Friday, October 3, 2025
Homeস্থাপত্যবাঘা মসজিদ: স্থাপত্য ও ইতিহাসের অনন্য নিদর্শন

বাঘা মসজিদ: স্থাপত্য ও ইতিহাসের অনন্য নিদর্শন

বাঘা মসজিদ: স্থাপত্য ও ইতিহাসের অনন্য নিদর্শন

বাংলাদেশের রাজশাহী জেলার বাঘা উপজেলায় অবস্থিত বাঘা মসজিদ আমাদের দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক স্থাপত্য। এটি শুধু একটি ধর্মীয় উপাসনালয় নয়, বরং সমৃদ্ধ ইসলামি স্থাপত্য, শিল্পকলা ও ইতিহাসের এক উজ্জ্বল নিদর্শন। মসজিদটি ষোড়শ শতাব্দীর শুরুতে ইলিয়াস শাহি আমলে নির্মিত হয় বলে ধারণা করা হয় এবং আজও এটি স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যটকদের কাছে সমানভাবে আকর্ষণীয়।

নির্মাণকাল ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

বাঘা মসজিদের শিলালিপি থেকে জানা যায়, এটি নির্মিত হয়েছিল ১৫২৩–১৫২৪ খ্রিষ্টাব্দে (৯৩০ হিজরি) সুলতান নাসিরউদ্দিন নসরাত শাহের আমলে। তিনি ইলিয়াস শাহি বংশের শাসক ছিলেন। বাংলার সুলতানি আমল ছিল স্থাপত্য ও শিল্পকলার সোনালি যুগ, যখন অসংখ্য মসজিদ, মাদরাসা ও খানকাহ নির্মাণ করা হয়। মসজিদ নির্মাণের উদ্দেশ্য ছিল কেবল ধর্মীয় অনুশীলন নয়, বরং মুসলিম সম্প্রদায়ের শিক্ষা ও সামাজিক জীবনের কেন্দ্র তৈরি করা। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময় এই মসজিদের সংস্কার করা হয় এবং মসজিদের গম্বুজগুলো ভেঙ্গে গেলে ধ্বংসপ্রাপ্ত মসজিদে নতুন করে ছাদ দেয়া হয় ১৮৯৭ সালে।

অবস্থান ও পরিমাপ

অবস্থান: রাজশাহী জেলার বাঘা উপজেলায়, রাজশাহী শহর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে।

আয়তন: মসজিদের দৈর্ঘ্য প্রায় ৭৫ ফুট এবং প্রস্থ প্রায় ৪২ ফুট।

চতুর্দিকে একটি বিশাল পাকা প্রাচীর এবং প্রবেশদ্বার রয়েছে, যা মসজিদের গাম্ভীর্য বৃদ্ধি করেছে।

স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য

বাঘা মসজিদ বাংলার সুলতানি আমলের স্থাপত্যের উৎকৃষ্ট উদাহরণ। মসজিদটি ২৫৬ বিঘা জমির ওপর অবস্থিত। সমভুমি থেকে ৮-১০ ফুট উঁচু করে মসজিদের আঙিনা তৈরি করা হয়েছে। উত্তর পাশের ফটকের ওপরের স্তম্ভ ও কারুকাজ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। এর প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো হলো—

মসজিদটিতে ১০টি গম্বুজ আছে । আর ভেতরে রয়েছে ৬টি স্তম্ভ। মসজিদটিতে ৪টি মেহরাব রয়েছে যা অত্যন্ত কারুকার্য খচিত। দৈর্ঘ্য ৭৫ ফুট প্রস্থ ৪২ ফুট, উচ্চতা ২৪ ফুট ৬ ইঞ্চি। দেয়াল চওড়া ৮ ফুট গম্বুজের ব্যাস ৪২ ফুট, উচ্চতা ১২ ফুট। চৌচালা গম্বুজের ব্যাস ২০ ফুট উচ্চতা প্রায় ৩০ ফুট।

মাঝখানের দরজার ওপর ফার্সি ভাষায় লেখা একটি শিলালিপি রয়েছে। মসজিদটির গাঁথুনি চুন-সুরকি দিয়ে। ভেতরে এবং বাইরের দেয়ালে মেহরাব ও স্তম্ভ রয়েছে। বাঘা মসজিদের দৈর্ঘ্য ২২.৯২ মিটার, প্রস্থ ১২.১৮ মিটার এবং উচ্চতা ২৪ ফুট ৬ ইঞ্চি। এর দেয়াল ২.২২ মিটার পুরু। মসজিদটিতে সর্বমোট ১০টি গম্বুজ, ৪টি মিনার (যার শীর্ষদেশ গম্বুজাকৃতির) এবং ৫টি প্রবেশদ্বার রয়েছে। এই মসজিদটি চারদিক হতে প্রাচীর দিয়ে ঘেরা এবং প্রাচীরের দু’দিকে দু’টি প্রবেশদ্বার রয়েছে। মসজিদের ভিতরে-বাইরে সবর্ত্রই টেরাকোটার নকশা বর্তমান। মসজিদের পাশে অবস্থিত বিশাল দিঘীও একটি দর্শনীয় স্থান। এছাড়া বাঘা মসজিদের পাশেই রয়েছে একটি মাজার শরীফ।

মিহরাব ও অভ্যন্তরীণ নকশা

পশ্চিম দেওয়ালে মোট পাঁচটি মিহরাব রয়েছে। মিহরাবগুলো টেরাকোটা অলংকরণে সজ্জিত। ভেতরের দেয়ালজুড়ে রয়েছে লতাপাতা, জ্যামিতিক নকশা, ফুল ও আরবী ক্যালিগ্রাফির সমন্বয়ে গড়া কারুকাজ।

বাইরের অলংকরণ

বাহ্যিক দেয়ালও অলংকৃত ছিল। লাল ইট ও পোড়ামাটির টেরাকোটা প্যানেলের সমন্বয়ে দেয়ালে শৈল্পিক সৌন্দর্য আনা হয়েছে। বর্গাকার ও অর্ধবৃত্তাকার খিলান ব্যবহারের মাধ্যমে স্থাপত্যে দৃঢ়তা ও নান্দনিকতা সৃষ্টি হয়েছে।

টেরাকোটা শিল্পকলা

বাঘা মসজিদের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো এর টেরাকোটা অলংকরণ। টেরাকোটা ফলকে ফুল, লতা, নকশা, আরবী লিপি ও জ্যামিতিক মোটিফ ব্যবহার করা হয়েছে। এগুলো বাংলার গ্রামীণ শিল্পকলা ও ইসলামি নান্দনিকতার সমন্বয়ে তৈরি। প্রতিটি টেরাকোটা প্যানেল আলাদাভাবে হাতে বানানো, যা নির্মাণকালে শিল্পীদের দক্ষতা প্রকাশ করে।

ধর্মীয় ও সামাজিক ভূমিকা

মসজিদটি নির্মিত হয়েছিল কেবল নামাজ আদায়ের জন্য নয়, বরং স্থানীয় মুসলিম সমাজের কেন্দ্র হিসেবে। এখানে ধর্মীয় শিক্ষা, সমাজিক মিলনমেলা ও ধর্মপ্রচার কার্যক্রম পরিচালিত হতো। বাঘা ছিল বাংলার একটি গুরুত্বপূর্ণ আধ্যাত্মিক কেন্দ্র। কাছেই সুফি সাধক শাহ দৌলাহ মসজিদের কার্যক্রমে যুক্ত ছিলেন বলে লোককথা রয়েছে।

সংস্কার ও সংরক্ষণ

দীর্ঘ কয়েকশ বছর ধরে বাঘা মসজিদ সময়ের আঘাত সহ্য করেছে। ভূমিকম্প, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও অবহেলায় এর কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে মসজিদের কিছু অংশ ভেঙে পড়ে। পরবর্তীতে পাকিস্তান আমলে এবং পরে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এর সংস্কার কাজ করে। বর্তমানে এটি প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধীনে সুরক্ষিত ঐতিহাসিক নিদর্শন।

শিল্প ও স্থাপত্যের গুরুত্ব

বাঘা মসজিদকে বাংলার ইসলামি স্থাপত্যের “টেরাকোটা শিল্পের অনন্য উদাহরণ” বলা হয়। এটি গৌড় ও বাগেরহাটের মসজিদগুলির সাথে শৈল্পিক মিল রাখে। বাংলার সুলতানি স্থাপত্যের জ্যামিতিক পরিকল্পনা, শক্তিশালী গম্বুজ বিন্যাস এবং অলংকরণের ধারাবাহিকতা এতে ফুটে উঠেছে।

পর্যটন আকর্ষণ

বর্তমানে বাঘা মসজিদ রাজশাহীর একটি প্রধান পর্যটন কেন্দ্র। দেশি ও বিদেশি পর্যটকরা এটি দেখতে আসেন। প্রতিবছর ইসলামি উৎসব ও স্থানীয় মেলা উপলক্ষে এখানে মানুষের ভিড় জমে। এ মসজিদ সংলগ্ন এলাকায় প্রতিবছর ঈদুল ফিতরের দিন থেকে ৩ দিন পর্যন্ত ‘বাঘার মেলা’র আয়োজন করা হয়। এ মেলাটি ৫০০ বছরের ঐতিহ্য।  স্থানীয় অর্থনীতিতেও পর্যটন একটি অবদান রাখছে।

বাঘা মসজিদ শুধুমাত্র একটি ঐতিহাসিক ধর্মীয় স্থাপনা নয়, বরং এটি বাংলার শিল্প, স্থাপত্য, ধর্মীয় জীবন এবং সামাজিক সংস্কৃতির একটি জীবন্ত দলিল। ষোড়শ শতাব্দীর সূচনালগ্নে যখন বাংলার মুসলিম সুলতানরা রাজ্য শাসন করছিলেন, তখন ইসলামি সভ্যতার বিকাশ এবং শিল্পকলার বিকাশের এক অনন্য ধারা এই মসজিদে ফুটে ওঠে। এর প্রতিটি ইট, টেরাকোটা ফলক, খিলান ও গম্বুজ সেই সময়কার কারিগরদের দক্ষতা এবং নান্দনিকতার উৎকৃষ্ট নিদর্শন।

বাঘা মসজিদ থেকে আমরা শুধু স্থাপত্যশৈলীর উৎকর্ষই পাই না, বরং বাংলার ইতিহাসের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বাস্তবতাও উপলব্ধি করি। এখানে ধর্মীয় অনুশীলন, শিক্ষা এবং সামাজিক মিলনমেলা অনুষ্ঠিত হতো, যা স্থানীয় মুসলিম সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল। একইসাথে, টেরাকোটা অলংকরণে ব্যবহৃত মোটিফগুলো প্রমাণ করে যে বাংলার ইসলামি স্থাপত্য স্থানীয় শিল্প-সংস্কৃতি ও প্রকৃতির সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত ছিল।

কালের আঘাত, ভূমিকম্প এবং অবহেলায় বহু অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও আজও বাঘা মসজিদ আমাদের ইতিহাসের স্থায়ী সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের উদ্যোগে এর সংরক্ষণ কাজের ফলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মও এই স্থাপত্যকীর্তির মাহাত্ম্য অনুভব করতে পারছে।

আজকের দিনে বাঘা মসজিদ শুধু একটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা নয়, বরং পর্যটন, শিক্ষা এবং গবেষণার জন্যও একটি অনন্য কেন্দ্র। এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব, শৈল্পিক সৌন্দর্য এবং ধর্মীয় মূল্যবোধ আমাদের জাতিকে গৌরবান্বিত করে।

তাই বলা যায়—বাঘা মসজিদ হলো বাংলার ইসলামি স্থাপত্য ঐতিহ্যের একটি অমূল্য রত্ন, যা আমাদের পরিচয়, গৌরব এবং ইতিহাসের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে। এর সংরক্ষণ ও প্রচার কেবল প্রত্নতাত্ত্বিক দায়িত্ব নয়, বরং আমাদের সাংস্কৃতিক অস্তিত্ব রক্ষারও প্রতীক।

তথ্যসূত্র

আহমেদ, নাজিমুদ্দিন (১৯৮৪). ইসলামিক আর্কিটেকচার ইন বাংলাদেশ. ঢাকা: ইসলামিক ফাউন্ডেশন।

খান, এ.এফ.এম. (১৯৯২). বাংলাদেশের প্রত্নতত্ত্ব ও স্থাপত্য. ঢাকা: বাংলা একাডেমি।

Directorate of Archaeology, Bangladesh – অফিসিয়াল প্রকাশনা ও সংরক্ষণ নথি।

বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর (সরকারি ওয়েবসাইট ও সংরক্ষণ প্রকল্প প্রতিবেদন)।

Itihasar Golpo
Itihasar Golpohttps://itihasargolpo.com
Step into the past with our unforgettable historical journey. Discover the secrets of history on our captivating journey.
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments