প্রাচীন পারস্য সভ্যতা: ইতিহাসের এক সমৃদ্ধ অধ্যায়
প্রাচীন পারস্য সভ্যতা ইতিহাসের অন্যতম গৌরবময় ও প্রভাবশালী সভ্যতা হিসেবে বিবেচিত। পারস্য, আজকের ইরান, ছিল এক সময়ের বিশ্বের বৃহত্তম সাম্রাজ্যের কেন্দ্রস্থল। এ সভ্যতার শাসকগণ শুধু যুদ্ধজয়ী ছিলেন না, তারা প্রশাসন, সংস্কৃতি, ধর্মীয় সহনশীলতা ও স্থাপত্যশিল্পেও অনন্য অবদান রেখেছেন। প্রাচীন পারস্য সভ্যতা একাধিক সাম্রাজ্যের উত্থান-পতনের সাক্ষী, যার মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হচ্ছে আকাশেমেনীয় (Achaemenid), পার্থীয় (Parthian), এবং সাসানীয় (Sasanian) সাম্রাজ্য।
প্রাচীন পারস্য সাম্রাজ্য আধুনিক পারস্য বা বর্তমানের ইরান এর থেকেও অনেক বিস্তৃত ছিল। এক সময় পারসিকরা মধ্যপ্রাচ্যর বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করত — তারা খ্রিস্টপূর্ব কয়েক শতাব্দী ধরে প্রাচীন গ্রীসের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল এবং পরে রোমান সাম্রাজ্যের প্রতিপক্ষ ছিল। পারসিকরা মিশর শাসন করেছে একসময় — পাশাপাশি ককেশাস এবং মধ্য এশিয়ার বড় অংশ এবং বর্তমানে পাকিস্তান এবং ভারতের অংশও শাসন করেছিল। তাদের সাম্রাজ্যের শীর্ষ সময়ে,বিশ্বের ৪০ শতাংশেরও বেশি মানুষ পারসিক শাসনের অধীনে ছিল, যা অন্য যেকোনো সাম্রাজ্যের চেয়ে বেশি।
ভাষা
প্রাচীন পারসিক ছিল আখেমেনীয় সাম্রাজ্যের সময় ব্যবহৃত অনেক ভাষার একটি, এর পাশাপাশি ব্যবহৃত হত ব্যাবিলনীয়, ইলামাইট, আরামীয় এবং এমনকি গ্রিক ভাষাও। এই বহু ভাষাভাষীর নীতি পার্থীয় এবং প্রথম দিকের সাসানিয়ান সাম্রাজ্যের সময়ও বজায় ছিল। তবে দেরি সাসানিয়ান যুগে মধ্য পারসিক ভাষা ইরানের বৃহত্তর অঞ্চলের প্রধান ভাষা হিসেবে আবির্ভূত হয় এবং শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এটি বিকশিত হয়ে আধুনিক পারসিক হয়ে ওঠে এবং আজও এটি আধিপত্য বজায় রেখেছে।
আধুনিক পারসিক ভাষার প্রধান উপভাষাগুলো হল ইরানে ফার্সি, তাজিকিস্তানে তাজিক এবং আফগানিস্তানে দারি। এই উপভাষাগুলো এতটাই ভিন্ন যে কিছু ক্ষেত্রে বোঝার সমস্যা তৈরি হতে পারে,তবে সম্পূর্ণভাবে বোঝা অসম্ভব নয়।
ধর্ম ও সংস্কৃতি
পারস্য সভ্যতার প্রভাবশালী ধর্ম ছিল জরথ্রুষ্টবাদ (Zoroastrianism)। এর প্রবর্তক ছিলেন জরথ্রুষ্ট (Zarathustra), যিনি অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে শুভ শক্তির বিজয়ের কথা বলেছিলেন। এই ধর্মে প্রধান দেবতা ছিলেন আহুরা মাজদা (Ahura Mazda)। জরথ্রুষ্টবাদ পরবর্তীতে ইহুদী, খ্রিষ্টান ও ইসলাম ধর্মের উপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল।
পারস্যরা সংস্কৃতি ও ভাষার দিক থেকেও ধনী ছিল। তারা পুরাতন পারসিয়ান, এলামাইট ও আরামাইক ভাষা ব্যবহার করত। তাদের শিল্পকলা, ধাতুশিল্প ও রাজপ্রাসাদ নির্মাণে জটিলতা ও সূক্ষ্মতার পরিচয় পাওয়া যায়। রাজদরবারে গ্রিক, মিশরীয়, ব্যাবিলনীয় প্রভাব দেখা যায়, যা পারস্য সভ্যতার বহুজাতিক স্বরূপকে প্রকাশ করে।
অঞ্চলসমূহ
প্রায় ৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে, সাম্রাজ্যের শীর্ষ সময়ে এটি বিশাল ছিল। কিছু এলাকায় শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে পারসিক সাংস্কৃতিক প্রভাব বিদ্যমান:
আফগানিস্তান সবসময়ই পারসিক প্রভাবের অধীনে ছিল।
বাক্ট্রিয়া কয়েক হাজার বছর ধরে বাণিজ্যের কেন্দ্র ছিল।
ইরান ছিল সাম্রাজ্যের কেন্দ্রস্থল।
সোগদিয়া ছিল খ্রিস্টপূর্ব কয়েক শতাব্দী ধরে সাম্রাজ্যের উত্তরতম অংশ।
গান্ধারা, যা বর্তমান পাকিস্তানে অবস্থিত একটি সভ্যতা, প্রায় খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ থেকে খ্রিস্টাব্দ ১০০০ পর্যন্ত,যা বৌদ্ধ শিল্পের জন্য বিখ্যাত।
মুঘল সাম্রাজ্য প্রায় ১৫২০ সাল থেকে ১৯শ শতকের মধ্যে ভারতীয় উপমহাদেশের বড় অংশ শাসন করেছে।
প্রায় ৩৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট এই পুরো সাম্রাজ্য দখল করেন। সেলুকিড সাম্রাজ্য, যা আলেকজান্ডারের এক সেনাপতির দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল,পারস্য এবং আশেপাশের কয়েকটি এলাকা কয়েক শতাব্দী ধরে শাসন করেছিল।
আকাশেমেনীয় সাম্রাজ্য (৫৫০ খ্রি.পূ.–৩৩০ খ্রি.পূ.)
পারস্য সভ্যতার যাত্রা শুরু হয় আকাশেমেনীয় সাম্রাজ্যের হাত ধরে, যা প্রতিষ্ঠা করেন সাইরাস দ্য গ্রেট (Cyrus the Great)। তিনি ছিলেন একজন মহান শাসক যিনি মধ্যপ্রাচ্য থেকে শুরু করে ভারতীয় সীমান্ত, মিশর এবং ভূমধ্যসাগরীয় উপকূল পর্যন্ত বিশাল অঞ্চল জয় করেন। তার সবচেয়ে স্মরণীয় কাজ ছিল “সাইরাস সিলিন্ডার”, যা মানবাধিকারের প্রাচীনতম ঘোষণাপত্র হিসেবে বিবেচিত।
সাইরাসের পর তার পুত্র কাম্বিসেস মিশর জয় করেন, আর দারিয়ুস (Darius I) সাম্রাজ্যের প্রশাসন ঢেলে সাজান। তিনি সাম্রাজ্যকে প্রদেশভিত্তিক (সাত্রাপি) ভাগ করেন এবং কর আদায়ের ব্যবস্থা করেন। রাজপথ নির্মাণ ও ডাকব্যবস্থা চালু করেন — বিশেষ করে “রয়্যাল রোড”, যা ২৫০০ কিমি দীর্ঘ ছিল। রাজধানী পার্সেপোলিস ছিল পারস্য স্থাপত্যের শিখরবিন্দু, যেখানে অসাধারণ স্তম্ভ, ভাস্কর্য ও রাজকীয় ভবন নির্মিত হয়েছিল।
গ্রিক বিজয় ও হেলেনিস্টিক যুগ
৩৩০ খ্রি.পূ. সালে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট পারস্য দখল করেন এবং আকাশেমেনীয় সাম্রাজ্যের অবসান ঘটে। এরপর হেলেনিস্টিক যুগে গ্রিক ও পারস্য সংস্কৃতির সংমিশ্রণ ঘটে। অনেক পারস্য অভিজাত গ্রিক পদ্ধতিতে শিক্ষা গ্রহণ করে এবং সংস্কৃতি ও স্থাপত্যে গ্রিক-ইরানি মিশ্রণ দেখা যায়।
পার্থীয় সাম্রাজ্য (২৪৭ খ্রি.পূ.–২২৪ খ্রি.)
আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর পার্থীয়রা পারস্য অঞ্চলে ক্ষমতায় আসে। তারা মধ্য এশিয়া থেকে আগত এক ইরানিয়ান জনগোষ্ঠী। পার্থীয় শাসকগণ রোমান সাম্রাজ্যের সঙ্গে বারবার সংঘর্ষে লিপ্ত হন এবং অনেক যুদ্ধজয়ী হন, বিশেষ করে কারাই যুদ্ধ (Battle of Carrhae)-এ।
পার্থীয়রা রাজতন্ত্র ও আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের ভারসাম্য বজায় রেখে শাসন করত। তারা গ্রিক এবং স্থানীয় ইরানি সংস্কৃতির সংমিশ্রণে নতুন এক স্থাপত্য ও চিত্রকলার ধারা সৃষ্টি করে। তাদের রাজধানী হেকাতোমপিলস এবং পরে কতেসিফোন ছিল পারস্য সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র।
সাসানীয় সাম্রাজ্য (২২৪–৬৫১ খ্রি.)
সাসানীয়রা পার্থীয়দের পর পারস্যে পুনর্জাগরণ ঘটায়। তারা নিজেদের আকাশেমেনীয়দের উত্তরসূরি দাবি করত। আরদাশীর I এই সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। সাসানীয়রা পুনরায় জরথ্রুষ্টবাদকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে।
সাসানীয়রা প্রশাসন, সাহিত্য, শিল্পকলা ও স্থাপত্যে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। তারা সুবিশাল প্রাসাদ, মিনার এবং ফ্রেস্কো চিত্রকর্ম তৈরি করে। মেডিকেল সায়েন্স, দার্শনিক অনুবাদ ও জ্যোতির্বিজ্ঞানেও তারা অগ্রণী ছিল। সাসানীয়রা রোমানদের সঙ্গে বহু যুদ্ধ করে এবং বহুবার বিজয় অর্জন করে। পরবর্তীতে তারা বাইজেন্টাইনদের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে।
ইসলাম আগমন ও পারস্য সভ্যতার উত্তরাধিকার
৬৫১ খ্রিস্টাব্দে মুসলিম আরবরা সাসানীয় সাম্রাজ্যকে পরাজিত করে। যদিও পারস্য রাজনৈতিকভাবে ইসলামের অধীন হয়ে পড়ে, তাদের সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত ঐতিহ্য অটুট থাকে এবং ইসলামী স্বর্ণযুগে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ফারসি ভাষা ও সাহিত্য ইসলামি দুনিয়ায় এক অনন্য অবস্থান লাভ করে। ফিরদৌসী, ওমর খৈয়াম, রুমি প্রমুখ কবি পারস্য সংস্কৃতিকে বিশ্বে পরিচিত করেন।
পারস্য সভ্যতার বৈশ্বিক প্রভাব
পারস্য সভ্যতা প্রশাসনিক কাঠামো, ধর্মীয় সহনশীলতা, শিল্প ও স্থাপত্যের ক্ষেত্রে যে অবদান রেখেছে, তা পরবর্তী বহু সভ্যতা অনুসরণ করেছে। বিশেষ করে আকাশেমেনীয় আমলের শাসনব্যবস্থা, দার্যুসের কর ব্যবস্থা, সাসানীয় আমলের দার্শনিক অনুবাদ ও মেডিকেল গবেষণা পরবর্তীকালে গ্রিক,রোমান ও ইসলামি সভ্যতার ভিত রচনা করে।
প্রাচীন পারস্য সভ্যতা ছিল ইতিহাসের এক মহাকাব্যিক অধ্যায়। এটি শুধুমাত্র যুদ্ধ ও সাম্রাজ্যের ইতিহাস নয়,বরং সংস্কৃতি, ধর্ম,শিল্প ও মানবিক চেতনার বিস্তৃত রূপ। আধুনিক বিশ্বের বহু নীতি,প্রশাসনিক ধারণা,সাহিত্য ও স্থাপত্যরীতি পারস্য সভ্যতার গভীর ছাপ বহন করে। তাই পারস্য শুধু অতীত নয়, আজও মানবসভ্যতার সাংস্কৃতিক ভিত্তির একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ।
তথ্যসূত্র:
Britannica Encyclopedia
“The Persians: Ancient, Mediaeval and Modern Iran” – Homa Katouzian
UNESCO World Heritage: Persepolis
Oxford History of the Ancient Near East