অক্ষরধাম মন্দির: এক আধুনিক বিস্ময় ও আধ্যাত্মিক কেন্দ্র
অক্ষরধাম মন্দির (Akshardham Temple) বা দিল্লির স্বামীনারায়ণ অক্ষরধাম মন্দির, গিনেস বিশ্ব রেকর্ড অনুযায়ী বিশ্বের সবচেয়ে বড় সর্বাঙ্গীণ হিন্দু মন্দির । পরিপূর্ণ ভারতীয় সংস্কৃতি ও স্থাপত্যের ধাঁচে তৈরি অপূর্ব অক্ষরধাম মন্দিরটি ভারতের দিল্লিতে অবস্থিত। এই মন্দিরকে স্থানীয়রা দিল্লি অক্ষরধাম বা স্বামীনারায়ণ অক্ষরধাম মন্দির নামেও বলে থাকেন। বোচাসন্ন্যাসী শ্রী অক্ষর পুরুষোত্তম স্বামীনারায়ণ সংস্থার গুরু প্রমুখ স্বামী মহারাজের অনুপ্রেরণায় এই মন্দিরটি তৈরি করা হয়। দিল্লি বেড়াতে গেলে ৭০ ভাগ পর্যটকই এই মন্দির না দেখে আসেন না।
বাস্তুশাস্ত্র ও পঞ্চতন্ত্র শাস্ত্রের সমস্ত রীতি মেনে গোটা মন্দিরটি গঠিত হয়েছে। বহু বছর ধরে কাজ চলার পর অবশেষে ২০০৫ সালে মন্দিরের কাজ সম্পূর্ণ হয়। দর্শক, ভক্ত ও পর্যটকদের জন্যও খুলে দেওয়া হয় মন্দিরের দরজা। যমুনা নদীর তীরে অবস্থিত মন্দিরের একাংশে দামী পাথর দিয়ে স্বামী নারায়ণ ও ভারতের ইতিহাস বর্ণিত রয়েছে। অক্ষরধাম মন্দির ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধর্মীয় ও স্থাপত্য নিদর্শন। এটি আধুনিক যুগের হিন্দু স্থাপত্যকলার এক অসাধারণ উদাহরণ, যা আধ্যাত্মিকতা, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের মহিমা ফুটিয়ে তোলে।
অক্ষরধামের পরিচয়
অক্ষরধাম মন্দির, যা স্বামিনারায়ণ অক্ষরধাম নামেও পরিচিত, ভারতের দিল্লি শহরে অবস্থিত। এটি ২০০৫ সালের ৬ নভেম্বর উদ্বোধন করা হয় এবং বিশ্বজুড়ে হিন্দু ধর্মীয় স্থাপত্যের মধ্যে অন্যতম বিশাল এবং দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।
“অক্ষরধাম” শব্দের অর্থ হল ‘দিব্য আবাস’, অর্থাৎ এমন এক স্থান যেখানে ভগবান চিরস্থায়ীভাবে বিরাজ করেন। মন্দিরটি মূলত স্বামিনারায়ণ পরম্পরা অনুসারীদের দ্বারা নির্মিত এবং আধ্যাত্মিক গুরু প্রমুখ স্বামী মহারাজ-এর প্রেরণায় তৈরি হয়েছে।
ইতিহাস ও নির্মাণকাল
অক্ষরধাম মন্দিরের ধারণা ২০শ শতাব্দীর শেষ দিকে তৈরি হয়। স্বামিনারায়ণ সংঘের আধ্যাত্মিক নেতা প্রমুখ স্বামী মহারাজ এই মহাপ্রকল্পের সূচনা করেন। মন্দিরটির নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০০০ সালে এবং প্রায় ৫ বছর সময় লেগে ২০০৫ সালে এটি উদ্বোধন করা হয়।
নির্মাণকাজে ১১,০০০-এর বেশি শিল্পী ও স্বেচ্ছাসেবক কাজ করেছেন। মন্দিরটির নকশা তৈরি করেছেন বিএপিএস স্বামিনারায়ণ সনস্টা (BAPS)। এর নির্মাণে ব্যবহৃত হয়েছে গোলাপি বেলেপাথর এবং ইতালিয়ান মার্বেল। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, মন্দির নির্মাণে ইস্পাত বা কংক্রিট ব্যবহার করা হয়নি, যাতে প্রাচীন ভারতীয় স্থাপত্যশৈলী বজায় থাকে।
স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্য
অক্ষরধাম মন্দিরের স্থাপত্য শৈলী প্রাচীন ভারতীয় মন্দিরকলার ঐতিহ্য মেনে তৈরি করা হয়েছে। এর প্রতিটি অংশ আধ্যাত্মিক অর্থে সমৃদ্ধ এবং শিল্পকলায় অনন্য।
প্রধান মন্দির
মন্দিরের মূল অংশটি প্রায় ১৪১ ফুট উচু, ৩১৬ ফুট চওড়া, ৩৫৬ ফুট লম্বা। মন্দিরের মধ্যে রয়েছে ২৩৪ পিলার, ৯টি বিশাল গম্বুজ ও ২০,০০০ মূর্তি ও হিন্দু দেব-দেবী, সাধু-আচার্যদের স্থাপত্য। গোটা মন্দিরটি রাজস্থানের গোলাপী বেলেপাথর ও ইতালীয় কারারা মার্বেল দিয়ে তৈরি হয়েছে। উল্লেখ্য, মন্দির তৈরিতে স্টিল বা কংক্রিট ব্যবহার করা হয়নি। হিন্দু সংস্কৃতি ও ভারতের ইতিহাসকে মিলিয়ে মন্দিরের বহু অংশে হাতির স্থাপত্য বানানো হয়েছে।
প্রতিটি হাতির স্থাপত্যের ওজন প্রায় ৩০০০ টন। মন্দিরের মধ্যেই রয়েছে প্রদর্শনী হল, থিয়েটার, মিউজিকাল ফাউন্টেন, গার্ডেন অফ ইন্ডিয়া। এছাড়া রয়েছে পদ্ম ফুলের ধাঁচে বিশালাকার সুদৃশ্য বাগান, যা যোগী হৃদয় কোমল নামে পরিচিত। এছাড়া নীলকান্ত অভিষেক, নারায়ণ সরোবর, প্রেমাতি ফুড কোর্ট, আর্শ সেন্টার প্রভৃতি এই মন্দিরেরই অংশ। প্রধান গর্ভগৃহে (Sanctum Sanctorum) স্বামিনারায়ণ ভগবানের মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে, যার সাথে রয়েছে হিন্দু ধর্মগ্রন্থে উল্লিখিত অন্যান্য দেবতার মূর্তি।
গজেন্দ্র পীঠ
মন্দিরের ভিত্তি অংশে আছে গজেন্দ্র পীঠ, যেখানে ১৪৮টি হাতির ভাস্কর্য খোদাই করা হয়েছে। এটি হাতির মাধ্যমে প্রকৃতি, প্রাণী ও মানুষের ঐক্যের প্রতীক।
প্রদর্শনী হল
অক্ষরধামে তিনটি প্রধান প্রদর্শনী রয়েছে:
সাহজনন্দ দরশন: স্বামিনারায়ণ ভগবানের জীবনকাহিনি অডিও-অ্যানিম্যাট্রনিক শো-এর মাধ্যমে প্রদর্শিত হয়।
নীতিদর্শন: নৌকাভ্রমণের মাধ্যমে ভারতীয় প্রাচীন বিজ্ঞান, সংস্কৃতি ও শিল্পের ইতিহাস তুলে ধরা হয়।
সংকল্প দরশন (IMAX ফিল্ম): স্বামিনারায়ণ ভগবানের জীবনের উপর নির্মিত একটি বিশেষ চলচ্চিত্র দেখানো হয়।
যজ্ঞপুরুষ কুণ্ড
এটি বিশ্বের বৃহত্তম ধর্মীয় সিঁড়িওয়ালা জলাশয়। এখানে রয়েছে ২,৮৭০টি সিঁড়ি এবং ১০৮টি পবিত্র জলাধার, যেখানে দর্শনার্থীরা পুণ্যস্নান করতে পারেন।
সাহজানন্দ সারোভার
মন্দির প্রাঙ্গণে বিশাল কৃত্রিম হ্রদ রয়েছে, যা প্রাচীন ভারতীয় জ্ঞান ও বৈদিক শ্লোক খোদাই করা পাথরের সাথে ঘেরা।
ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক তাৎপর্য
অক্ষরধাম শুধু একটি মন্দির নয়; এটি হিন্দু ধর্মীয় দর্শনের এক জীবন্ত কেন্দ্র। এখানে:
আধ্যাত্মিক ধ্যান ও প্রার্থনার ব্যবস্থা রয়েছে।
ধর্মীয় অনুষ্ঠান, পূজা-পার্বণ, সঙ্গীতানুষ্ঠান এবং সংস্কৃতি প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়।
মন্দির দর্শনার্থীদের নৈতিক জীবনযাপন, শান্তি, প্রেম এবং ভক্তির বার্তা দেয়।
আলো ও সঙ্গীতের প্রদর্শনী
অক্ষরধামের সবচেয়ে জনপ্রিয় আকর্ষণ হলো এর সন্ধ্যাকালীন আলো ও সঙ্গীতের প্রদর্শনী (Musical Fountain Show)। এখানে জল, আলো, রঙ এবং সঙ্গীতের সমন্বয়ে ভারতীয় আধ্যাত্মিক কাহিনি ফুটিয়ে তোলা হয়।
পর্যটন আকর্ষণ
অক্ষরধাম মন্দির দিল্লির অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র। প্রতিদিন হাজার হাজার দর্শনার্থী এখানে আসেন। মন্দিরটি দর্শন করতে কোনো প্রবেশমূল্য নেই, তবে প্রদর্শনী এবং নৌকাভ্রমণের জন্য টিকিট প্রযোজ্য।
কীভাবে যাবেন
নিকটতম মেট্রো স্টেশন: অক্ষরধাম মেট্রো স্টেশন (ব্লু লাইন)।
দিল্লি বিমানবন্দর বা রেলস্টেশন থেকে সহজেই পৌঁছানো যায়।
গিনেস বিশ্ব রেকর্ড ও অন্যান্য স্বীকৃতি
২০১০-এ দিল্লিতে কমনওয়েলথ গেমস-এর সময় থেকেই ‘অক্ষরধাম’ জনসাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে থাকে। প্রায় শতাধিক ক্রীড়াবিদ সহ হাজার হাজার মানুষ দেখতে আসেন ‘অক্ষরধাম’। ওই বছরের ১৪ নভেম্বর সংঘের মহিলা সদস্যরা এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। যার মাধ্যমে মন্দির, মসজিদ, চার্চের মাধ্যমে সেবা বা সামাজিক উপকারিতা-র কথা প্রচার করেন তাঁরা। সেই সঙ্গে হিন্দু-আমেরিকান সেবা চ্যারিটি-র কর্ণধার অঞ্জন ভার্গব ও চ্যারিটির সভাপতি রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামা সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেন।
শুধু স্থাপত্যের জন্য নয়, সমস্ত হিন্দু মন্দিরের বৈশিষ্ট্য নিয়ে গঠিত বিশ্বের সবচেয়ে বড়ো হিন্দু মন্দির হিসেবে ‘অক্ষরধাম’ গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে জায়গা করে নিয়েছে। ২০০৭ সালের ১৭ ডিসেম্বর গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডের সরকারি বিশ্বরেকর্ড নির্ণায়ক মাইকেল উইটি আমেদাবাদে এসে প্রমুখ স্বামী মহারাজের হাতে শংসাপত্র তুলে দিয়ে যান। শংসাপত্রে ‘অক্ষরধাম’ সম্বন্ধীয় যাবতীয় তথ্য লেখা রয়েছে। মাইকেল উইটি জানিয়েছিলেন, মন্দিরের স্থাপত্যের তথ্য জানতে সংস্থার প্রায় তিন মাস সময় লেগেছিল। এতে একাধারে সনাতনী ও আধুনিক হিন্দু ধর্মের রীতি-নীতি স্থান পেয়েছে। তাই ‘অক্ষরধাম’ এই বিশেষ পুরস্কারের যোগ্য।
অক্ষরধাম মন্দির শুধু একটি মন্দির নয়, এটি মানবসভ্যতার আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক উৎকর্ষের প্রতীক। আধুনিক যুগে যখন প্রযুক্তি, অর্থনীতি ও ভৌত সুখের পিছনে ছুটে চলা মানুষের মধ্যে মানসিক চাপ ও অশান্তি বৃদ্ধি পাচ্ছে, তখন অক্ষরধাম একটি শান্তি, জ্ঞান ও ভক্তির আশ্রয়স্থল হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে।
মন্দিরের স্থাপত্যশৈলী আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে ভারতীয় ঐতিহ্য, দর্শন ও শিল্পকলা চিরকালীন এবং অপরিসীম সুন্দর। প্রাচীন যুগের পাথরের খোদাই ও স্থাপত্যশৈলীকে আধুনিক সময়ে এত নিখুঁতভাবে পুনর্নির্মাণ করা এক অসাধারণ কীর্তি। এখানে প্রবেশ করলে যে কোনো মানুষ উপলব্ধি করে ভারতীয় সংস্কৃতির গভীরতা, আধ্যাত্মিক শক্তি এবং মানবতার সৌন্দর্য।
অক্ষরধামের মূল বার্তা হল শান্তি, সহানুভূতি, ঐক্য ও ভক্তি। এখানে এসে মানুষ শুধু ভগবানের মূর্তি দর্শন করে না, বরং জীবনের প্রকৃত অর্থ উপলব্ধি করার চেষ্টা করে। প্রদর্শনী, ভাস্কর্য ও সাংস্কৃতিক প্রোগ্রামের মাধ্যমে দর্শনার্থীরা জানতে পারে কীভাবে প্রাচীন ভারতীয় সমাজ জ্ঞান, বিজ্ঞান, শিল্পকলা ও আধ্যাত্মিকতায় বিশ্বকে নেতৃত্ব দিয়েছিল।
বর্তমান প্রজন্মের জন্য অক্ষরধাম এক শিক্ষা কেন্দ্র, যা শেখায়—ধর্ম কেবল প্রার্থনায় সীমাবদ্ধ নয়, এটি আমাদের জীবনযাত্রার অংশ। এই মন্দির দর্শনার্থীদের অনুপ্রাণিত করে মানবিক গুণাবলি বিকাশে এবং সমাজে শান্তি ও ভালোবাসা প্রতিষ্ঠা করতে।
আধুনিক প্রযুক্তি ও প্রাচীন ঐতিহ্যের সমন্বয়ে অক্ষরধাম আজ একটি বৈশ্বিক আকর্ষণ। ভারত ভ্রমণকারীদের জন্য এটি শুধু একটি পর্যটন কেন্দ্র নয়, বরং এক আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতার গন্তব্য। দিনের শেষে অক্ষরধামের সৌন্দর্য, শান্ত পরিবেশ ও আলো-সঙ্গীতের জাদু মানুষের মনে এমন এক প্রশান্তি দেয়, যা সহজে ভুলে যাওয়া যায় না।
তাই বলা যায়, অক্ষরধাম মন্দির আধুনিক বিশ্বের মধ্যে আধ্যাত্মিকতার এক আলোকবর্তিকা—যা মানবতাকে, সংস্কৃতিকে এবং চিরন্তন সত্যকে সযত্নে ধারণ করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে। এটি আধুনিক যুগের অন্যতম স্থাপত্যকীর্তি হিসেবে প্রশংসিত।
তথ্যসূত্র
BAPS Swaminarayan Sanstha
গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস
ভারতীয় পর্যটন মন্ত্রণালয়ের তথ্য