পার্থেনন: প্রাচীন গ্রীসের গৌরবময় স্থাপত্য
পার্থেনন (Parthenon) হলো প্রাচীন গ্রীসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্থাপত্যকীর্তি এবং অ্যাথেন্স শহরের প্রতীক। এটি অ্যাথেন্সের এক্রোপলিসে অবস্থিত, যা একটি উঁচু পাথুরে প্রাচীন দুর্গ। পার্থেনন শুধু একটি মন্দির নয়; এটি ছিল দেবী অ্যাথেনার জন্য নিবেদিত এক পবিত্র স্থান, যিনি ছিলেন শহরের রক্ষাকর্ত্রী ও বুদ্ধিমত্তার দেবী।
নির্মাণ ও ইতিহাস
পার্থেনন নির্মাণ শুরু হয় খ্রিস্টপূর্ব ৪৪৭ সালে এবং শেষ হয় খ্রিস্টপূর্ব ৪৩২ সালের মধ্যে। এটি নির্মাণ করেছিলেন অ্যাথেন্সের নেতা পেরিক্লিস (Pericles), যিনি এক্রোপলিস পুনর্গঠনের নেতৃত্ব দেন। মূল স্থপতি ছিলেন ইক্টিনোস (Ictinus) ও কাল্লিক্রেটিস (Callicrates), এবং ভাস্কর্য পরিকল্পনার দায়িত্বে ছিলেন বিখ্যাত শিল্পী ফিদিয়াস (Phidias)।
এই মন্দিরটি নির্মাণ করা হয়েছিল পারস্য যুদ্ধের পর, যখন অ্যাথেন্স সামরিক ও সাংস্কৃতিকভাবে উত্থানশীল ছিল। এটি অ্যাথেন্সের গৌরব, শক্তি এবং শিল্পকলার উৎকর্ষকে প্রতিফলিত করে।
স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য
পার্থেনন একটি ডোরিক শৈলীতে নির্মিত মন্দির, যা গ্রীক স্থাপত্যের অন্যতম প্রধান ধারা। এটি মার্বেল পাথরে তৈরি, বিশেষ করে পেন্টেলিক মার্বেল, যা তার শুভ্র এবং চকচকে রঙের জন্য বিখ্যাত। এটি প্রায় ৬৯.৫ মিটার লম্বা ও ৩০.৯ মিটার চওড়া।
মূল গঠন:
সারি সারি স্তম্ভ: পার্থেননের চারপাশে মোট ৪৬টি স্তম্ভ রয়েছে— প্রতিটি পাশে ৮টি এবং লম্বালম্বিভাবে ১৭টি। এই স্তম্ভগুলো ডোরিক শৈলীর ক্লাসিক উদাহরণ।
নাঊস (Naos): ভেতরে ছিল মূল কক্ষ, যেখানে দেবী অ্যাথেনার এক বিশাল স্বর্ণ-দাঁতের মূর্তি স্থাপন করা হয়েছিল, যার উচ্চতা ছিল প্রায় ১২ মিটার।
অপিসথোডমোস ও প্রোনাওস: মন্দিরের সামনের ও পেছনের বারান্দার কক্ষ।
চতুর্মাত্রিক সৌন্দর্য:
পার্থেনন স্থপতিরা মন্দিরের দৃষ্টিনন্দনতা বাড়াতে কিছু নির্ভুল অপটিক্যাল সংশোধন করেন:
স্তম্ভগুলো সামান্য বাঁকানো (entasis),যেন সেগুলো চোখে সোজা দেখায়।
ভিত্তি (stylobate) সামান্য উত্তল,যেন মাঝখান ডুবে না দেখায়।
কোণার স্তম্ভগুলো একটু মোটা,যাতে ভারসাম্যপূর্ণ দেখায়।
শিল্পকলা ও অলংকরণ
ফিদিয়াসের নেতৃত্বে পার্থেনন অলংকরণে অসাধারণ শিল্পকর্ম যুক্ত হয়েছিল। পুরো মন্দিরটি ছিল বিভিন্ন ভাস্কর্যে পূর্ণ।
ফ্রিজ (Frieze): ভিতরের দেয়াল ঘিরে ছিল একটি দীর্ঘ ব্যান্ড, যেখানে প্যানাথেনেইক উত্সবের দৃশ্য খোদাই করা ছিল।
মেটোপ (Metopes): বাইরের অংশে ছিল ৯২টি মেটোপ, প্রতিটিতে পৌরাণিক যুদ্ধের দৃশ্য – যেমন ল্যাপিথ ও সেন্টরদের যুদ্ধ, ট্রয় যুদ্ধ।
পেডিমেন্ট (Pediments): সামনের ও পেছনের ত্রিকোণ অংশে ছিল দেবী অ্যাথেনার জন্ম ও অ্যাথেনস শহরের অভিষেকের ভাস্কর্য।
ধর্মীয় ও সামাজিক ভূমিকা
পার্থেনন শুধু একটি ধর্মীয় কেন্দ্র নয়; এটি ছিল অ্যাথেনসের জাতীয় গৌরবের প্রতীক। দেবী অ্যাথেনার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে শহরের বাসিন্দারা এখানে উপাসনা করতেন এবং বড় উৎসব পালন করতেন।
ইতিহাসে পরিবর্তন
সময়ের প্রবাহে পার্থেননের উদ্দেশ্য ও চেহারায় বহু পরিবর্তন এসেছে:
খ্রিস্টান গির্জা: খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতকের পর এটি খ্রিস্টান গির্জা হয়ে যায়।
মুসলিম মসজিদ: ১৪৬০-এর দশকে অটোমান শাসনে এটি একটি মসজিদে রূপান্তরিত হয়।
বিস্ফোরণ: ১৬৮৭ সালে ভেনিসিয়ানদের সঙ্গে অটোমানদের যুদ্ধে পার্থেনন বারুদ গুদাম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছিল, তখন এক বিস্ফোরণে বড় ক্ষতি হয়।
এলগিন মার্বেল ও বিতর্ক
১৮০১-১৮১২ সালের মধ্যে ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত লর্ড এলগিন পার্থেনন থেকে অনেক ভাস্কর্য সরিয়ে নিয়ে যান এবং পরে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে বিক্রি করেন। আজ পর্যন্ত এই “এলগিন মার্বেল” ফিরিয়ে আনার জন্য গ্রীস বহুবার দাবি জানিয়েছে। এটি একটি বড় সাংস্কৃতিক বিতর্কের বিষয়।
আধুনিক সংরক্ষণ ও জাদুঘর
বর্তমানে গ্রীস সরকার এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলি পার্থেননের পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণের কাজ করছে। ২০০৯ সালে এক্রোপলিস জাদুঘর (Acropolis Museum) খোলা হয়, যেখানে পার্থেননের মূল ভাস্কর্যগুলোর একটি বড় সংগ্রহ স্থান পেয়েছে।
পার্থেননের গুরুত্ব
পার্থেনন কেবল একটি প্রাচীন স্থাপত্য নয়; এটি গণতন্ত্র, সংস্কৃতি, এবং মানব ইতিহাসের প্রতীক। এটি প্রতিদিন হাজারো দর্শনার্থীকে আকর্ষণ করে এবং বিশ্বব্যাপী শিল্প, স্থাপত্য ও ইতিহাসপ্রেমীদের মুগ্ধ করে।
পার্থেনন গ্রীক সভ্যতার শ্রেষ্ঠতম স্থাপত্য নিদর্শনগুলোর একটি, যা তার শিল্প, স্থাপত্য ও ইতিহাসের গভীরতা দিয়ে বিশ্বকে অনুপ্রাণিত করেছে। এটি একাধারে অতীতের সাক্ষ্য, গৌরবময় ইতিহাসের স্মারক এবং আজও চলমান সাংস্কৃতিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু।
তথ্যসূত্র:
Neils, Jenifer. The Parthenon: From Antiquity to the Present. Cambridge University Press, 2005.
Hurwit, Jeffrey M. The Acropolis in the Age of Pericles. Cambridge University Press, 2004.
The British Museum – Parthenon Sculptures
The Acropolis Museum – Official Website