ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর: বাংলার সমাজসংস্কার ও শিক্ষার অগ্রদূত
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮২০ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার ( পূর্বে অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলা) বীরসিংহ গ্রামে ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ভগবতী দেবীর ঘরে এক হিন্দু ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন । পরিবারটির আদি নিবাস ছিল বর্তমান হুগলি জেলার বনমালীপুর থেকে । ৯ বছর বয়সে, তিনি কলকাতায় যান এবং বড়বাজারে ভাগবত চরণের বাড়িতে থাকতে শুরু করেন , যেখানে ঠাকুরদাস ইতিমধ্যেই কয়েক বছর ধরে অবস্থান করছিলেন।
ঈশ্বর ভাগবতের বৃহৎ পরিবারের মধ্যে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন এবং অল্প সময়ের মধ্যেই আরামে বসতি স্থাপন করেন। ভাগবতের কনিষ্ঠ কন্যা রাইমনির ঈশ্বরের প্রতি মাতৃসুলভ এবং স্নেহপূর্ণ অনুভূতি তাকে গভীরভাবে স্পর্শ করে এবং নারীদের উন্নয়নের জন্য তার পরবর্তী বিপ্লবী কাজের উপর একটি শক্তিশালী প্রভাব ফেলে। তিনি নারী শিক্ষার পক্ষে লড়াই করেন।
জ্ঞানের প্রতি তাঁর আগ্রহ এতটাই তীব্র ছিল যে তিনি রাস্তার আলোর নিচে পড়াশোনা করতেন কারণ বাড়িতে গ্যাসের বাতি লাগানো তার পক্ষে সম্ভব ছিল না তিনি সমস্ত পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে এবং দ্রুত উত্তীর্ণ হন। তাঁর শিক্ষাগত দক্ষতার জন্য তিনি বেশ কয়েকটি বৃত্তি লাভ করেন। নিজের এবং পরিবারের ভরণপোষণের জন্য, ঈশ্বরচন্দ্র জোড়াশাঙ্কোতে খণ্ডকালীন শিক্ষকতার চাকরিও গ্রহণ করেন।
ঈশ্বরচন্দ্র কলকাতার সংস্কৃত কলেজে যোগদান করেন এবং সেখানে দীর্ঘ বারো বছর পড়াশোনা করেন এবং ১৮৪১ সালে সংস্কৃত ব্যাকরণ, সাহিত্য, দ্বান্দ্বিকতা [অলংকার শাস্ত্র], বেদান্ত, স্মৃতি এবং জ্যোতির্বিদ্যায় স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন তখনকার রীতি অনুসারে ঈশ্বরচন্দ্র চৌদ্দ বছর বয়সে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁর স্ত্রী ছিলেন দীনময়ী দেবী। নারায়ণ চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন তাদের একমাত্র পুত্র।
১৮৩৯ সালে, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তার সংস্কৃত আইন পরীক্ষায় সাফল্যের সাথে উত্তীর্ণ হন। ১৮৪১ সালে, একুশ বছর বয়সে, ঈশ্বরচন্দ্র ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে সংস্কৃত বিভাগের প্রধান হিসেবে যোগদান করেন।
পাঁচ বছর পর, ১৮৪৬ সালে, বিদ্যাসাগর ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ ত্যাগ করেন এবং সংস্কৃত কলেজে ‘সহকারী সচিব’ হিসেবে যোগদান করেন। চাকরির প্রথম বছরেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যমান শিক্ষা ব্যবস্থায় বেশ কিছু পরিবর্তন আনার সুপারিশ করেন। এই প্রতিবেদনের ফলে ঈশ্বরচন্দ্র এবং কলেজ সচিব রসময় দত্তের মধ্যে তীব্র বিবাদ শুরু হয়। ১৮৪৯ সালে, রসময় দত্তের পরামর্শের বিরুদ্ধে, তিনি সংস্কৃত কলেজ থেকে পদত্যাগ করেন এবং ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে প্রধান কেরানি হিসেবে পুনরায় যোগদান করেন।
বিধবা পুনর্বিবাহ আইন
বিদ্যাসাগর ভারতে, বিশেষ করে তাঁর জন্মভূমি বাংলায় নারীর মর্যাদা বৃদ্ধির পক্ষে ছিলেন । অন্যান্য সংস্কারকদের বিপরীতে, যারা বিকল্প সমাজ বা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, তিনি সমাজকে ভেতর থেকে রূপান্তরিত করার চেষ্টা করেছিলেন। বিদ্যাসাগর বাল্যবিবাহ এবং পুরুষদের বহু মেয়েকে বিবাহ করার (বহুবিবাহ) বিরুদ্ধেও লড়াই করেছিলেন ।
সংস্কৃত শাস্ত্রের বিরাট পণ্ডিত হয়েও পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতি গ্রহণে দ্বিধা করেননি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। নারীমুক্তি আন্দোলনের প্রবল সমর্থক ছিলেন তিনি। হিন্দু বিধবাদের অসহনীয় দুঃখ, তাদের প্রতি পরিবারবর্গের অন্যায়, অবিচার, অত্যাচার গভীরভাবে ব্যথিত করেছিল তাকে। এই বিধবাদের মুক্তির জন্য তিনি আজীবন সর্বস্ব পণ করে সংগ্রাম করেছেন। হিন্দুশাস্ত্র উদ্ধৃত করে প্রমাণ করেছেন, যে লোকাচার ধর্মের নামে সমাজে প্রচলিত, আসলে তা ধর্মবহির্ভূত স্থবিরতার আচারমাত্র। তার আন্দোলন সফল হয়েছিল।
১৮৫৬ সালে সরকার বিধবা বিবাহ আইনসিদ্ধ ঘোষণা করেন। তবে শুধু আইন প্রণয়নেই ক্ষান্ত থাকেননি বিদ্যাসাগর মহাশয়। তার উদ্যোগে একাধিক বিধবা বিবাহের অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। তার পুত্রও( নারায়ণচন্দ্র) এক ভাগ্যহীনা বিধবাকে বিবাহ করেন। এজন্য সেযুগের রক্ষণশীল সমাজ ও সমাজপতিদের কঠোর বিদ্রুপ ও অপমানও সহ্য করতে হয় তাকে। বিধবা বিবাহ প্রবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বহুবিবাহের মতো একটি কুপ্রথাকে নির্মূল করতেও আজীবন সংগ্রাম করেন বিদ্যাসাগর মহাশয়। প্রচার করেন বাল্যবিবাহ রোধের সপক্ষেও। এর সঙ্গে সঙ্গে নারীশিক্ষার প্রচারেও যথাযথ গুরুত্ব আরোপ করেন তিনি। শুধু কলকাতায় নয়, নারীমুক্তির বার্তা বাংলার গ্রামে গ্রামে ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে, বিভিন্ন জেলাতেও বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করে নারীশিক্ষার সপক্ষে জোর প্রচার চালান তিনি। যদিও তার এই উদ্যোগও সমাজের অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তিত্ব দ্বারা নিন্দিত হয়। কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত পর্যন্ত অত্যন্ত হীন বাক্যবাণে নারীমুক্তি আন্দোলনের ব্যঙ্গ করেন। তবু তার জীবদ্দশাতেই নারীশিক্ষা আন্দোলন ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল।
ব্যক্তিত্ব ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য
বিদ্যাসাগর ছিলেন দৃঢ়চেতা, সৎ এবং নীতিবান মানুষ। তিনি কোনোরকম সামাজিক বা ধর্মীয় বাধাকে ভয় না করে নিজের যুক্তি ও বিবেক অনুযায়ী কাজ করতেন। দারিদ্র্যপীড়িতদের প্রতি তাঁর অসীম দয়া ছিল। বহু দরিদ্র শিক্ষার্থীকে তিনি ব্যক্তিগতভাবে সাহায্য করেছেন।
উল্লেখযোগ্য রচনা:
- বর্ণপরিচয় (১ম ও ২য় খণ্ড)
- বেতালপঞ্চবিংশতি
- শকুন্তলা অনুবাদ
- সীতার বনবাস
- সংস্কৃত ভাষা ও ব্যাকরণের নানা গ্রন্থ
মৃত্যু ও উত্তরাধিকার
১৮৯১ সালের ২৯ জুলাই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর পরলোকগমন করেন। তাঁর মৃত্যুতে বাংলা হারায় এক মহান শিক্ষাবিদ, সমাজসংস্কারক ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রবর্তককে।
আজও তাঁর স্মৃতি ও আদর্শ বাংলার শিক্ষা ও সমাজচিন্তায় প্রেরণা জোগায়। তাঁকে শ্রদ্ধার সঙ্গে ‘বাংলা নবজাগরণের প্রভাতসূর্য’ বলা হয়।
তথ্যসূত্র:
- পশ্চিমবঙ্গ সরকারের শিক্ষাবিভাগ
- বাংলা একাডেমি প্রকাশিত জীবনী
- ঐতিহাসিক গ্রন্থ: “ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর: জীবন ও কর্ম”
- কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংরক্ষিত দলিল