নূরজাহান: মোগল সাম্রাজ্যের আলো
নূরজাহান ছিলেন মোগল ইতিহাসের এক অসাধারণ ও ক্ষমতাধর নারী। তার মূল নাম ছিল মেহেরুন্নিসা, যার অর্থ “দয়ালু নারী”। কিন্তু ইতিহাস তাকে মনে রেখেছে নূরজাহান নামে, যার অর্থ “জগতের আলো”। এই উপাধিটি তাকে দিয়েছিলেন স্বামী মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীর, যার রাজত্বকাল ছিল ১৬০৫ থেকে ১৬২৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। নূরজাহান শুধু একজন রানীই নন,বরং তিনি রাজনীতি, প্রশাসন, কূটনীতি এবং সংস্কৃতির জগতে এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী নারীর প্রতিচ্ছবি।
পারিবারিক পটভূমি ও শৈশব
নূরজাহানের জন্ম ১৫৭৭ খ্রিস্টাব্দে আফগানিস্তানের কন্দাহারে এক পারস্য বংশোদ্ভূত পরিবারে। তার পিতা মীরজা গিয়াস বেগ এবং মাতা আস্মত বেগম। গিয়াস বেগ পরিবারসহ পারস্য থেকে ভারতে পাড়ি জমান,কারণ তারা আর্থিকভাবে সংকটে পড়েছিলেন। ভারতের মোগল দরবারে গিয়াস বেগ ধীরে ধীরে প্রভাবশালী পদে অধিষ্ঠিত হন এবং শেষ পর্যন্ত ‘ইতিমাদ-উদ-দৌলা’ উপাধি লাভ করেন।
প্রথম বিবাহ ও জাহাঙ্গীরের সঙ্গে পরিচয়
মেহেরুন্নিসার প্রথম বিবাহ হয় শের আলি কুলি বেগ নামক এক ইরানি সেনা কর্মকর্তার সঙ্গে,যিনি পরবর্তীতে শের আফগান খান নামে পরিচিত হন এবং বাংলার বর্ধমান অঞ্চলে মোতায়েন ছিলেন। এই দম্পতির এক কন্যা সন্তান ছিল – লাডলি বেগম। শের আফগান খানের অস্বাভাবিক মৃত্যুর পর মেহেরুন্নিসা আগ্রায় ফিরে আসেন এবং সম্রাটের হারেমে বাস করতে থাকেন।
১৬১১ সালে, সম্রাট জাহাঙ্গীর মেহেরুন্নিসাকে বিয়ে করেন এবং নাম দেন নূরজাহান। তার বুদ্ধিমত্তা, সৌন্দর্য ও ব্যক্তিত্বের জন্য জাহাঙ্গীর তার প্রতি অগাধ ভক্তি পোষণ করতেন। ধীরে ধীরে নূরজাহান শুধু একজন প্রিয় রানি নন, বরং কার্যত রাজ্যের শাসক হয়ে ওঠেন।
রাজনৈতিক ক্ষমতা ও শাসনক্ষমতা
নূরজাহানের রাজনৈতিক ক্ষমতা ছিল বিশাল। তিনি রাজ্য পরিচালনায় সরাসরি অংশগ্রহণ করতেন। এমনকি তার নামে সোনা ও রূপার মুদ্রা চালু হয়েছিল—যা একজন নারীর জন্য মোগল ইতিহাসে একক ঘটনা।
তিনি দরবারে প্রতিনিধি পাঠাতেন, সেনাপতি নিযুক্ত করতেন,বিচার দিতেন এবং রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতেন। জাহাঙ্গীর যেহেতু মদের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েছিলেন, শারীরিকভাবে তিনি দুর্বল হয়ে পড়েন এবং সেই সুযোগে নূরজাহান কার্যত রাজ্য পরিচালনার দায়িত্ব নেন। তিনি নিজ হাতে দরবার পরিচালনা করতেন এবং অভিজাতদের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতেন।
তার ভাই আসাফ খান এবং জামাতা শাহজাহান-এর মাধ্যমে রাজপরিবারের ভবিষ্যৎ কৌশলও তিনি প্রভাবিত করেন। তিনি শাহজাহান ও তার মেয়ে লাডলি বেগমের মধ্যে বিবাহ সম্পাদনের পরিকল্পনাও করেন, যদিও তা সফল হয়নি।
সম্রাজ্ঞী নূরজাহান
নূরজাহান শারীরিকভাবে শক্তিশালী ছিলেন। তিনি প্রায়ই সম্রাটের সাথে বাঘ শিকারে জেতেন।শক্তিশালী বাঘ শিকারি হিসেবে তার খ্যতি ছিল। কথিত আছে তিনি ৬ টি গুলি দিয়ে ৪ টি বাঘ শিকার করেছিলেন। তার বীরত্বের কবিতাও লিখেছেন অনেক কবি।
ইংরেজ দূত টমাস রো লিখে গেছেন মেহের আসলে দেশ শাসন করত। জাহাঙ্গীর ছিল নাম কেওয়াস্তে সম্রাট। সেই সময়কার মুদ্রাতে জাহাঙ্গীর এর সঙ্গে নুরজাহানের ছবিও ছাপা হত। তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে রাজ্য পরিচালনা করতেন। জাহাঙ্গীর এর রাজত্তের শেষ দিকে যখন তার ছেলে খুররম ও সেনাপতি মহাব্বত খা বিদ্রোহ করেন তখন বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করেন নুরজাহান।
সাংস্কৃতিক ও স্থাপত্য অবদান
নূরজাহান কেবল রাজনীতিতেই নয় সংস্কৃতি ও শিল্পের প্রতিও গভীর আগ্রহী ছিলেন। তার নেতৃত্বে নারীদের পোশাক,অলংকার এবং রুচির ক্ষেত্রে নতুন ধারা সৃষ্টি হয়। তার পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠে শিল্প ও স্থাপত্যের বিভিন্ন নিদর্শন।
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো ইতিমাদ-উদ-দৌলা’র সমাধি,যেটি তিনি তার পিতা গিয়াস বেগের স্মৃতিতে আগ্রায় নির্মাণ করেন। এই সমাধিটি মোগল স্থাপত্যের প্রথম মার্বেল-নির্মিত স্থাপনা হিসেবে পরিচিত এবং পরে তাজমহলের পূর্বসূরি হিসেবে বিবেচিত হয়।
নারীর ক্ষমতায়ন ও দৃষ্টান্ত
নূরজাহান নারীর ক্ষমতায়নের এক অনন্য প্রতীক। মোগল যুগে যেখানে নারীরা সাধারণত পর্দার আড়ালে থাকতেন, সেখানে নূরজাহান প্রকাশ্যভাবে শাসন চালাতেন। তিনি সেনাবাহিনীর অভিযান পরিচালনায় অংশ নেন,এমনকি একবার যুদ্ধক্ষেত্রে স্বয়ং তীর-ধনুক হাতে নেতৃত্ব দেন।
তিনি দরিদ্র ও বিধবা নারীদের জন্য সহায়তা দিতেন এবং নারীদের শিক্ষার বিষয়েও সচেতন ছিলেন। তার পদক্ষেপগুলি ভবিষ্যৎ রাজবংশীয় নারীদের সাহস ও স্বাধীনতা অর্জনে পথ দেখায়।
পতন ও শেষ জীবন
১৬২৭ সালে জাহাঙ্গীরের মৃত্যুর পর রাজদরবারে ক্ষমতার ভারসাম্য বদলে যায়। শাহজাহান সিংহাসনে আরোহন করলে নূরজাহান ধীরে ধীরে রাজনীতির বাইরে চলে যান। তিনি লাহোরে এক বিশাল প্রাসাদে অবসর জীবন যাপন করেন। সেখানেই ১৬৪৫ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাকে লাহোরে জাহাঙ্গীরের পাশেই সমাহিত করা হয়।
তার সমাধিস্তম্ভে উৎকীর্ণ আছে একটি বিখ্যাত উর্দু কবিতা:
“Bezār az in chaman, guli moradam madad…
Fariyād az in falak, ke rāhī nadārad.”
(বাংলা অর্থ: “আমি আর এই বাগানে থাকতে চাই না, আমার ফুল হারিয়ে গেছে… আমি আকাশের কাছে ফরিয়াদ জানাই, যে আমার কথা শুনছে না।”)
মৃত্যু
নূরজাহানের শেষ জীবন সুখের হয় নি। তার বিরাট উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল সেজন্য দায়ী। জাহাঙ্গীরের মৃত্যুর পর নূরজাহানও লাহোরেই থেকে যান শেষ পর্যন্ত। অবশেষে বাহাত্তর বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ওই লাহোরেই। তার কবরের গাঁয়ে তার রচিত দুটি লাইন দেখতে পাওয়া যায়, ফারসিতে লেখা। কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলায় অনুবাদ করেন:
“গরীব গোরে দ্বীপ জেলো না,
ফুল দিও না কেউ ভুলে, শ্যামা পোকার না পোড়ে পাখ,
দাগা না পায় বুলবুলে।”
নূরজাহান ছিলেন এক বিস্ময়কর নারী ব্যক্তিত্ব, যিনি সৌন্দর্য, প্রজ্ঞা ও শক্তির অনন্য মিশ্রণ। তিনি কেবল একজন রানী নন,বরং একজন দক্ষ প্রশাসক, কৌশলী কূটনীতিক এবং এক অনুপ্রেরণামূলক নারী। তার জীবন নারীদের জন্য এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত, যেখানে আত্মবিশ্বাস, সাহস ও প্রজ্ঞার মাধ্যমে নারীরা সমাজ ও ইতিহাসের ধারা পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়। মোগল ইতিহাসে নূরজাহান ছিলেন এক উজ্জ্বল নক্ষত্র,যার আলো আজও ইতিহাসের পৃষ্ঠায় দীপ্তিময়।
তথ্যসূত্র:
Lal, Ruby.
Jahangir, Emperor of Hindustan.
Abraham Eraly. The Mughal Throne: The Saga of India’s Great Emperors. Phoenix, 2004.
Archaeological Survey of India (ASI) – Reports on Itimad-ud-Daulah’s Tomb, Agra.
Encyclopaedia Britannica – Entry on Nur Jahan