প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতা
প্রাক-রাজবংশীয় যুগ:
খ্রিস্টপূর্ব ৬০০০ অব্দ থেকে প্রায় ৩০০০ অব্দ পর্যন্ত এই সময়কালে নীল নদের তীরে ছোট ছোট কৃষিভিত্তিক জনপদ গড়ে উঠতে শুরু করে। এই সময় মানুষ ধীরে ধীরে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শেখে এবং একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে।
একত্রীকরণ ও শুরুর যুগ (প্রায় ৩১০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)
প্রাচীন মিশর গঠিত হয় দুটি অঞ্চল—উপর মিশর (দক্ষিণ) ও নিম্ন মিশর (উত্তর)—এর একত্রীকরণের মাধ্যমে। ইতিহাস অনুযায়ী, ফারাও নারমার (Narmer) বা মেনেস (Menes) এই দুটি অঞ্চল একত্রিত করেন এবং রাজধানী স্থাপন করেন মেমফিসে। এই সময়েই হায়ারোগ্লিফিক লিখনপদ্ধতি, ক্যালেন্ডার ও শাসনব্যবস্থার সূচনা ঘটে।
প্রাচীন রাজত্ব (Old Kingdom) – (২৬৮৬–২১৮১ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)
এটি “পিরামিড যুগ” নামে পরিচিত। এই সময়ে গিজার বিখ্যাত খুফুর পিরামিড, স্পিংক্স, এবং অন্যান্য বিশাল কবরস্থল নির্মিত হয়। ফারাওরা নিজেকে ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। প্রশাসন কেন্দ্রীভূত হয় এবং ধর্ম, প্রযুক্তি ও নির্মাণশৈলীর ব্যাপক উন্নতি হয়।
মধ্য রাজত্ব (Middle Kingdom) – (২০৫৫–১৬৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)
এই সময়ে রাজধানী থেবস (Thebes) হয়ে ওঠে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কেন্দ্র। সরকার কৃষি ও জলব্যবস্থায় অনেক উন্নয়ন সাধন করে। সাহিত্য ও চিত্রশিল্পে এক নবজাগরণের সূচনা ঘটে। মিশর দক্ষিণে নুবিয়া পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে এবং বাণিজ্য পথ সম্প্রসারিত হয়।
নতুন রাজত্ব (New Kingdom) – (১৫৫০–১০৭৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)
এটি ছিল মিশরের সুবর্ণযুগ। সাম্রাজ্য বিস্তার, আন্তর্জাতিক রাজনীতি, এবং চমৎকার স্থাপত্যচর্চার যুগ। এ সময় কিছু বিখ্যাত ফারাও শাসন করেন:
হাটশেপসুত – প্রথম প্রভাবশালী নারী ফারাও
আখেনাতেন – একেশ্বরবাদ প্রচলনের চেষ্টা করেন
তুতানখামুন – যার সমাধি অক্ষত অবস্থায় আবিষ্কৃত হয়
রামেসেস II – যিনি সামরিক শক্তি ও স্থাপত্যের জন্য বিখ্যাত
এ সময়ে কার্নাক ও লুক্সরের মন্দির, আবু সিম্বেলের মূর্তি ও সমাধিসমূহ গড়ে তোলা হয়।
পরবর্তী যুগ ও বিদেশি শাসন
নতুন রাজত্বের পতনের পর মিশর দুর্বল হতে থাকে। লিবীয়, কুশি, অ্যাসিরিয়ান ও পার্সিয়ানরা একের পর এক শাসন করে। খ্রিস্টপূর্ব ৩৩২ সালে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট মিশর দখল করেন। এরপর শুরু হয় গ্রিক টলেমি বংশের শাসন, যার বিখ্যাত শাসক ছিলেন ক্লিওপেট্রা VII।
রোমান শাসন ও শেষ অধ্যায় (৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)
ক্লিওপেট্রার আত্মহত্যা এবং অক্টাভিয়ান (অক্টাভিয়াস সিজার)-এর হাতে বিজয়ের মাধ্যমে মিশর রোমান সাম্রাজ্যের একটি প্রদেশে পরিণত হয়। ধীরে ধীরে প্রাচীন ধর্ম ও ঐতিহ্য বিলুপ্ত হতে থাকে।
মিশরীয় সভ্যতার বৈশিষ্ট্য
হায়ারোগ্লিফিক লিপি: চিত্রলিপিতে লেখা যা ধর্মীয় ও প্রশাসনিক কাজে ব্যবহৃত হতো।
মমি ও পিরামিড: পুনর্জন্মের বিশ্বাসে দেহ সংরক্ষণ ও বিশাল কবর নির্মাণ।
দেবতা-পূজা: রা, ওসিরিস, আইসিস, আনুবিস ইত্যাদি বহু দেবতার পূজা চলত।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি: জ্যোতির্বিদ্যা, গণিত, চিকিৎসাশাস্ত্রে অগ্রগতি।
নারীর অবস্থান: তুলনামূলকভাবে নারীদের মর্যাদা ছিল বেশি।
প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতা শুধু একটি জাতির ইতিহাস নয়, বরং এটি মানব সভ্যতার ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হয়। এর পিরামিড, শিল্প, ধর্ম, ও জ্ঞান আজও মানুষের বিস্ময় জাগায়।
তথ্যসূত্র:
Bard, Kathryn. An Introduction to the Archaeology of Ancient Egypt
Shaw, Ian. The Oxford History of Ancient Egypt
British Museum
National Geographic