Friday, October 3, 2025
Homeসভ্যতাব্যাবিলনীয় সভ্যতা

ব্যাবিলনীয় সভ্যতা

ব্যাবিলনীয় সভ্যতা

ব্যাবিলনীয় সভ্যতা (Babylonian Civilization) ছিল প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার (বর্তমান ইরাক) একটি গুরুত্বপূর্ণ সভ্যতা যা টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে গড়ে উঠেছিল। এই সভ্যতার কেন্দ্রস্থল ছিল ব্যাবিলন (Babylon) নামক একটি মহানগর, যা একসময় বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল ও সমৃদ্ধ শহর হিসেবে বিবেচিত হতো।

খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ১৮৯৪ সালে আমোরাইট জাতির রাজা সুমু-আবুম কর্তৃক ব্যাবিলন শহর প্রতিষ্ঠিত হয় এবং খ্রিস্টপূর্ব ৫৩৯ সাল পর্যন্ত এটি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে প্রভাব বিস্তার করে।

ভৌগোলিক অবস্থান ও প্রেক্ষাপট

ব্যাবিলন শহরটি অবস্থিত ছিল ইউফ্রেটিস নদীর তীরে, প্রাচীন সুমের ও আক্কাদীয় সভ্যতার উত্তরে। নদীগুলোর মাধ্যমে সেচব্যবস্থা গড়ে ওঠে এবং কৃষি উৎপাদন বাড়ে। এই উর্বর অঞ্চল ‘ফার্টাইল ক্রিসেন্ট’ নামেও পরিচিত। এই নদীসন্ধিস্থানে গড়ে ওঠা সভ্যতাটি পরবর্তীতে ব্যাবিলনীয় সাম্রাজ্যে পরিণত হয়।

ব্যাবিলনের উত্থান ও হামুরাবির শাসন

ব্যাবিলনীয় সভ্যতার প্রথম স্বর্ণযুগ আসে হামুরাবির (Hammurabi) শাসনে (১৭৯২-১৭৫০ খ্রিস্টপূর্ব)। তিনি একজন দক্ষ প্রশাসক ও আইনপ্রণেতা ছিলেন। হামুরাবি প্রথম ব্যাবিলনীয় সাম্রাজ্য গঠন করেন, যার বিস্তার ছিল সমগ্র দক্ষিণ মেসোপটেমিয়া জুড়ে।

হামুরাবির সংহিতা (Code of Hammurabi) ছিল বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন লিখিত আইনগ্রন্থ, যাতে ২৮২টি ধারা ছিল। এতে “চোখের বদলে চোখ” নীতির প্রতিফলন দেখা যায়। এই আইন শ্রমিক, কৃষক, ব্যবসায়ী এবং পরিবারের সদস্যদের অধিকার ও দায়িত্ব নির্ধারণ করেছিল, যা প্রাচীন আইনের ইতিহাসে যুগান্তকারী ভূমিকা রেখেছে।

ব্যাবিলনীয় সভ্যতার রাজা হাম্বুরাবি একটি উল্লেখযোগ্য নাম। তিনি ছিলেন ব্যাবিলনের ষষ্ঠ রাজা। তিনি খ্রীষ্টপূর্ব ১৭৯২অব্দে ব্যাবিলনের রাজা হন। তিনি খন্ড-বিখন্ড নগররাষ্ট্রগুলোকে একত্রিত করে একটি শক্তিশালী রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন।

তার শাসনামলকে ব্যাবিলনের ইতিহাসে স্বর্ণযুগ বলা হয়। পৃথিবীতে প্রথম লিখিত আইন প্রচলন হয় ব্যাবিলনে যার প্রণেতা ছিলেন বিখ্যাত অ্যামোরাইট নেতা হাম্মুরাবি। ব্যাবিলনের সর্বাধিপতি এ রাজা খ্রীষ্টপূর্ব ১৭৫০ অব্দে মৃত্যুবরণ করেন।

রাজনীতি ও প্রশাসন

ব্যাবিলনীয় শাসনব্যবস্থা ছিল রাজতান্ত্রিক। রাজা ছিল ঈশ্বরপ্রদত্ত শক্তির অধিকারী এবং সর্বোচ্চ বিচারক ও সেনাপতি। প্রতিটি শহর ছিল একটি প্রশাসনিক কেন্দ্র, এবং প্রাদেশিক গভর্নররা রাজার নিযুক্ত প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করত। কর আদায়, সেচ ব্যবস্থা ও আইন প্রয়োগে ব্যাবিলনীয় প্রশাসন ছিল সুশৃঙ্খল।

সমাজ

ব্যাবলনীয় সমাজ তিন শ্রেণীতে বিভক্ত ছিলো। উচু শ্রেণীতে ছিলো রাজা, পণ্ডিত, পুরোহিত ও সৈন্য। এদের নিজস্ব জমি ছিলো। শিল্পী ও স্বাধীন ব্যবসায়ীরা ছিলেন মধ্য শ্রেণীতে। আর নিন্ম শ্রেণীতে ছিলো কৃষক, সাধারণ শ্রমিক ও দাসরা। ব্যাবলনীয় সমাজে যুদ্ধবন্দীদের দাস করা হতো।

ধর্ম ও দেবদেবী

ব্যাবিলনীয়রা বহু দেবতার উপাসক ছিল। তাদের প্রধান দেবতা ছিল মার্দুক (Marduk), যিনি ব্যাবিলনের পৃষ্ঠপোষক দেবতা হিসেবে পূজিত হতেন। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ও মন্দির জীবন ছিল সমাজের কেন্দ্রে। বিখ্যাত জিগুরাত (Ziggurat) মন্দির, বিশেষ করে “ইটেমেনানকি”, ছিল দেবতাদের বাসস্থান বলে বিশ্বাস করা হতো।

তারা মৃত্যুর পর জীবন, অশরীরী আত্মা ও ভাগ্যের প্রতি গভীর বিশ্বাস রাখত এবং জ্যোতিষচর্চা, স্বপ্ন বিশ্লেষণ ইত্যাদিকে গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় কার্যকলাপ হিসেবে দেখত।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

ব্যাবিলনীয় সভ্যতা গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান ও চিকিৎসাশাস্ত্রে অগ্রণী ছিল। তারা ষাটভিত্তিক গণনা পদ্ধতি (sexagesimal system) উদ্ভাবন করে, যার প্রভাবে আজও ঘন্টাকে ৬০ মিনিটে, মিনিটকে ৬০ সেকেন্ডে ভাগ করা হয়।

তারা চন্দ্র ও সৌরচক্র পর্যবেক্ষণ করে বছর ও মাস নির্ধারণ করেছিল। ব্যাবিলনীয় জ্যোতির্বিদগণ গ্রহের গতি, গ্রহণ, সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত পর্যবেক্ষণ করত এবং ক্যালেন্ডার তৈরি করেছিল। এমনকি তারা জ্যোতিষ (astrology)-এর ভিত্তিও স্থাপন করে।

সাহিত্য ও লিপি

ব্যাবিলনীয়রা আক্কাদীয় ভাষায় কিউনিফর্ম (cuneiform) লিপিতে লিখত। কাদামাটি ফলকে (clay tablets) পেরেক-আকৃতির অক্ষরে লেখা হতো। ব্যাবিলনীয় সাহিত্যে “এনুমা এলিশ” (Enuma Elish) নামক সৃষ্টির কাহিনি, “গিলগামেশ মহাকাব্য” (Epic of Gilgamesh), প্রেম, যুদ্ধ, জ্যোতিষ ও চিকিৎসাবিষয়ক নানা গ্রন্থ ছিল।

অর্থনীতি ও বাণিজ্য

ব্যাবিলনীয় অর্থনীতি কৃষিনির্ভর ছিল। ইউফ্রেটিস নদীর পানি ব্যবহার করে চাষাবাদ হতো—যেমন যব, গম, খেজুর। এছাড়াও পশুপালন, মৃৎশিল্প, ধাতব কাজ ছিল গুরুত্বপূর্ণ।

বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও ব্যাবিলন অগ্রগামী ছিল। তারা মিশর, সিন্ধু উপত্যকা, আনাতোলিয়া ও পারস্যের সঙ্গে বাণিজ্য করত। চালান ব্যবস্থাপনা, সুদসহ ঋণ, জমি কেনাবেচা ও হিসাবরক্ষণে তারা উন্নত ছিল।

স্থাপত্য ও নগর পরিকল্পনা

ব্যাবিলন শহরটি ছিল দুর্ভেদ্য প্রাচীরঘেরা, সুবিশাল ও সুপরিকল্পিত নগর। এখানে রাজপ্রাসাদ, মন্দির, বাজার ও সেচনালী ছিল। “হ্যাংগিং গার্ডেনস অব ব্যাবিলন” (Hanging Gardens of Babylon) বিশ্বের সাত প্রাচীন আশ্চর্যের একটি বলে ধরা হয়, যদিও এর অস্তিত্ব নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।

ব্যাবিলনের পতন

প্রথম ব্যাবিলনীয় সাম্রাজ্য হিট্টিদের আক্রমণে (খ্রিস্টপূর্ব ১৫৯৫) ধ্বংস হয়। পরবর্তীতে কাশশু, আসিরিয়ান ও চ্যালডীয় (নব ব্যাবিলনীয়) শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। নব ব্যাবিলনীয় রাজা নবূচাদনেজার দ্বিতীয় (Nebuchadnezzar II) ব্যাবিলন শহরকে সর্বোচ্চ জৌলুশে পৌঁছান। তিনি ইহুদিদের জেরুজালেম থেকে বন্দি করে ব্যাবিলনে নিয়ে আসেন (Babylonian Captivity)।

৫৩৯ খ্রিস্টপূর্বে পারসিয়ান সম্রাট সাইরাস মহান ব্যাবিলন দখল করেন এবং ব্যাবিলনীয় যুগের অবসান ঘটে।

ব্যাবিলনীয় সভ্যতার প্রভাব

ব্যাবিলনীয় সভ্যতা পশ্চিমা আইনি, ধর্মীয় ও জ্যোতির্বিদ্যাগত চিন্তাধারার ভিত্তি গড়ে দিয়েছে। প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার, কিউনিফর্ম লিপি, গণিত পদ্ধতি এবং ধর্মীয় আচার আজও ইতিহাসবিদ, প্রত্নতত্ত্ববিদ ও বিজ্ঞানীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার বিষয়।

ব্যাবিলনীয় সভ্যতা ছিল জ্ঞান, ন্যায় এবং সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধির একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এর আইন, সাহিত্য, ধর্ম এবং প্রযুক্তি প্রাচীন সভ্যতাকে আধুনিক মানবসমাজের দিকে এগিয়ে নিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। হাজার হাজার বছর আগের এই মহানগর ও সভ্যতার স্মৃতি আজও আমাদের বিস্মিত করে।

তথ্যসূত্র:

Kramer, Samuel Noah. History Begins at Sumer

Roux, Georges. Ancient Iraq

British Museum: Mesopotamia Archives

Encyclopaedia Britannica: Babylonian Civilization

Itihasar Golpo
Itihasar Golpohttps://itihasargolpo.com
Step into the past with our unforgettable historical journey. Discover the secrets of history on our captivating journey.
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments