চীনের পা বাঁধা প্রথা
একটি বেদনাদায়ক সৌন্দর্যবোধের ইতিহাস
চীনের ইতিহাসে পা বাঁধা (Foot Binding) ছিল এক যুগব্যাপী নির্মম প্রথা, যা নারীদের শরীরের ওপর চরম দমন ও নিপীড়নের প্রতীক। এটি ১০ শতকের দিকে শুরু হয়ে প্রায় এক সহস্রাব্দ ধরে, বিশেষত অভিজাত শ্রেণির মধ্যে প্রচলিত ছিল। সমাজে সৌন্দর্য, শুদ্ধতা ও মর্যাদার বিকৃত ধারণাকে কেন্দ্র করেই এই প্রথার জন্ম ও বিস্তার।
কীভাবে পা বাঁধা হতো?
পা বাঁধার প্রক্রিয়া শুরু হতো মেয়েদের খুব ছোট বয়সে—সাধারণত ৪ থেকে ৬ বছর বয়সে। তখন তাদের পায়ের আঙুলগুলো নিচের দিকে ভাঁজ করে শক্ত কাপড় বা ব্যান্ডেজ দিয়ে জোর করে বাঁধা হতো।
এতে ধীরে ধীরে পায়ের হাড় বিকৃত হয়ে যেত
পায়ের দৈর্ঘ্য মাত্র ৩–৪ ইঞ্চিতে সীমিত হয়ে আসত
একে বলা হতো “Golden Lotus” বা “স্বর্ণ কমল পা”
জুতার ডিজাইনও পদ্মফুলের মতো হতো এবং মেয়েরা সেই ছোট জুতা পরত, যা হাঁটাচলায় চরম যন্ত্রণা তৈরি করত।
এই প্রথার পেছনে কী ছিল?
সৌন্দর্যের প্রতীক
ছোট পা অভিজাত, মার্জিত ও কাঙ্ক্ষিত নারীত্বের চিহ্ন হিসেবে দেখা হতো। এটি একধরনের সামাজিক ফ্যাশন বা স্ট্যাটাস সিম্বল ছিল।
বৈবাহিক যোগ্যতা
ছোট পা থাকা মানেই নারীর “ভাল” পরিবারে বিয়ে হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। অনেক পরিবার মেয়ের ভবিষ্যৎ বিয়ে নিশ্চিত করার জন্য এই যন্ত্রণা চাপিয়ে দিত।
সামাজিক নিয়ন্ত্রণ
পা বাঁধার ফলে মেয়েরা সঠিকভাবে চলাফেরা করতে পারত না। এটি তাদের গৃহবন্দী করে রাখত এবং পুরুষনির্ভর অবস্থাকে আরও পোক্ত করত।
শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণা
পা বাঁধা শুধু একটি “ফ্যাশন” ছিল না, এটি ছিল আজীবনের শারীরিক নিপীড়ন।
হাড় চিরতরে বিকৃত হয়ে যেত
সংক্রমণ, পচন, পায়ের আঙুল খসে যাওয়া ছিল সাধারণ ঘটনা
অনেক নারী সারাজীবন ব্যথায় কাতরাতেন
মানসিকভাবে তারা হয়ে পড়তেন নির্যাতিত, নিঃসঙ্গ
প্রথার নিষেধাজ্ঞা ও অবসান
চীনে ১৯১১ সালের সিনহাই বিপ্লবের পর এই প্রথার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া হয়। আনুষ্ঠানিকভাবে এটি ১৯১২ সালে নিষিদ্ধ হয়, তবে গ্রামীণ অঞ্চলগুলোতে ২০ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত এটি গোপনে চলতে থাকে।
ইতিহাসে কী রেখে গেল এই প্রথা?
চীনা সমাজে পা বাঁধার ইতিহাস এক অন্ধকার অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়। এটি নারীর প্রতি সহিংসতা, সামাজিক নিয়ন্ত্রণ এবং বিকৃত সৌন্দর্যবোধের প্রতীক হয়ে রয়ে গেছে।
আজ এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়:
নারীর স্বাধীনতা ও অধিকার কতটা গুরুত্বপূর্ণ
সামাজিক সৌন্দর্য ধারণা কতটা নিষ্ঠুর হতে পারে
অভিজাত সংস্কৃতিও মাঝে মাঝে বর্বরতার ছদ্মবেশ নিতে পারে
পা বাঁধার মতো প্রথা আজকের সমাজে আমাদের শিক্ষা দেয়, সৌন্দর্য, মর্যাদা কিংবা নারীসত্ত্বার সংজ্ঞা কখনোই শারীরিক নিপীড়নের ওপর ভিত্তি করে গড়া উচিত নয়। ইতিহাসের এই মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা নারী স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের পক্ষে এক গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্য হয়ে আছে।
মূল উৎসসমূহ:
Ko, Dorothy. Cinderella’s Sisters: A Revisionist History of Footbinding. University of California Press, 2005.
একটি বিস্তৃত গবেষণাগ্রন্থ যা চীনের পা বাঁধা প্রথার সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করে।
Howard Levy. Chinese Footbinding: The History of a Curious Erotic Custom. Walton Rawls, 1966.
ঐতিহাসিক দলিল ও ভ্রমণকথার ভিত্তিতে এই প্রথার ক্রমবিকাশ ও মনস্তত্ত্ব ব্যাখ্যা করা হয়েছে।