বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের রহস্য
বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল (Bermuda Triangle), যাকে “ডেভিলস ট্রায়াঙ্গেল” নামেও ডাকা হয়, একটি রহস্যময় ভৌগোলিক অঞ্চল যা বহু বছর ধরে বিজ্ঞানী, নাবিক এবং সাধারণ মানুষের কৌতূহলের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। এটি মূলত উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের পশ্চিম অংশে অবস্থিত এবং এর ত্রিভুজাকার এলাকা গঠিত হয়েছে তিনটি বিন্দুর মাধ্যমে:
বারমুডা দ্বীপপুঞ্জ
মিয়ামি (ফ্লোরিডা, যুক্তরাষ্ট্র)
সান হুয়ান (পুয়ের্তো রিকো)
এই অঞ্চলটির মোট আয়তন প্রায় ৫,০০,০০০ বর্গমাইল। নামটি প্রথম প্রচলিত হয় ২০ শতকের মধ্যভাগে, এবং এরপর থেকেই এটি নানা রহস্য, দুর্ঘটনা ও কল্পকাহিনির উৎস হয়ে ওঠে।
বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের ইতিহাস ও উৎপত্তি
বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের রহস্য শুরু হয় মূলত ২০ শতকের মাঝামাঝি। এর আগে আটলান্টিক মহাসাগরে জাহাজডুবি বা হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটলেও সেগুলো আলাদা আলাদা দুর্ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হত। কিন্তু ১৯৫০-এর দশকে সংবাদপত্রে ও ম্যাগাজিনে কিছু আর্টিকেল প্রকাশিত হয় যেখানে বলা হয় এই অঞ্চলে জাহাজ ও বিমান রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছে।
সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা – ফ্লাইট ১৯:
৫ ডিসেম্বর ১৯৪৫ সালে মার্কিন নৌবাহিনীর পাঁচটি বোমারু বিমান প্রশিক্ষণ ফ্লাইটে বের হয়েছিল। এই ফ্লাইটকে ফ্লাইট ১৯ বলা হয়। তারা উড্ডয়নের পর যোগাযোগ হারিয়ে ফেলে এবং কোনো চিহ্ন ছাড়াই অদৃশ্য হয়ে যায়। অনুসন্ধানে পাঠানো উদ্ধারকারী বিমানও নিখোঁজ হয়ে যায়। এই ঘটনাই বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের রহস্যকে বিশ্বজুড়ে আলোচনায় নিয়ে আসে।
ভূগোল ও জলবায়ু বৈশিষ্ট্য
বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল কোনো আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃত ভৌগোলিক অঞ্চল নয়, তবে সাধারণত এর সীমানা হিসেবে ধরা হয়:
উত্তরে বারমুডা দ্বীপপুঞ্জ
দক্ষিণে পুয়ের্তো রিকো
পশ্চিমে মিয়ামি, ফ্লোরিডা
এ অঞ্চলের জলবায়ু খুবই পরিবর্তনশীল। আটলান্টিক মহাসাগরের এই অংশে:
হঠাৎ ঝড়, ট্রপিক্যাল সাইক্লোন ও হারিকেন, গালফ স্ট্রিম নামক প্রবল স্রোত, এসবের কারণে নৌযান ও বিমান চলাচল ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।
রহস্যময় নিখোঁজ ঘটনার তালিকা
বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের কুখ্যাতি মূলত কিছু বড় বড় দুর্ঘটনার জন্য। কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা:
ফ্লাইট ১৯ (১৯৪৫): পাঁচটি মার্কিন নৌবাহিনীর বিমান ও ১৪ জন ক্রু নিখোঁজ।
USS Cyclops (১৯১৮): ৫৪২ জন ক্রুসহ বিশাল জাহাজ কোনো চিহ্ন ছাড়াই হারিয়ে যায়।
Douglas DC-3 বিমান (১৯৪৮): ৩২ জন যাত্রীসহ নিখোঁজ।
Star Tiger ও Star Ariel (১৯৪৮-৪৯): দুটি যাত্রীবাহী বিমান অদৃশ্য হয়ে যায়।
এই ঘটনাগুলির মধ্যে অনেক ক্ষেত্রে কোনো ধ্বংসাবশেষ বা মৃতদেহ পাওয়া যায়নি, যা রহস্যকে আরও ঘনীভূত করেছে।
সম্ভাব্য প্রাকৃতিক ও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা
বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল রহস্যের পেছনে বহু তত্ত্ব রয়েছে। এর মধ্যে কিছু বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা হলো:
ক) খারাপ আবহাওয়া
হারিকেনগুলি হলো শক্তিশালী ঝড় যা গ্রীষ্মকালীন সময়ে তৈরি হয় এবং এর ফলে ঐতিহাসিকভাবে হাজার হাজার প্রাণ হারিয়েছে এবং বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়েছে। ১৫০২ সালে ফ্রান্সিসকো ডি বোবাডিলার স্প্যানিশ নৌবহর ডুবে যাওয়া ছিল একটি ধ্বংসাত্মক হারিকেনের প্রথম নথিভুক্ত উদাহরণ। এই ঝড় অতীতে ট্রায়াঙ্গেল সম্পর্কিত বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটিয়েছে। অনেক আটলান্টিক হারিকেন ট্রায়াঙ্গেলের মধ্য দিয়ে যায় যখন তারা পূর্ব সমুদ্র তীরে ফিরে আসে এবং আবহাওয়া উপগ্রহের আবির্ভাবের আগে, জাহাজগুলিতে প্রায়শই হারিকেনের পদ্ধতির কোনও সতর্কতা ছিল না।
১৪ মে, ১৯৮৬-এ প্রাইড অফ বাল্টিমোরের ডুবে যাওয়ার কারণ হিসাবে আর্দ্র বাতাসের একটি শক্তিশালী ডাউনড্রাফ্টকে সন্দেহ করা হয়েছিল। ডুবে যাওয়া জাহাজের নাবিকরা লক্ষ্য করেছেন যে বাতাস হঠাৎ সরে গেছে এবং বেগ বেড়েছে ৩২ কিমি/ঘ (২০ মা/ঘ) থেকে ৯৭–১৪৫ কিমি/ঘ (৬০–৯০ মা/ঘ) । ন্যাশনাল হারিকেন সেন্টার স্যাটেলাইট বিশেষজ্ঞ জেমস লুশাইন বলেছেন, “খুবই অস্থিতিশীল আবহাওয়ার সময়ে উপরে থেকে ঠান্ডা বাতাসের বিস্ফোরণ একটি বোমার মতো পৃষ্ঠে আঘাত করতে পারে, বাতাস এবং জলের একটি বিশাল স্কুয়াল লাইনের মতো বাইরের দিকে বিস্ফোরিত হতে পারে। ব্রাজিলের উপকূলে ২০১০ সালে কনকর্ডিয়াতে একই ধরনের ঘটনা ঘটেছিল।
খ) নেভিগেশনাল ত্রুটি
এখানে কম্পাসে চৌম্বকীয় অস্বাভাবিকতা দেখা যেতে পারে।
পুরনো নেভিগেশন সিস্টেমে ভুল দিকনির্দেশের কারণে জাহাজ বা বিমান হারিয়ে যেত।
গ) মিথেন হাইড্রেট
কিছু অন্তর্ধানের জন্য একটি ব্যাখ্যা মহাদেশীয় তাকগুলিতে মিথেন হাইড্রেটের (প্রাকৃতিক গ্যাসের একটি রূপ) বড় ক্ষেত্রগুলির উপস্থিতির উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছে। অস্ট্রেলিয়ায় করা পরীক্ষাগারে করা পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে যে বুদবুদ, প্রকৃতপক্ষে, জলের ঘনত্ব হ্রাস করে একটি স্কেল মডেল জাহাজ ডুবিয়ে দিতে পারে; যে কোনো ধ্বংসাবশেষ ফলস্বরূপ ভূপৃষ্ঠে উঠলে উপসাগরীয় স্রোত দ্বারা দ্রুত বিচ্ছুরিত হবে। এটি অনুমান করা হয়েছে যে পর্যায়ক্রমিক মিথেন অগ্ন্যুৎপাত ফেনাযুক্ত জলের অঞ্চল তৈরি করতে পারে যা আর জাহাজের জন্য পর্যাপ্ত প্লবতা সরবরাহ করতে সক্ষম নয়। একটি জাহাজের চারপাশে যদি এই ধরনের একটি এলাকা তৈরি করা হলে জাহাজটি খুব দ্রুত এবং সতর্কতা ছাড়াই ডুবে যেতে পারে।
ইউএসজিএসের প্রকাশনাগুলি দক্ষিণ-পূর্ব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপকূলে ব্লেক রিজ এলাকা সহ বিশ্বব্যাপী সমুদ্রের নিচের হাইড্রেটের বিশাল ভাণ্ডার বর্ণনা করে। যাইহোক, ইউএসজিএস-এর মতে, গত ১৫,০০০ বছর ধরে বারমুডা ট্রায়াঙ্গলে গ্যাস হাইড্রেটের কোনো বড় ধরনের প্রকাশ ঘটেনি।
ঘ) মানুষের ত্রুটি
কোনো বিমান বা জাহাজের ক্ষতির বিষয়ে সরকারী অনুসন্ধানে সবচেয়ে উদ্ধৃত ব্যাখ্যাগুলির মধ্যে একটি হলো মানুষের ত্রুটি।
অতিপ্রাকৃত ও ষড়যন্ত্র তত্ত্ব
বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলকে ঘিরে অনেক অদ্ভুত ধারণা রয়েছে, যেমন:
ভিনগ্রহবাসীর অপহরণ
সময়ের ফাঁদ (Time Warp)
সমুদ্রের নিচে হারানো আটলান্টিস নগরী
যদিও এসব তত্ত্বের কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই, তবু বই, সিনেমা ও ডকুমেন্টারিতে এগুলো জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
আধুনিক গবেষণা ও বাস্তবতা
বিভিন্ন গবেষণা ও তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে:
বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলে দুর্ঘটনার হার অন্যান্য সমুদ্র অঞ্চলের চেয়ে বেশি নয়।
বেশিরভাগ দুর্ঘটনার কারণ ছিল প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যান্ত্রিক ত্রুটি বা মানবিক ভুল।
মার্কিন সরকার বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলকে কোনো বিশেষ বিপদজনক অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি।
কেন রহস্য এখনো বেঁচে আছে?
গণমাধ্যমের প্রভাব: সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন ও সিনেমা এই রহস্যকে বড় করেছে।
অজানার প্রতি কৌতূহল: মানুষ অদৃশ্য ঘটনা পছন্দ করে।
অতিপ্রাকৃত তত্ত্ব: রহস্যময় গল্প শোনার প্রতি মানুষের আগ্রহ।
বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল একসময় বিশাল আতঙ্কের নাম ছিল, কিন্তু আধুনিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে এটি অন্য যেকোনো সমুদ্র অঞ্চলের মতোই প্রাকৃতিক ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা। রহস্যের পেছনে রয়েছে আবহাওয়ার বৈশিষ্ট্য, মানবিক ভুল এবং প্রাকৃতিক ঘটনা। তবু অজানা রহস্যের গল্প হিসেবে এটি এখনো বিশ্বের অন্যতম আলোচিত বিষয়।
তথ্যসূত্র
U.S. Coast Guard Reports
National Oceanic and Atmospheric Administration (NOAA)
National Geographic
Encyclopedia Britannica