Friday, October 3, 2025
Homeজীবনীএ.কে. ফজলুল হক এর জীবনী

এ.কে. ফজলুল হক এর জীবনী

এ.কে. ফজলুল হক এর জীবনী

আবুল কাশেম ফজলুল হক, যিনি সাধারণত এ.কে. ফজলুল হক নামে পরিচিত, ছিলেন একজন প্রখ্যাত বাঙালি রাজনীতিবিদ, আইনজীবী এবং সমাজসংস্কারক। তার বহুমুখী রাজনৈতিক জীবন এবং জনগণের প্রতি অঙ্গীকারের জন্য তিনি “শের-এ-বাংলা” (বাঙলার বাঘ) উপাধিতে ভূষিত হন। তিনি উপমহাদেশের রাজনীতিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন এবং বাংলার সাধারণ মানুষের অধিকার আদায়ে ছিলেন এক অগ্রণী পুরুষ।

প্রারম্ভিক জীবন

এ.কে. ফজলুল হকের জন্ম ১৮৭৩ সালের ২৬ অক্টোবর, তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের বরিশাল জেলার সাকারাইল গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে। তাঁর পিতার নাম কাজী ওয়াজেদ আলী এবং মাতার নাম সাইদুন্নেসা খাতুন। ছোটবেলা থেকেই ফজলুল হক ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী।

তিনি বারিশাল জেলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন এবং পরে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে গণিতে অনার্সসহ বিএ পাশ করেন। এরপর তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ এবং আইন বিষয়ে ডিগ্রি অর্জন করেন। পরে তিনি ইংল্যান্ড যান এবং ব্যারিস্টারি ডিগ্রি লাভ করেন।

পেশাগত জীবন ও রাজনীতিতে প্রবেশ

ফজলুল হক একজন সফল আইনজীবী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। কিন্তু শীঘ্রই তিনি রাজনীতির প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে সক্রিয় হন।

১৯১৩ সালে তিনি অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের সদস্য হন। তার রাজনৈতিক জীবন ক্রমে বিস্তৃত হতে থাকে। তিনি ১৯১৯ সালে কলকাতা কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হন, যা একজন মুসলমান হিসেবে ছিল বিরল ঘটনা।

১৯০৮ থেকে ১৯১২ সাল পর্যন্ত, হক সমবায় বিভাগের সহকারী রেজিস্ট্রার ছিলেন। তিনি সরকারি চাকরি থেকে পদত্যাগ করেন এবং জনজীবন ও আইন পেশা বেছে নেন। স্যার আশুতোষ মুখার্জির পরামর্শে তিনি কলকাতা হাইকোর্টের বার কাউন্সিলে যোগদান করেন এবং আইন পেশা শুরু করেন। তিনি ৪০ বছর ধরে কলকাতা হাইকোর্টে অনুশীলন করেন।

১৯৩৭ সালের নির্বাচন ও মুখ্যমন্ত্রীত্ব

ব্রিটিশ সরকারের প্রবর্তিত ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন অনুযায়ী ১৯৩৭ সালে প্রথম প্রাদেশিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ফজলুল হক তার প্রতিষ্ঠিত কৃষক প্রজা পার্টি নিয়ে এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। কৃষক ও সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করাই ছিল এই দলের মূলমন্ত্র।

তিনি বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। এই সময় তিনি নানা জনকল্যাণমূলক কাজ করেন:

জমিদারি ব্যবস্থার বিরুদ্ধে অবস্থান

কৃষকের দেনা মওকুফ আইন প্রবর্তন

প্রাথমিক শিক্ষা বিস্তার

স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নয়ন

লাহোর প্রস্তাব, ১৯৪০

ফজলুল হক তার রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ। তিনি অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের লাহোর অধিবেশনে ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব উত্থাপন করেন, যা পরবর্তীকালে পাকিস্তান সৃষ্টির ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায়। এই প্রস্তাবে ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের জন্য পৃথক রাষ্ট্রের দাবি জানানো হয়।

মুসলিম লীগের সাথে বিভেদ

১৯৪১ সালে, ফজলুল হক ভাইসরয়ের প্রতিরক্ষা পরিষদে যোগ দেন, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ ভারতের যুদ্ধ প্রচেষ্টা তদারকি করার জন্য গঠিত হয়েছিল । ফজলুল হকের সাথে পাঞ্জাবের প্রধানমন্ত্রী স্যার সিকান্দার হায়াত খান যোগ দেন ।ফজলুল হক ও খানের মতো প্রাদেশিক মুসলিম লীগ নেতাদের ক্রমবর্ধমান প্রভাব জিন্নাহকে বিরক্ত করে। জিন্নাহ এবং তার মিত্রদের নেতৃত্বে মুসলিম লীগ নেতৃত্ব দাবি করে যে বাংলা এবং পাঞ্জাব উভয় প্রধানমন্ত্রীই প্রতিরক্ষা পরিষদ থেকে সরে আসুন। খান অবশেষে তা মেনে নেন কিন্তু ফজলুল হক তা প্রত্যাখ্যান করেন।

ফজলুল হক এবং জিন্নাহর মধ্যে সম্পর্কের ভাঙ্গনের ফলে ফজলুল হক মুসলিম লীগ থেকে বহিষ্কৃত হন। এরপর বাংলায় জিন্নাহর মিত্ররা হকের সরকারকে পতনের জন্য কাজ করে। জিন্নাহ অনুভব করেন যে প্রতিরক্ষা পরিষদ কংগ্রেসের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। ২ ডিসেম্বর ১৯৪১ তারিখে,ফজলুল হক পদত্যাগ করেন।

গভর্নর ও শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব

পরে তিনি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর নতুন রাষ্ট্রে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ছিলেন:

পূর্ব বাংলার (বর্তমানে বাংলাদেশ) গভর্নর

পাকিস্তানের শিক্ষামন্ত্রী (১৯৫১–৫৩)

পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী

এই সময় তিনি শিক্ষার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। তবে তাঁর বহু পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়নি রাজনৈতিক অস্থিরতা ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে।

সমাজকল্যাণমূলক চিন্তাধারা

ফজলুল হক ছিলেন একজন আদর্শ সমাজসংস্কারক। তিনি সবসময় বাংলার কৃষক, শ্রমিক ও সাধারণ মানুষের উন্নয়নের কথা চিন্তা করতেন। তাঁর গৃহীত বিভিন্ন উদ্যোগের ফলে:

ভূমিহীন কৃষকরা জমি পেতে শুরু করে

প্রাথমিক শিক্ষার প্রসার ঘটে

মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষা গ্রহণের হার বৃদ্ধি পায়

তিনি সব ধর্ম-বর্ণের মানুষের মধ্যে সহমর্মিতা ও সহযোগিতার পক্ষে ছিলেন।

শেষ জীবন ও মৃত্যু

তাঁর শেষ জীবনে তিনি কিছুটা নিঃসঙ্গ ও রাজনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। তবুও বাংলার সাধারণ মানুষ তাকে ভালোবাসতেন। তিনি দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে কখনও আত্মসমর্পণ করেননি।

১৯৬২ সালের ২৭ এপ্রিল ঢাকায় তার মৃত্যু হয়। তাঁকে ঢাকার সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে সমাহিত করা হয়। আজও তাঁর কবরটি ঐতিহাসিক স্থান হিসেবে গণ্য হয়।

উত্তরাধিকার ও স্মৃতি

ফজলুল হক বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অনন্য চরিত্র। তাঁর নামে বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সড়ক এবং স্থাপনা রয়েছে। তার রাজনৈতিক সততা, গণমানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা ও নেতৃত্বের গুণাবলী আজও মানুষকে অনুপ্রাণিত করে।

শের-এ-বাংলা এ.কে. ফজলুল হক শুধু একজন রাজনীতিবিদ ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন চিন্তাবিদ, সমাজসংস্কারক এবং জনগণের নেতা। বাংলার ইতিহাসে তার অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। তাঁর মত নেতা আজও বিরল, যিনি সত্যিকার অর্থেই জনগণের জন্য কাজ করেছেন এবং বাঙালি জাতিসত্তার বিকাশে অসামান্য ভূমিকা রেখেছেন।

তথ্যসূত্র:

বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর

“Sher-e-Bangla A.K. Fazlul Huq” – Banglapedia

ড. মুহম্মদ এনামুল হক, বাংলার বাঘ (জীবনীগ্রন্থ)

Itihasar Golpo
Itihasar Golpohttps://itihasargolpo.com
Step into the past with our unforgettable historical journey. Discover the secrets of history on our captivating journey.
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments