জামা মসজিদ: মুঘল স্থাপত্যের এক অনন্য রত্ন
মসজিদে জাহান নুমা দিল্লিতে অবস্থিত ভারতের অন্যতম বৃহত্তম একটি মসজিদ। সাধারণভাবে এই মসজিদটি জামা মসজিদ(হিন্দি: जामा मस्जिद, উর্দু: جامع مسجد) নামে পরিচিত।
মসজিদটির প্রথম ইমাম, সৈয়দ আব্দুল গফুর শাহ বুখারী মসজিদটির উদ্ভোধন করেন। ১৮৫৭ সালে মুঘল সাম্রাজ্যের পতন পর্যন্ত এটি ছিল সাম্রাজ্যের প্রধান মসজিদ। মসজিদটি ভারতে ইসলামিক শক্তি এবং ঔপনিবেশিক শাসনে প্রবেশের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত ছিল। ব্রিটিশ শাসনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ সময়ে এটি রাজনৈতিকভাবেও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এটি এখনও চালু আছে এবং এটি দিল্লির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোর একটি, যা যার পরিচিতি পুরান দিল্লির সাথে মিশে আছে।
নামসমুহ
মসজিদটির দুটি নাম রয়েছে। প্রথম নামটি শাহজাহান প্রদত্ত নামটি ছিল “মসজিদ-ই-জাহাননামা”, যা অনুবাদ করলে ফার্সি ও উর্দু ভাষায় “পৃথিবীর প্রতিবিম্ব মসজিদ”। এর আরেক নাম হলো জামে মসজিদ, যা সাধারণ মানুষের কাছে প্রচলিত। আরবিতে এর প্রকৃত অর্ত “জামে মসজিদ”। মসজিদটিতে জুম্মার নামায অনুষ্ঠিত হয়, তাই এটিকে জামে মসজিদ বলা হয়। “জামে মসজিদ” নামটি শুধুমাত্র এই মসজিদটির মসজিদ ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় না। ৭ম শতাব্দী থেকে শব্দটি ইসলামিক বিশ্বে সাম্প্রদায়িক মসজিদ নির্দেশ করতে ব্যবহৃত হয়, আর এ কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন মসজিদ এই নামে পরিচিত।
অবস্থান
মসজিদটি শাহজানাবাদে (বর্তমানে: পুরান দিল্লি) অবস্থিত। মসাজিদটির অপর প্রান্তে রয়েছে লালকেল্লা এবং সুনেরি মসজিদ।দিল্লির কেন্দ্রে অবস্থান করায় এর মসজিদটির আশেপাশে ঐতিহাসিক চাঁদনি চক সহ অনেক ব্যবসা কেন্দ্র রয়েছে। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা, আবুল কালাম আজাদ এর সমাধি এই মসজিদের সাথে সংলগ্ন রয়েছে।
নির্মাণ এবং ইতিহাস
মুঘল সম্রাট, শাহজাহান ১৬৪৪ হতে ১৬৫৬ সালের মধ্যে শাহাজানাবাদের সবচেয়ে উঁচু স্থানে মসজিদটি নির্মাণ করেন। মসজিদটির নকশা করেন স্থপতি, উস্তব খলিল এবং এর নির্মাণে প্রায় ৫০০০ জন শ্রমিক কাজ করেন। এ নিমার্ণে তুর্কি, আরব, পারস্য এবং ইউরোপ সহ বিভিন্ন দেশের মানুষ কাজ করেন। এ নির্মানের তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে ছিলেন শাহজাহান এর উজির (বা প্রধান মন্ত্রী), সাদুল্লাহ খান এবং শাহজাহান এর পরিবারের হিসাবাধ্যক্ষ, ফজিল খান। সে সময় অনুযায়ী, নির্মাণ করতে প্রায় ১০ লাখ (১ মিলিয়ন) রুপি খরচ হয়। ১৬৫৬ সালের জুলাই মাসের ২৩ তারিখে উজবেকিস্তানের বুখারি থেকে আগত সৈয়দ আব্দুল গফুর শাহ বুখারি মসজিদটির উদ্ভোধন করেন।
মসজিদটি ছিল শাহজাহানের শাসনামলে নির্মিত শেষ স্থাপত্য। মুঘল যুগের শেষ পর্যন্ত এটি সম্রাটদের রাজকীয় মসজিদ ছিল। এই মসজিদেই শাহজাহান জুম্মার নামাযে খুতবা দিয়ে তার শাসনামল আনুষ্ঠানিক করেন। মসজিদটি ভারতে মুঘলদের সার্বভৌমত্বের প্রতীক হওয়ায় সেটি রাজনৈতিকভাবেও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। মসজিদটি শাহজাহানাবাদে বসবাসকারী মানুষের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল, যেখানে শ্রেণিভাগ অতিক্রম করে মানুষ একে অপরের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করতে পারত। শাহজানাবাদের মানুষ এখানে শ্রেণিভাগ ভূলে একে অপরের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতে পারত, তাই মসজিদটি তাদের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
স্থাপত্যশৈলী
শাহজাহান এর নতুন রাজধানী শাহজানাবাদের এর অংশ হিসেবে জামে মসজিদ তৈরি হয়। এটি মূঘল শাসনামলে নির্মিত মসজিদগুলোর মধ্যে সর্বোত্তম হিসেবে বিবেচিত এবং মার্বেল ও চুনাপাথরের সর্বোত্তম মিশ্রণ।নির্মাণের সময়ে ভারতীয় উপমহাসাগরে এটিই ছিল বৃহত্তম মসজিদ। শাহজাহান বলেন যে, মসজিদটি ফাতেহপুর সিকরির জামে মসজিদের নকশা অনুসরণে তৈরি করা হয়।
এ বিষয়টি মসজিদটির বাহিরের সম্মুখভাগ এবং উঠান লক্ষ্য করা যায়। মসজিদটির ভেতরের অংশের সাথে আগ্রার জামে মসজিদের অধিক সাদৃশ্য রয়েছে। মসজিদটিতে লাল বেলেপাথর সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়েছে এবং আগের মসজিদগুলোর তুলনায় এটিতে অধিক সাদা মার্বেল ব্যবহার করা হয়েছে। এটি সাজাতে কালো মার্বেলও ব্যবহার করা হয়েছে। এর বিভিন্ন দেয়ালে ধমীয় ও প্রসংশামূলক সহ বিভিন্ন বিষয়ক আরব এবং ফার্সি ভাষার লিপির অংশ সাজানো আছে।
পাহাড়ের উপর নির্মিত হওয়ায় মসজিদটি শহরের তুলনায় ১০ মিটার উঁচু একটি স্তম্ভমূলের উপর অবস্থিত। মসজিদটি এমনভাবে নির্মিত যে, এর পেছনের দেয়ালের মুখ পশ্চিম দিকে, মক্কার দিকে। একটি কলেজ, ঔষধালয় এবং মাদ্রাসা মসজিদটির সাথে সংলগ্ন ছিল। ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহে সেগুলো ধ্বংস হয়ে যায়।
প্রবেশ পথ
মসজিদটির বেলেপাথরের তৈরি ৩টি প্রবেশ পথ রয়েছে। এর মধ্যে প্রধান হলো ৩ তলা উচ্চতাবিশিষ্ট পূর্ব প্রবেশ পথ, যা ইতিহাসে রাজকীয় ব্যাক্তিদের প্রবেশ পথ হিসেবে ব্যবহার হতো এবং তা সম্রাট এবং তার সাথে জড়িত ব্যাক্তিদের ব্যবহারের জন্য সংরক্ষিত ছিল। দুই তলা উচ্চতাবিশিষ্ট দক্ষিণ প্রবেশ পথটি সাধারণ মানুষ ব্যবহার করত। প্রতিটি প্রবেশ পথের ৩ পাশে বেলেপাথরের সিঁড়ি আছে। সেখানে সাদা কিছু চিহ্ন ছিল, যা প্রার্থনাকারীদের প্রার্থনার দিক নির্ধারণে সহায়তা করত। উত্তর প্রবেশ পথের ক্যাবিনেটে মুহাম্মদ এর অবশেষের একটি সংগ্রহশালা আছে, যার মধ্যে রয়েছে: হরিণের চামড়ায় লিখিত পবিত্র কুরআনের আয়াত , হযরত মুহাম্মদ (সা:) এর দাড়ির একটি চুল, তার জুতা এবং মার্বেলের আবরণের উপর তার পায়ের ছাঁপ।
উঠান
উঠানটি লাল বেলেপাথরের তৈরি এবং পূর্ব প্রবেশ পথ বরাবর। এর পাশ্বীয় দৈর্ঘ্য কমপক্ষে ৯৯ মিটার এবং প্রায় ২৫,০০০ প্রার্থনাকারী সেখানে প্রার্থনা করতে পারে। এর কেন্দ্রে রয়েছে অযু করার জন্য ১৭ মিটার দৈর্ঘ্য এবং ১৫ মিটার প্রস্থ বিশিষ্ট একটি ট্যাঙ্ক। উঠানের ধারে একটি খোলা পথ রয়েছে। সেখান থেকে মসজিদের পরিবেশ দেখা যায়। পথগুলোতে উঠানের চারদিকে চারটি চাত্রী আছে।
প্রার্থনা হল
প্রার্থনা হলটির দৈর্ঘ্য ৬১ মিটার এবং প্রস্থ ২৭ মিটার। ছাদের উপর তিনটি মার্বেলের তৈরি গম্বুজ আছে, যার শীর্ষ সোনার তৈরি। সম্মুখভাগের কেন্দ্রে রয়েছে একটি পিস্তাক, যার দুই পাশে দুটি ছোট আচ্ছাদিত পথ আছে। প্রতিটি আচ্ছাদিত পথের উপরে কিছু লিপি সাজানো আছে। হলের ভিতরের পশ্চিম দেয়ালে ৭টি মিহরাব আছে, যা হলটি যে সাতটি ভাগে বিভক্ত সেগুলোকে নির্দেশ করে। কেন্দ্রীয় মিহরাবটি জটিলভাবে মার্বেল দিয়ে সজ্জিত এবং এর ডান পাশে রয়েছে মার্বেলের তৈরি একটি মিনার। হলটির মেঝে যাতে মুসলিমদের প্রার্থনার মাদুরের মতো দেখতে মনে হয়, তাই সেটি অলংকৃত মার্বেল দিয়ে তৈরি করা হয়।
মিনার
মসজিদের গম্বুজগুলোর দুই পাশে দুটি মিনার রয়েছে, যার একটি উত্তর-পূর্ব এবং অন্যটি দক্ষিণ-পূর্ব কোণে অবস্থিত। সেগুলো ৪ মিটার উঁচু এবং অনুদৈর্ঘ্য বরাবর সাদা মার্বেল দিয়ে সজ্জিত। প্রতিটি মিনার ১৩০ পায়ের সমান দূরত্ব নিয়ে গঠিত এবং এর আশেপাশে ৩টি স্থানে দর্শন গ্যালারি আছে। প্রতিটি মিনারের উপরে একটি করে মার্বেলের তৈরি চাত্রী আছে।
রক্ষণাবেক্ষণ ও চ্যালেঞ্জ
বছরের পর বছর ধরে জামা মসজিদ বহু প্রাকৃতিক ও রাজনৈতিক সংকটের মুখোমুখি হয়েছে— যেমন ব্রিটিশ উপনিবেশ আমলে ক্ষয়ক্ষতি, আধুনিককালে দূষণ এবং নগরায়নের চাপ। বর্তমানে ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগ (ASI) ও মসজিদ কর্তৃপক্ষ এর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করছে।
জামা মসজিদ শুধু একটি মসজিদ ই নয়, এটি একটি যুগের ইতিহাস, একটি স্থাপত্যশিল্পের নিদর্শন, একটি ধর্মীয় অনুভূতির কেন্দ্রবিন্দু। এটি ভারতের বৈচিত্র্যপূর্ণ ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের গর্ব। ৩৭০ বছরের পুরনো এই স্থাপনা আজও যে কতটা প্রাসঙ্গিক এবং অনুপ্রেরণাদায়ক, তা প্রতিদিন প্রমাণ করে চলে হাজারো মানুষের উপস্থিতি, প্রার্থনা এবং বিস্ময়ভরা চোখের দৃষ্টিতে।
তথ্যসূত্র:
Archaeological Survey of India (ASI)
“The Great Mughals” – Bamber Gascoigne
Britannica Encyclopedia
Delhi Tourism Dept.
Indian Express Archive