আর্কিমিডিসের আবিষ্কার
আর্কিমিডিস (Archimedes) ছিলেন প্রাচীন গ্রীসের একজন অন্যতম প্রতিভাবান গণিতবিদ,প্রকৌশলী, জ্যোতির্বিদ এবং উদ্ভাবক। খ্রিস্টপূর্ব ২৮৭ সালে সিরাকিউস (বর্তমান সিসিলি দ্বীপ,ইতালি) শহরে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তার জ্ঞান,পর্যবেক্ষণশক্তি ও চিন্তার গভীরতা বিজ্ঞানের বহু শাখায় মৌলিক অবদান রেখেছে। বিশেষ করে পদার্থবিদ্যা ও গণিতে তার আবিষ্কার আজও আধুনিক বিজ্ঞানের ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হয়।
আর্কিমিডিসের সূত্র (Archimedes’ Principle)
আর্কিমিডিসের সবচেয়ে বিখ্যাত আবিষ্কার হচ্ছে “ভাসমান বস্তুর নীতি” বা Archimedes’ Principle। তিনি লক্ষ্য করেন যে, কোনো বস্তুকে যখন তরলে ডুবানো হয়, তখন তা একটি বল অনুভব করে যা বস্তুটিকে উপরে ঠেলে দেয়। এই বলের মান সমান হয় বস্তুটি যে পরিমাণ তরল স্থানচ্যুত করেছে তার ওজনের সমান।
এই সূত্রটি আবিষ্কারের একটি জনপ্রিয় গল্প রয়েছে। রাজা হিয়েরো সন্দেহ করেছিলেন যে তার জন্য বানানো সোনার মুকুটে চুরি করে কিছু রূপা মেশানো হয়েছে। আর্কিমিডিস সেই সন্দেহ নিরসনের দায়িত্ব পান। তিনি গোসলের টাবে ডুব দিয়ে হঠাৎ বুঝতে পারেন শরীর যখন পানিতে ডোবে, তখন পানি উপচে পড়ে। তখন তার মাথায় আসে যে মুকুটটির আয়তন পরিমাপ করে সোনা ও রূপার ঘনত্ব তুলনা করা সম্ভব। এই আনন্দে তিনি নগ্ন অবস্থায় দৌড়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েন এবং চিৎকার করেন— “ইউরেকা! ইউরেকা!”(Eureka! অর্থাৎ “পেয়েছি!পেয়েছি!”)
আর্কিমিডিস স্ক্রু (Archimedean Screw)
এটি ছিল একটি মেশিন যা পানি তোলার জন্য ব্যবহৃত হতো। এই যন্ত্রে একটি ঘূর্ণায়মান স্ক্রু ছিল,যা একটি ঢালের উপর ঘোরানোর মাধ্যমে নিচ থেকে উপরের দিকে পানি তুলতে পারত। এটি কৃষি এবং সেচকাজে খুব উপযোগী ছিল এবং আজও অনেক জায়গায় এই প্রযুক্তির ব্যবহার দেখা যায়। বিশেষ করে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বা নালায় পানি সরাতে।
পর্যায়গত লিভার ও টর্ক তত্ত্ব
আর্কিমিডিস বলেছিলেন— “আমাকে দাঁড়াবার একটা জায়গা দিন, আমি পৃথিবীটাকে নাড়িয়ে দেব।” এই উক্তি তার লিভার নীতির প্রতীক। তিনি প্রমাণ করেন যে, যথাযথ লিভার এবং Fulcrum (সমর্থনবিন্দু) ব্যবহার করে অতি ভারী বস্তুকেও তুলনামূলক ছোট শক্তি দিয়ে উত্তোলন করা সম্ভব।
লিভারের মৌলিক নীতিগুলোর গাণিতিক ব্যাখ্যা এবং বল প্রয়োগের কেন্দ্র (torque) নিয়েও তিনি গবেষণা করেন, যা আধুনিক মেকানিক্সে অপরিহার্য ভিত্তি তৈরি করে।
গণিত ও জ্যামিতিতে অবদান
আর্কিমিডিস গণিতে ছিলেন যুগান্তকারী। তিনি গণনার নানা পদ্ধতির আবিষ্কার করেন এবং গণিতের অনেক মৌলিক সূত্র গাণিতিক যুক্তি দ্বারা প্রমাণ করেন।
π (পাই) এর মান নির্ণয়
আর্কিমিডিস বহু কর্ণবিশিষ্ট বহুভুজ ব্যবহার করে বৃত্তের পরিধি ও ব্যাসের অনুপাত নির্ণয় করেন। তিনি প্রমাণ করেন যে π এর মান ২২/৭ এবং ২২৩/৭১-এর মধ্যে অবস্থিত। এই পদ্ধতি ছিল আধুনিক ক্যালকুলাসের পূর্বাভাস।
জ্যামিতিক প্রমাণ
তিনি বিভিন্ন জ্যামিতিক আকারের ক্ষেত্রফল ও আয়তন নির্ণয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। যেমন—প্যারাবোলার নিচের ক্ষেত্রফল, গোলকের আয়তন ও পরিধি, এবং ঘূর্ণায়মান পৃষ্ঠের ক্ষেত্রফল।
আর্কিমিডিসের থাবা
“দ্য ক্ল অভ আর্কিমিডিস” বা “আর্কিমিডিসের থাবা”একটি অস্ত্র যা আর্কিমিডিস তার শহর সিরাকিউজকে বহিঃস্থ আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য উদ্ভাবন করেছিলেন বলে বলা হয়ে থাকে। এ যন্ত্রটিতে একটি ক্রেনের ন্যায় বাহু এবং তাতে ঝুলানো একটি বিশাল ধাতব আংটা ছিল।
এই আংটার সাহায্যে আক্রমণকারী জাহাজকে উল্টে ফেলা হত। আধুনিককালে এই যন্ত্রের কার্যকারিতা নিয়ে বেশ কিছু পরীক্ষা করা হয়েছে। ২০০৫ সালে “সুপারউইপনস অভ দ্য এনসিয়েন্ট ওয়ার্ল্ড” নামের একটি টেলিভিশন ডকুমেণ্টারীতে এমন একটি যন্ত্র প্রস্তুত করা হয় এবং সিদ্ধান্ত দেয়া হয় যে এটি প্রস্তুত এবং সার্থকভাবে ব্যবহার করা সম্ভব।
যুদ্ধের যন্ত্রপাতি
আর্কিমিডিস সিরাকিউস শহর রক্ষায় বিভিন্ন যুদ্ধের যন্ত্র উদ্ভাবন করেন। যখন রোমানরা সিরাকিউস আক্রমণ করে,তখন আর্কিমিডিসের ডিজাইনকৃত যন্ত্রগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
কপিকল ও দোলনা
তিনি ভারী কাঁকড়া (Claw of Archimedes) নামক একটি বিশাল কপিকল তৈরি করেন,যা শত্রুপক্ষের জাহাজকে তুলে ফেলে দিতে পারত।
আয়না দিয়ে আগুন
কথিত আছে,আর্কিমিডিস বিশাল আয়না ব্যবহার করে সূর্যালোক প্রতিফলিত করে রোমান জাহাজে আগুন ধরিয়ে দেন। যদিও এই ঘটনা নিয়ে বিতর্ক আছে, তবুও এটি আর্কিমিডিসের মেধার পরিচায়ক।
সোনার মুকুট
আর্কিমিডিসের সবচেয়ে জনপ্রিয় আবিষ্কারগুলোর মধ্যে একটি ছিল অনিয়মিত আকারের বস্তুর আয়তন পরিমাপের পদ্ধতি। ভিট্রুভিয়াসের বিবরণ অনুযায়ী, রাজা দ্বিতীয় হিয়েরোর জন্য লরেল পাতার মুকুটের মত দেখতে একটি সোনার মুকুট প্রস্তুত করা হয়েছিল। আর্কিমিডিসকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল মুকুটটি খাঁটি সোনার কিনা সেটা নিশ্চিত করার।
সহজ পদ্ধতি ছিল মুকুটটি গলিয়ে তার ঘনত্ব নির্ণয় করা,কিন্তু রাজা মুকুটটি নষ্ট করতে রাজি ছিলেন না। আর্কিমিডিস যখন এ সমস্যা নিয়ে ভাবছিলেন, তখন হঠাৎ গোসল করতে গিয়ে তিনি লক্ষ করেন যে তিনি পানিতে নামা মাত্র বাথটাবের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তিনি বুঝতে পারেন যে পানির এই ধর্মকে ঘনত্ব পরিমাপে ব্যবহার করা সম্ভব।
যেহেতু ব্যবহারিক কাজের জন্য পানি অসংকোচনশীল,তাই পানিতে নিমজ্জিত মুকুট তার আয়তনের সমান পরিমাণ পানি স্থানচ্যুত করবে। এই অপসারিত পানির আয়তন দ্বারা মুকুটের ভরকে ভাগ করে মুকুটের ঘনত্ব পরিমাপ করা সম্ভব।
যদি মুকুটের উপাদানে সোনার সাথে অন্য কোন কম ঘনত্বের সস্তা ধাতু যোগ করা হয় তাহলে তার ঘনত্ব খাঁটি সোনার ঘনত্বের চেয়ে কম হবে। বলা হয়ে থাকে যে এই আবিষ্কার আর্কিমিডিসকে এতই উত্তেজিত করেছিল যে তিনি নগ্ন অবস্থায় শহরের রাস্তায় “ইউরেকা”(গ্রিক: “εὕρηκα!” ;অর্থ “আমি পেয়েছি!”)বলে চিৎকার করতে করতে দৌড়াতে শুরু করেছিলেন।
বাস্তবে আর্কিমিডিসের আবিষ্কৃত এই পদ্ধতিটি প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছিল,ঘনত্বের পার্থক্যের কারণে যে পরিমাণ পানি অপসারিত হবে সেটি সঠিকভাবে নির্নয় করা একটি কষ্টসাধ্য কাজ। এই সমস্যার সমাধান করা হয় fluid statics এর মাধ্যমে যেটি আর্কিমিডিস তত্ত্ব নামে পরিচিত। তত্ত্বটি তার On Floating Bodies প্রবন্ধে বর্ণনা করা হয়েছে। তত্ত্বে বলা হয়েছে যে ,কোন বস্তুর ওজন এটি দ্বারা অপসারিত পানির ওজনের সমান।
হাইড্রোস্ট্যাটিক্স ও মেকানিক্স
আর্কিমিডিসের লেখা “On Floating Bodies”(ভাসমান দেহ সম্পর্কে) বইতে তিনি হাইড্রোস্ট্যাটিক্স বিষয়ে নানা মৌলিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এই বইতে তিনি ব্যাখ্যা করেন কীভাবে বিভিন্ন আকারের বস্তুর উপর তরল ভিতরে কি ধরনের বল কাজ করে।
সাহিত্যকর্ম ও প্রভাব
আর্কিমিডিসের কিছু উল্লেখযোগ্য রচনা:
On the Sphere and Cylinder
Measurement of a Circle
The Sand Reckoner
On Floating Bodies
On Spirals
তার কাজগুলো পরবর্তীতে মুসলিম বিজ্ঞানী আল-খোয়ারিজমি,আল-বিরুনী এবং ইউরোপীয় পণ্ডিতদের মাধ্যমে ল্যাটিন ভাষায় অনূদিত হয়ে ইউরোপীয় রেনেসাঁ যুগে গভীর প্রভাব ফেলে।
মৃত্যুর করুণ ঘটনা
খ্রিস্টপূর্ব ২১২ সালে সিরাকিউস রোমানদের দ্বারা আক্রান্ত হলে আর্কিমিডিস নিহত হন। বলা হয়,তিনি মাটিতে একটি জ্যামিতিক চিত্র এঁকে গবেষণায় ব্যস্ত ছিলেন। এক রোমান সৈন্য তার কাছে গেলে আর্কিমিডিস বলেন,”আমার চিত্রের ক্ষতি করো না।”কিন্তু সৈন্যটি তাকে চিনতে না পেরে হত্যা করে। এই মৃত্যু ইতিহাসে বেদনাদায়ক জ্ঞানহারের একটি দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।
আর্কিমিডিস ছিলেন এমন এক প্রতিভা যিনি বিজ্ঞানের বহু শাখায় মৌলিক ধারণা দিয়ে গেছেন। তার আবিষ্কার শুধু তত্ত্বে নয়,বাস্তব জীবনেও গভীরভাবে প্রভাব ফেলেছে। আধুনিক বিজ্ঞানের অনেক ভিত্তি গড়ে উঠেছে তার তত্ত্ব ও আবিষ্কারের উপর। আজও তার কাজ গবেষণায় অনুপ্রেরণা হয়ে রয়েছে।
তথ্যসূত্র:
Heath, T.L. The Works of Archimedes, Dover Publications
Britannica.com – Archimedes Biography
History of Mathematics – Archimedes and Greek Mathematics