মাহারি নৃত্য ওড়িশার মন্দিরনৃত্যের এক প্রাচীন উত্তরাধিকার
ভারতের ঐতিহ্যবাহী নৃত্যশিল্পের ভাণ্ডারে মাহারি নৃত্য একটি বিস্ময়কর সম্পদ। ওড়িশার জগন্নাথ মন্দিরের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত এই নৃত্যশৈলী শুধুমাত্র এক সাংস্কৃতিক চর্চা নয়, বরং একটি আধ্যাত্মিক উৎসর্গ, যা দেবতার সেবা ও অনুরাগের রূপ।
মাহারি শব্দের অর্থ ও উৎপত্তি
“মাহারি” শব্দটি এসেছে সংস্কৃত “মহারি” (মহা+নারী) থেকে, যার অর্থ “মহৎ নারী”। এই নর্তকীরা ছিলেন সেই সব নারী, যারা নিজেকে ভগবান জগন্নাথের সেবায় নিবেদিত করতেন। মন্দিরে বসবাস করে, তারা নৃত্যের মাধ্যমে ভগবানের পূজা করতেন।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
মাহারি নৃত্যের উৎপত্তি ও বিকাশ ওড়িশার পুরী জগন্নাথ মন্দিরকে ঘিরেই।
এটি মূলত দেবদাসী প্রথার একটি রূপ, যেখানে নারী শিল্পীরা মন্দিরে নিযুক্ত হয়ে ভগবানের সম্মুখে নৃত্য পরিবেশন করতেন।
রাজা চোড়গঙ্গ দেব (১১শ শতক) ও গজপতি রাজারা এই প্রথা সংরক্ষণে সহায়তা করেন।
মাহারি নৃত্যের বৈশিষ্ট্য
ভক্তিমূলক বিষয়বস্তু: মাহারি নৃত্যের প্রতিটি পরিবেশনা ভগবান বিষ্ণু বা জগন্নাথকে উদ্দেশ্য করে।
অভিনয় ও নাভা রস: নৃত্যশৈলীতে ‘অভিনয়’ (অঙ্গভঙ্গি ও মুখভঙ্গি) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
গীত-গোবিন্দ উপস্থাপনা: জয়দেবের “গীতগোবিন্দ” কাব্য মাহারি নৃত্যের প্রধান অনুপ্রেরণা।
সংগীত: ওড়িয়া, সংস্কৃত ও সংস্কৃত-ওড়িয়া মিশ্র ভাষায় রচিত ভজন ও পদ গাওয়া হয়।
পরিচ্ছদ: ঐতিহ্যবাহী ওড়িশি সাজ, ফুলের অলংকার, এবং সাদা পাড়ের লাল শাড়ি।
মাহারি ও ওড়িশি নৃত্য
মাহারি নৃত্যই পরবর্তীকালে ধীরে ধীরে রূপান্তরিত হয় ওড়িশি নৃত্যে। যখন মন্দির প্রাঙ্গণে দেবদাসী প্রথা বিলুপ্ত হতে থাকে, তখন এই ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখতে শিল্পীরা মঞ্চনৃত্য রূপে ওড়িশি নৃত্য গড়ে তোলেন।
আধুনিক প্রভাব ও সংরক্ষণ প্রচেষ্টা
বর্তমানে কিছু সাংস্কৃতিক সংগঠন ও গবেষক মাহারি নৃত্য পুনরুজ্জীবিত করার কাজ করছেন। এটি ওড়িশার সাংস্কৃতিক পরিচয়ের এক অপরিহার্য অংশ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
মাহারি নৃত্য শুধুমাত্র এক নৃত্যশৈলী নয়, বরং এক ঐশ্বরিক ভক্তির প্রকাশ। ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্যের ইতিহাসে এর গুরুত্ব অপরিসীম। এই ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখা মানেই আমাদের সাংস্কৃতিক শিকড়কে সম্মান জানানো
তথ্যসূত্র:
Orissa Tourism Department
“Mahari Dance Tradition of Orissa” – Dr. Ileana Citaristi
Indian Classical Dance Archives