব্যালের বৈশিষ্ট্য:

ব্যালে একটি অত্যন্ত কাঠামোবদ্ধ নৃত্য, যার প্রতিটি অঙ্গভঙ্গি, ভঙ্গিমা এবং পদক্ষেপ সুনির্দিষ্ট নিয়মে সম্পন্ন হয়। ব্যালে মূলত পাঁচটি প্রাথমিক ‘পজিশন’-এর ভিত্তিতে গড়ে ওঠে, যার ওপর ভিত্তি করে অন্যান্য নৃত্যভঙ্গি তৈরি হয়। এটি সাধারণত ‘টুটু’ নামক বিশেষ পোশাকে পরিবেশিত হয় এবং ব্যালের ছাত্রদের দীর্ঘ সময় ধরে কঠোর অনুশীলনের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ নিতে হয়।

ব্যালের ধরণ:

ক্লাসিক্যাল ব্যালে:
এটি ব্যালের সবচেয়ে প্রাচীন ও কাঠামোবদ্ধ ধরণ। ‘দ্য নাটক্র্যাকার’, ‘সোয়ান লেক’, ‘দ্য স্লিপিং বিউটি’ ইত্যাদি বিখ্যাত ক্লাসিক্যাল ব্যালে উপস্থাপনাগুলি এই ঘরানার অন্তর্ভুক্ত।

নিও-ক্লাসিক্যাল ব্যালে:
এটি ২০শ শতকে উদ্ভূত হয়, যেখানে ক্লাসিক্যাল ব্যালের কাঠামো রক্ষা করা হলেও মঞ্চে ভিন্ন আঙ্গিক, সংক্ষিপ্ত পোশাক ও সুরের ভিন্নতা দেখা যায়। জর্জ বালানশিন এই ধারার একজন প্রধান পথপ্রদর্শক।

কন্টেম্পোরারি ব্যালে:
আধুনিক ব্যালের রূপ, যা আরও বেশি মুক্ত এবং সৃজনশীল। এতে শরীরের গতি-প্রকৃতি বেশি গুরুত্ব পায়, আর এক্সপ্রেশন বা অভিব্যক্তির ওপর জোর দেওয়া হয়।

ব্যালের আধ্যাত্মিক দিক:
ব্যালে কেবল দেহগত কসরত নয়; এটি এক ধরনের আত্ম-উপস্থাপনাও। একজন ব্যালে নৃত্যশিল্পী তার দেহের মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট আবেগ বা গল্প ব্যক্ত করেন। এতে মুখের অভিব্যক্তির পাশাপাশি প্রতিটি অঙ্গভঙ্গির নিখুঁততা একে শৈল্পিক উচ্চতায় পৌঁছে দেয়।

শাস্ত্রীয় সংগীত: ধ্বনির ধর্মীয় ও দার্শনিক সাধনা

শাস্ত্রীয় সংগীতের পরিচয়:
শাস্ত্রীয় সংগীত মূলত সেই সংগীতশৈলী যা নির্দিষ্ট নিয়ম, রাগ-রাগিণী, তাল ও লয় মেনে পরিবেশিত হয়। এই সংগীত ভারতীয়, পারস্য, ইউরোপীয় এবং চীনা সংস্কৃতিতেও বিভিন্নভাবে বিদ্যমান। তবে এখানে আমরা মূলত ভারতীয় ও ইউরোপীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের ওপর আলোকপাত করবো।

ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত

উৎপত্তি ও ঐতিহ্য:
ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের গোড়াপত্তন প্রায় ২০০০ বছরেরও বেশি পুরনো। এটি মূলত দুটি ধারায় বিভক্ত—হিন্দুস্তানী (উত্তর ভারতীয়) এবং কর্ণাটকী (দক্ষিণ ভারতীয়)। সংগীতশাস্ত্র যেমন ‘নাট্যশাস্ত্র’ এবং ‘সঙ্গীতরত্নাকর’-এ এর ভিত্তি বর্ণিত আছে।

রাগ ও তাল:
ভারতীয় সংগীতে রাগ একটি নির্দিষ্ট সুরধারার ভিত্তি। প্রতিটি রাগে থাকে নির্দিষ্ট স্বর, ওঠানামার নিয়ম এবং আবেগ বা রস (যেমন প্রেম, বিরহ, ভক্তি)। তাল হলো ছন্দের কাঠামো—যেমন তিনতাল (১৬ মাত্রা), একতাল (১২ মাত্রা), ঝাপতাল (১০ মাত্রা) ইত্যাদি।

বিশিষ্ট উপকরণ ও ধারা:
বাঁশি, সরোদ, সেতার, তবলা, তানপুরা—এই সব যন্ত্র ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতে ব্যবহৃত হয়। ধ্রুপদ, খেয়াল, ঠুমরি, টপ্পা প্রভৃতি হলো বিভিন্ন ধারার গান।

ইউরোপীয় শাস্ত্রীয় সংগীত

ইতিহাস ও গঠন:
ইউরোপীয় শাস্ত্রীয় সংগীত বা ‘ওয়েস্টার্ন ক্লাসিক্যাল মিউজিক’ মূলত মধ্যযুগে চার্চ সংগীত হিসেবে শুরু হয়। এরপর রেনেসাঁ, বারোক, ক্লাসিকাল, রোমান্টিক এবং আধুনিক যুগে এর বিবর্তন ঘটে। বাখ, মোজার্ট, বিটোভেন, চোপিন প্রমুখ এই ধারার প্রবাদপ্রতিম সুরকার।

সিম্ফনি, সনাটা, কনচেরটো:
এই সংগীতে বিভিন্ন ধরণের কাঠামো দেখা যায়। সিম্ফনি বড় অর্কেস্ট্রার জন্য, সনাটা এক বা দুই যন্ত্রের জন্য, এবং কনচেরটো একক বাদ্যযন্ত্র ও অর্কেস্ট্রার সম্মিলনে পরিবেশিত হয়।

সঙ্গীত যন্ত্রসমূহ:

ভায়োলিন, পিয়ানো, চেলো, ক্লারিনেট, হর্ন—এই সব যন্ত্রের সহযোগে শাস্ত্রীয় সংগীত পরিবেশন করা হয়। প্রতিটি যন্ত্রের নির্দিষ্ট ভূমিকা রয়েছে এবং একত্রে তারা মঞ্চে সৃষ্টি করে সুরের অপূর্ব সাম্য।

ব্যালে ও শাস্ত্রীয় সংগীতের মিল

গভীর শৃঙ্খলা ও প্রশিক্ষণ:
এই দুই শিল্পেই অনুশীলন, ধৈর্য, অধ্যবসায় অপরিহার্য।

আধ্যাত্মিকতা:
উভয় ক্ষেত্রেই শিল্পী আত্মার প্রকাশ ঘটান—শরীরের গতিতে বা ধ্বনির প্রবাহে।

সাহিত্য ও কাহিনি:
ব্যালে ও শাস্ত্রীয় সংগীতে উভয় ক্ষেত্রেই ইতিহাস, পৌরাণিক কাহিনি বা জীবনদর্শনের ভিত্তিতে নির্মিত উপস্থাপনা দেখা যায়।

ব্যালে নৃত্য ও শাস্ত্রীয় সংগীত—উভয়ই একটি গভীর ঐতিহ্যবাহী এবং উচ্চ মানসম্পন্ন শৈল্পিক অনুশীলন। এগুলো মনকে প্রসারিত করে, আত্মাকে প্রশান্তি দেয় এবং মানবিক অনুভবকে শিল্পরূপে প্রকাশ করে। আজকের আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর যুগেও এই দুই শিল্পরীতি মানুষকে ইতিহাস, সংস্কৃতি ও আত্মার সঙ্গে যুক্ত রাখতে সাহায্য করে। তাই এগুলোর চর্চা, সংরক্ষণ ও বিশ্বব্যাপী প্রচার অপরিহার্য।

তথ্যসূত্র:

The Ballet Companion, Eliza Gaynor Minden

Sangeet Ratnakar, Sharangadeva

Oxford History of Western Music

ভারতীয় সংগীতশাস্ত্র (রবিশংকর)

Encyclopaedia Britannica (online edition)

Itihasar Golpo
Itihasar Golpohttps://itihasargolpo.com
Step into the past with our unforgettable historical journey. Discover the secrets of history on our captivating journey.
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments