আজটেক সভ্যতা: এক জটিল ও শক্তিশালী প্রাচীন সাম্রাজ্যের ইতিহাস
আজটেক সভ্যতা (Aztec Civilization) ছিল মেসোআমেরিকার এক প্রভাবশালী ও সমৃদ্ধ সংস্কৃতি, যা বর্তমান মেক্সিকোর কেন্দ্রীয় উচ্চভূমিতে ১৪শ শতকের শেষভাগ থেকে ১৬শ শতকের শুরু পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে। এরা ছিল চমৎকার নগর-নির্মাতা, কৃষক, যোদ্ধা এবং ধর্মানুরাগী মানুষ, যাদের জীবনচর্চা ছিল ধর্ম, রাজনীতি এবং সামরিক শক্তির এক অপূর্ব মিশ্রণ।
উৎপত্তি ও স্থান
আজটেকরা নিজেদেরকে Mexica (মেশিকা) বলে পরিচয় দিত। তারা মূলত উত্তর মেক্সিকো থেকে আগত একটি নামাদী জাতি, যারা দীর্ঘ ভ্রমণের পর ১৩২৫ খ্রিস্টাব্দে Texcoco হ্রদের মধ্যে একটি দ্বীপে Tenochtitlán শহর প্রতিষ্ঠা করে। এই শহরটি পরবর্তীতে আজটেক সাম্রাজ্যের রাজধানী হয়, যা আজকের মেক্সিকো সিটির পূর্বসূরী।
তাদের ধর্মীয় কাহিনিতে বলা হয়, ঈশ্বর Huitzilopochtli তাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন এমন একটি জায়গা খুঁজে নিতে, যেখানে একটি ক্যাকটাসের উপর ঈগল একটি সাপ খাচ্ছে। এই প্রতীক আজও মেক্সিকোর জাতীয় পতাকায় বিদ্যমান।
রাজধানী
ধীরে ধীরে আজটেক জনসংখ্যা বাড়তে থাকে; ছোট গ্রাম থেকে তেনোচতিৎলান একটি বড় শহরে পরিণত হয়। আজটেকরা শক্তিশালী সেনাবাহিনীও গঠন করে। রাজধানী তেনোচতিৎলানই ছিল এ অঞ্চলের সকল ব্যবসা বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র। ওই সময় প্রায় ২০ লক্ষ অধিবাসী নিয়ে তেনোচতিৎলান শহর ছিল তৎকালীন বিশ্বের সবচেয়ে বড় শহরগুলোর মধ্যে একটি।
প্রশাসন ও রাজনীতি
আজটেক সাম্রাজ্য ছিল একটি ত্রিত্বশাসিত জোট (Triple Alliance), যার সদস্য ছিল:
Tenochtitlán – কেন্দ্রীয় ও সবচেয়ে শক্তিশালী শহর
Texcoco – জ্ঞান ও শিক্ষা কেন্দ্র
Tlacopan – সামরিক সহায়তাকারী শহর
এই তিন শহর একসাথে আশপাশের অঞ্চল দখল করে এক বিশাল সাম্রাজ্যে রূপ নেয়, যার জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৫-৬ মিলিয়ন। সাম্রাজ্যের প্রধান শাসক ছিলেন Huey Tlatoani, যার ক্ষমতা ছিল প্রায় নিরঙ্কুশ।
ধর্ম ও বলি প্রথা
আজটেক ধর্ম ছিল বহুদেববাদী। তাদের প্রধান দেবতারা ছিলেন:
Huitzilopochtli – যুদ্ধ ও সূর্যদেবতা
Tlaloc – বৃষ্টির দেবতা
Quetzalcoatl – পালকযুক্ত সাপ, জ্ঞান ও সৃষ্টির দেবতা
Tezcatlipoca – রাত্রি ও ভাগ্যের দেবতা
তাদের বিশ্বাস ছিল, দেবতাদের শক্তি ধরে রাখতে হলে নিয়মিত মানব বলি দিতে হবে। বিশেষ উৎসব ও রাজকীয় অনুষ্ঠানে বন্দী যোদ্ধাদের হৃদয় উৎসর্গ করা হতো মন্দিরের শীর্ষে। যদিও আজকের দৃষ্টিতে এই প্রথা নিষ্ঠুর মনে হয়, তবুও এটি তাদের ধর্মীয় কাঠামোর অংশ ছিল।
কৃষি ও অর্থনীতি
আজটেকরা অত্যন্ত দক্ষ কৃষক ছিল। তারা Chinampa নামক ভাসমান ক্ষেতের মাধ্যমে ফসল ফলাতো—যা ছিল হ্রদের পানিতে ভাসমান ছোট দ্বীপের মতো। কৃষিকাজ ছিল আজটেক অর্থনীতির প্রধান চালিকা। পাঁচটি হ্রদের সংযোগস্থলে মেক্সিকো উপত্যকার অববাহিকা ছিল। অতি উর্বর ও চাষ উপযোগী হলেও যথেষ্ট পরিমাণ জমি এখানে ছিল না। আজটেকরা পাহাড়ের ঢাল কেটে সেখানে চাষাবাদ শুরু করে। জমির সর্বো্চ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে তাঁরা পানি সেচ ও সার দেয়া শুরু করে। তাদের সবচেয়ে বড় কৌশল ছিল ভাসমান কৃত্রিম দ্বীপ নির্মাণ।
তাঁরা খাগড়া বুনে বিশাল আস্তরণ তৈরি করে ও তার উপর মাটি স্তূপ করে এ কৃত্রিম দ্বীপ বানাতো। পরে এগুলো তাঁরা হ্রদের পানিতে ছেড়ে দিতো। এ কৃত্রিম দ্বীপে তাঁরা শস্য, শাকসবজি ইত্যাদি চাষ করতে সমর্থ হয়। আজটেকদের কোনো চাকাযুক্ত বাহন কিংবা বহনকারী জন্তু ছিল না, তাঁরা কাঁধে করে বা ডিঙি নৌকায় করে মালপত্র আনা-নেওয়া করতো। বিপজ্জনক জায়গাগুলোতে বণিকবহরের সাথে সৈন্যবাহিনী থাকতো।
সংস্কৃতি
আজটেকদের সংস্কৃতিতে ধর্মীয় ধ্যান-ধারণার প্রভাব ছিল। গাছের বাকল ও দেয়ালে তাঁরা চমৎকার রঙের চিত্রকর্মের মাধ্যমে ধর্মীয় আচার অণুষ্ঠান, দেবতাদের প্রকাশ করতো।
আজটেক দিনপঞ্জি বা আজটেক ক্যালেন্ডার আজটেক সাম্রাজ্যের অন্যতম নিদর্শন হচ্ছে। এই দিনপঞ্জি ছিল একটি সুবিশাল পাথরের উপর খোদাই করা যার ভর ২২ মেট্রিক টন এবং ব্যাস ৩.৭ মিটার (১২ ফুট)। এ দিনপঞ্জি দিয়ে তারা পুরো মহাবিশ্বের প্রতীক হিসেবে চিন্তা করতো, যার কেন্দ্রে ছিল সূর্য। সূর্যের চারপাশে বিভিন্ন দিন ও বিভিন্ন স্বর্গ চক্রাকারে সাজানো।
শিল্প,বিজ্ঞান,শিক্ষাব্যবস্থা ও দর্শন
আজটেক শিল্পে ধর্মীয় প্রতীক, দেবতাদের মুখাবয়ব, পশু আকৃতি এবং জ্যামিতিক নকশা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তারা:
পাথর ও কাঠে ভাস্কর্য, আঁকা চিত্র (Codex), আলঙ্কারিক অলংকার নির্মাণে দক্ষ ছিল।
তারা চলমান দিনপঞ্জিকা (Tonalpohualli) ও সূর্যবর্ষের ক্যালেন্ডার (Xiuhpohualli) ব্যবহার করত। আজটেকরা চিকিৎসা,গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যায়ও পারদর্শী ছিল। অনেক বালক স্কুলে যেত এবং ধর্ম, গান, ইতিহাস ও যুদ্ধবিদ্যা শেখত।
আজটেকরা পিকটোগ্রাফ বা চিত্র দ্বারা ভাব প্রকাশ ও বাণিজ্য সম্পন্ন করতো। তাঁরা চিত্রের মাধ্যমেই গণনা করতো; যা ছিল সংখ্যা ‘২০’ কে ভিত্তি করে। একটি পতাকার ছবি দ্বারা কোনো কিছুর পরিমাণ ২০টি বা ২০ গুণ (১×২০=২০) বোঝানো হতো, একটি দেবদারু গাছের ছবি দ্বারা সেটার ২০ গুণ অর্থাৎ ৪০০ বোঝানো হতো, একটি থলের ছবি দ্বারা তারও ২০ গুণ অর্থাৎ ৮০০০ বোঝানো হতো।
হাতিয়ার ও সরঞ্জাম
আজটেকরা সাদামাটা হাতে তৈরি হাতিয়ার দিয়ে দৈনন্দিন কাজকর্ম করতো। মহিলারা তুলা থেকে সূতা এবং সূতা দিয়ে তারা কাপড় বুনতে জানত। তারা কাপড়ে রঙ করে ও সেলাই করে বিভিন্ন নকশা অঙ্কন করতো। তাঁরা আগুনে পুড়িয়ে বিভিন্ন ধরনের মাটির পাত্রও তৈরি করতে পারতো। পাত্রগুলো সাদা বা লাল রঙের হতো এবং এগুলোতে সাদা-কালো নকশা আঁকা হতো।
যুদ্ধ ও সামরিক শক্তি
আজটেক সাম্রাজ্য এক আক্রমণাত্মক সামরিক শাসনের মাধ্যমে টিকে ছিল। যুদ্ধে তারা বন্দী নেওয়াকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করত, কারণ যুদ্ধবন্দীদেরই প্রধানত বলি দেওয়া হতো। প্রত্যেক পুরুষ নাগরিককে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে হতো। সাহসী যোদ্ধারা পদোন্নতি পেত এবং সমাজে উচ্চ মর্যাদা পেত।
তাদের বিখ্যাত যোদ্ধা দল Jaguar warriors এবং Eagle warriors ছিল যুদ্ধশক্তির প্রতীক।
পতন ও স্প্যানিশ আগমন
১৫১৯ সালে স্প্যানিশ অভিযাত্রী হার্নান কর্তেস (Hernán Cortés) আজটেক ভূখণ্ডে এসে পৌছান। প্রথমে মোন্তেজুমা (Moctezuma II) নামক সম্রাট তাকে স্বাগত জানান, সম্ভবত তাকে দেবতা ভেবে। কিন্তু পরবর্তীতে স্প্যানিশরা কৌশলে Tenochtitlán দখল করে নেয়।
১৫২১ সালে শহরটি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়, এবং অ্যাজটেক সভ্যতার পতন ঘটে। স্প্যানিশরা এরপর নতুন উপনিবেশ স্থাপন করে, যেটি পরবর্তীকালে নিউ স্পেন নামে পরিচিত হয়।
আজটেকদের উত্তরাধিকার
আজটেক সভ্যতা যদিও ধ্বংস হয়ে গেছে, কিন্তু তাদের সংস্কৃতি আজও মেক্সিকান পরিচয়ের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাদের ভাষা নাহুয়াতল (Nahuatl) এখনও প্রায় ১.৫ মিলিয়ন মানুষ ব্যবহার করে। মেক্সিকোর জাতীয় পতাকায় যে ঈগল-সাপ-ক্যাকটাসের প্রতীক রয়েছে, সেটিও সরাসরি আজটেক ধর্মীয় কাহিনী থেকে নেওয়া।
তাদের নির্মাণশৈলী, চিত্রলিপি, এবং ধর্মীয় কাহিনিগুলো আজও ইতিহাসবিদ, প্রত্নতত্ত্ববিদ এবং সাধারণ মানুষের কৌতূহলের বিষয়।
আজটেক সভ্যতা ছিল এক প্রগাঢ় ও বিস্তৃত সমাজব্যবস্থা, যেখানে ধর্ম, রাজনীতি, কৃষি, শিল্প ও যুদ্ধ একে অপরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত ছিল। এদের দৃষ্টিভঙ্গি অনেক ক্ষেত্রেই আধুনিক সমাজ থেকে আলাদা হলেও, তাদের জ্ঞান, সংগঠিত প্রশাসন ও সংস্কৃতির গভীরতা নিঃসন্দেহে চমকপ্রদ।
যদিও স্প্যানিশ উপনিবেশবাদের আঘাতে অ্যাজটেকরা মুছে যায়, তাদের স্মৃতি আজও মেক্সিকোর ইতিহাস ও জাতীয়তাবোধে জীবন্ত হয়ে আছে।
তথ্যসূত্র:
Michael E. Smith, The Aztecs, Wiley-Blackwell, 2003
The British Museum – Aztec Collections
World History Encyclopedia – Aztec Civilization
INAH (Instituto Nacional de Antropología e Historia), Mexico