কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কার
ক্রিস্টোফার কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কার ১৪৯২ সালে বিশ্ব ইতিহাসে এক যুগান্তকারী অধ্যায় তৈরি করেছিল। ইউরোপীয় অভিযান ও উপনিবেশ স্থাপনার এক নতুন অধ্যায় শুরু হয় এই অভিযানের মধ্য দিয়ে। যদিও আমেরিকা তার অনেক আগেই বাসযোগ্য ছিল এবং আদিবাসী জনগোষ্ঠী সেখানে বসবাস করছিল,তবুও কলম্বাসের অভিযান ইউরোপের দৃষ্টিতে এই “নতুন জগতের” দ্বার উন্মোচন করে। এই আবিষ্কার শুধু ভৌগোলিক নয়, বরং অর্থনৈতিক,সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিকভাবে বিশ্ব ইতিহাসে বিশাল প্রভাব ফেলেছিল।
প্রেক্ষাপট ও উদ্দেশ্য
১৫শ শতকের শেষভাগে ইউরোপে ছিল পুনর্জাগরণ,বৈজ্ঞানিক কৌতূহল ও বাণিজ্যিক প্রসারের যুগ। ভারত ও চীনের মতো পূর্ব দুনিয়ার মশলা,সোনা ও সিল্ক ইউরোপীয়দের কাছে ছিল অত্যন্ত আকর্ষণীয়। কিন্তু ওটোমান সাম্রাজ্যের দখলে থাকা মধ্যপ্রাচ্য দিয়ে স্থলপথে বাণিজ্য কঠিন হয়ে পড়েছিল। এ সময় নতুন সমুদ্রপথ অনুসন্ধানের চেষ্টায় ইউরোপীয় জাতিগুলো বিশেষভাবে উৎসাহী হয়ে ওঠে।
কলম্বাস,একজন ইতালীয় নাবিক,বিশ্বাস করতেন যে পশ্চিম দিকে যাত্রা করলে পূর্বের ভারত ও চীনে পৌঁছানো যাবে। তিনি তার এই ধারণা নিয়ে স্পেনের রাজা ও রানি—ফার্দিনান্দ ও ইসাবেল্লা—এর কাছে যান এবং তাদের আর্থিক সহায়তা লাভ করেন।
আটলান্টিক অভিযান
১৪৯১ সালে আটলান্টিক অভিযানে তিনি ব্যবহার করেছিলেন ‘রহস্যময়’ এক মানচিত্র। অভিযানের শুরু থেকে পুরো সময়টায় তাকে আলোর দিশা দিয়েছে এই মানচিত্রটি। অন্যকথায় বলা যায়,এই মানচিত্রটিকে ঘিরেই পরিকল্পনা নির্ধারণ করতেন ক্রিস্টোফার কলম্বাস।
এই মানচিত্রটি ছিল জার্মান মানচিত্রকার হেনেরিকাস মারটেলাসের তৈরি করা। অবশ্য এই মানচিত্র প্রস্তুতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল আরো কিছু কিংবদন্তীর। বহু পুরনো সেই মানচিত্রটি সময়ের ব্যবধানে এক সময় অনেকটাই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল।
কলম্বাস কিউবা আবিষ্কার করেন। আমেরিকা মহাদেশের ঠিক কোথায় কলম্বাস জাহাজ থেকে নেমেছিলেন তা নিয়ে শত শত বছর ধরে বিতর্ক চলেছে। অন্তত ১০টি স্থানের বাসিন্দারা দাবি করেন যে কলম্বাস তাদের সেই জায়গাগুলিতেই প্রথম পদধূলি দেন। তবে আমেরিকায় নামার পর কলম্বাস ভেবেছিলেন তিনি ভারতে পৌঁছেছেন।
প্রথম অভিযান ও আবিষ্কার
১৪৯২ সালের ৩ আগস্ট,কলম্বাস তার তিনটি জাহাজ—নিনা, পিন্টা ও সান্তা মারিয়া নিয়ে স্পেনের পালোস ডে লা ফ্রন্টেরা বন্দর থেকে যাত্রা শুরু করেন। সমুদ্রপথে প্রায় ১০ সপ্তাহ পর, ১২ অক্টোবর ১৪৯২ সালে তারা বাহামা দ্বীপপুঞ্জের এক দ্বীপে পৌঁছান, যেটি কলম্বাস “সান সালভাদোর”নাম দেন। এখান থেকেই শুরু হয় ইউরোপীয়দের আমেরিকার সাথে সরাসরি যোগাযোগ।
কলম্বাস ভেবেছিলেন তিনি পূর্ব এশিয়ার উপকূলে পৌঁছেছেন। সেখানকার আদিবাসীদের তিনি “ইন্ডিয়ান” নামে অভিহিত করেন,কারণ তিনি ধারণা করেছিলেন যে এটি ভারতবর্ষ।
পরবর্তী অভিযান ও স্প্যানিশ উপনিবেশ
কলম্বাস মোট চারটি অভিযান পরিচালনা করেন (১৪৯২, ১৪৯৩, ১৪৯৮, ১৫০২)। প্রতিটি অভিযানে তিনি ক্যারিবীয় অঞ্চলের বিভিন্ন দ্বীপ যেমন কিউবা,হাইতি,পুয়ের্তো রিকো,জামাইকা ও দক্ষিণ আমেরিকার কিছু উপকূলীয় অঞ্চল আবিষ্কার করেন। যদিও তিনি কখনো উত্তর আমেরিকার মূল ভূখণ্ডে পৌঁছাননি,তবুও তার অভিযান ইউরোপীয় উপনিবেশ স্থাপন ও আদিবাসী সংস্কৃতির ধ্বংসের ভিত্তি স্থাপন করে।
স্পেন অচিরেই ক্যারিবীয় অঞ্চলে শক্তিশালী উপনিবেশ গড়ে তোলে। আমেরিকার সোনা-রূপা ইউরোপে পৌঁছে নতুন ধনসম্পদের স্রোত তৈরি করে, যা পরবর্তীকালে “কলম্বিয়ান এক্সচেঞ্জ” নামে পরিচিত হয়।
কলম্বাসের ভূমিকা ও বিতর্ক
প্রথাগতভাবে কলম্বাসকে “নতুন বিশ্বের আবিষ্কারক”হিসেবে স্মরণ করা হয়। কিন্তু আধুনিক গবেষণা বলছে,তিনি আমেরিকার প্রথম ইউরোপীয় অনুসন্ধানকারী ছিলেন না। নরওয়েজীয় ভাইকিং লেইফ এরিকসন প্রায় ৫০০ বছর আগেই (খ্রিস্টীয় একাদশ শতকে) উত্তর আমেরিকার নিউফাউন্ডল্যান্ডে পৌঁছেছিলেন।
এছাড়া, কলম্বাসের পরিণামমূলক কর্মকাণ্ডের দিকগুলো আজ সমালোচনার মুখে। তার অভিযানের পর আদিবাসীদের উপর ভয়াবহ সহিংসতা, দাসত্ব ও রোগ ছড়িয়ে পড়ে। লক্ষ লক্ষ আদিবাসী মানুষের মৃত্যু ঘটে ইউরোপীয়দের আনীত সংক্রামক রোগে,যার কোন প্রতিকার তাদের ছিল না।
কলম্বিয়ান এক্সচেঞ্জ: একটি বিপ্লব
কলম্বাসের অভিযানের পর ইউরোপ ও আমেরিকার মধ্যে শুরু হয় এক বিশাল জৈবিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক আদান-প্রদান—যাকে বলা হয় Columbian Exchange। আমেরিকা থেকে ইউরোপে যায় ভুট্টা, আলু, টমেটো, কাকাও,তামাক ও টার্কি। আবার ইউরোপ থেকে আমেরিকায় আসে গম, চাল, ঘোড়া, গরু, শূকর এবং নানা রোগ।
এই এক্সচেঞ্জ মানব ইতিহাসে কৃষি,খাদ্যাভ্যাস ও অর্থনীতিতে অভূতপূর্ব পরিবর্তন আনে।
উত্তরাধিকার ও উত্তর-ঔপনিবেশিক মূল্যায়ন
আজকের দিনে কলম্বাসের নাম ও কার্যক্রম নিয়ে বিভক্ত মতামত রয়েছে। একদল তাকে সাহসী অভিযাত্রী হিসেবে দেখেন,যিনি আধুনিক বিশ্ব ইতিহাসে একটি সংযোগ তৈরি করেছিলেন। অন্যদিকে,অনেকে তাকে একটি উপনিবেশবাদী যুগের সূচক হিসেবে চিহ্নিত করেন, যার নেতৃত্বে আদিবাসী জনগণের সংস্কৃতি ও জীবনধারা ধ্বংসের মুখে পড়ে।
বিভিন্ন দেশে “কলম্বাস ডে” পালিত হলেও যুক্তরাষ্ট্রসহ বহু স্থানে এই দিনের নাম পরিবর্তন করে “ইন্ডিজেনাস পিপলস ডে”(আদিবাসী জনগণের দিন) রাখা হয়েছে,যেন আদিবাসীদের অবদানের স্বীকৃতি দেওয়া হয় এবং ইতিহাসের পূর্ণ চিত্র তুলে ধরা যায়।
ক্রিস্টোফার কলম্বাসের ১৪৯২ সালের অভিযান ছিল বিশ্ব ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। এটি কেবল আমেরিকা আবিষ্কারের ঘটনা ছিল না, বরং এক নতুন বৈশ্বিক বাস্তবতার সূচনা। তার অভিযান বিশ্বকে একত্রে যুক্ত করেছিল—ভূগোল, মানুষ, খাদ্য, সংস্কৃতি ও অর্থনীতির বিনিময়ের মাধ্যমে। তবে এর পেছনের বেদনা,সহিংসতা ও ধ্বংসও আজ ইতিহাসের অনিবার্য অংশ। তাই কলম্বাসের আমেরিকা “আবিষ্কার”কেবল একমাত্রিক বিজয়গাথা নয়, বরং তা এক জটিল,বহুস্তরবিশিষ্ট ইতিহাস যার আলো ও ছায়া—উভয়কেই আমাদের বিবেচনায় রাখা জরুরি।
তথ্যসূত্র:
Jared Diamond, Guns, Germs, and Steel
Charles C. Mann, 1491: New Revelations of the Americas Before Columbus
Smithsonian Institute Archives
Encyclopedia Britannica