পম্পেই নগরীর ডেকাল প্লাস্টার ঢালাইয়ের বিস্ময়কর কৌশল
প্রাচীন রোমান শহর পম্পেই (Pompeii) ইতালির সিসিলির নিকটে ভেসুভিয়াস আগ্নেয়গিরির পাদদেশে অবস্থিত। খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীর এই শহরটি ৭৯ খ্রিস্টাব্দে আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণে ধ্বংস হয়। তবে এই ধ্বংসযজ্ঞের ফলে পম্পেই এক অনন্য প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান হয়ে ওঠে। ধ্বংসাবশেষ এবং বসতি থেকে উদ্ধারকৃত নানান নিদর্শন আমাদের প্রাচীন রোমান সভ্যতার দৈনন্দিন জীবন, সামাজিক কাঠামো, শিল্পকলা এবং স্থাপত্য সম্পর্কে অসাধারণ তথ্য প্রদান করে।
পম্পেইকে বিশেষভাবে স্বীকৃতি দেয় তার ডেকাল প্লাস্টার (Plaster Casts) কৌশল। এটি মূলত মৃতদের অঙ্গবিন্যাস বা মৃতদেহের অবস্থান সংরক্ষণ করার একটি অভিনব পদ্ধতি। এই কৌশল প্রায় সমগ্র বিশ্বে প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষক এবং ইতিহাসবিদদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
পম্পেই ধ্বংস এবং মৃতদেহের অবস্থান
৭৯ খ্রিস্টাব্দে ভেসুভিয়াস আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ ঘটে। বিপুল পরিমাণে লাভা, পুঁইকা (Pumice) এবং রোদনীয় ছাই নগরীতে নেমে আসে। এই ছাই এবং ধ্বংসাবশেষ নগরীর ঘরবাড়ি, রাস্তা এবং শহরের নানা নির্মাণকলা দ্রুত আচ্ছাদিত করে।
যদি ছাই মাটির উপর খুব দ্রুত জমে, এটি মৃতদেহের চারপাশে একটি খোসার মতো আবরণ তৈরি করে। রোমানরা তখন জীবনের মতো অঙ্গবিন্যাসে মারা যায়, কিন্তু এই অঙ্গবিন্যাস এবং শরীরের অবস্থা ছাইয়ের আচ্ছাদনে সংরক্ষিত থাকে।
প্রথমে প্রত্নতাত্ত্বিকরা মৃতদেহের আকার দেখতে পান না। ধ্বংসাবশেষ সরানোর পর মৃতদেহ গলে গিয়েছিল, কিন্তু ছাইয়ের ভেতরে তাদের আকারের খোসা বা খালি স্থান রয়ে যায়।
প্লাস্টার ঢালাই কৌশলের উদ্ভব
১৮৬৩ সালে ইতালীয় প্রত্নতাত্ত্বিক ফ্রাঞ্জিস্কো ফয়ো (Francesco Fiano) এই পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। তিনি লক্ষ্য করেন যে মৃতদেহ গলে যাওয়ার পরও ছাইয়ের মধ্যে একটি শূন্য স্থান রয়ে যায়। এই শূন্য স্থানটি মূলত মৃতদেহের আসল আকারের প্রতিবিম্ব।
ফয়ো প্রথমে তরল প্লাস্টার ঢেলে এই শূন্য স্থানে মৃতদেহের আকার পুনর্নির্মাণ করার চেষ্টা করেন। প্লাস্টার শুকানোর পর, এটি এক কঠিন কাস্ট তৈরি করে, যা মৃতদেহের প্রাকৃতিক ভঙ্গি এবং পোশাকের নিখুঁত চিহ্ন ধারণ করে। এটি ছিল এক নতুন ধরনের প্রত্নতাত্ত্বিক উদ্ভাবন যা পরবর্তীতে সমগ্র বিশ্বে পরিচিত হয়।
প্লাস্টার কাস্ট তৈরির প্রক্রিয়া
ডেকাল প্লাস্টার ঢালাই পদ্ধতিটি বেশ সূক্ষ্ম এবং যত্নশীল। এর মূল ধাপগুলো হলো:
ক. মৃতদেহের অবস্থান চিহ্নিত করা
প্রথমে প্রত্নতাত্ত্বিকরা ছাই এবং পুঁইকা আবরণ সরিয়ে মৃতদেহের প্রায় শূন্যস্থান চিহ্নিত করেন।
খ. ছাই সরানো ও প্রস্তুতি
মৃতদেহের চারপাশের ছাই সাবধানে সরানো হয়। প্লাস্টার ঢালাইয়ের আগে শূন্য স্থানটি পরিষ্কার করা এবং কোনো বায়ু বা ধুলো দূর করা হয়।
গ. প্লাস্টার ঢালাই
তরল চুনাপাথরের প্লাস্টার শূন্য স্থানে ঢালা হয়। প্লাস্টার ধীরে ধীরে মৃতদেহের প্রাকৃতিক ভঙ্গি অনুযায়ী সেট হয়ে যায়।
ঘ. শুকানো ও শক্তকরণ
প্লাস্টার সম্পূর্ণ শুকিয়ে গেলে এটি মৃতদেহের নিখুঁত আকার ধারণ করে। এই কঠিন কাস্টটি পরে ধুলো এবং আর্দ্রতা থেকে রক্ষা করে সংরক্ষণ করা হয়।
ঙ. অতিরিক্ত কাজ
কাস্টটি প্রয়োজনে পলিশ বা রঙের মাধ্যমে আরও প্রাকৃতিক চেহারা প্রদান করা হয়। কিছু ক্ষেত্রে মৃতদেহের পোশাক, জুতো বা আনুষঙ্গিক বস্তুও প্লাস্টারে প্রতিফলিত হয়।
ডেকাল প্লাস্টারের বৈজ্ঞানিক গুরুত্ব
এই কৌশল প্রত্নতত্ত্বে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। প্লাস্টার কাস্টগুলি নানান দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ:
মানব জীবন এবং মৃত্যু পরিস্থিতি বোঝা: মৃতদেহের ভঙ্গি থেকে বোঝা যায় তারা কীভাবে মারা গিয়েছিল। উদাহরণস্বরূপ, কেউ বাড়ির দরজায় লুকাতে গিয়ে মারা গিয়েছিল বা কেউ বসে-বসে মারা গিয়েছিল।
শারীরিক বৈশিষ্ট্য: মৃতদেহের কাস্ট থেকে মানুষের উচ্চতা, দেহের গঠন, পেশী কাঠামো এবং এমনকি পোশাকের ধরন নির্ধারণ করা যায়।
সামাজিক তথ্য: কাস্টের প্রাকৃতিক অবস্থান এবং অন্যান্য নিদর্শনের সঙ্গে তুলনা করে প্রাচীন রোমান সমাজের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক তথ্য উদ্ধার করা যায়।
ডেকাল প্লাস্টারের চমকপ্রদ নিদর্শন
পম্পেই থেকে উদ্ধারকৃত কাস্টগুলো দেখলে বোঝা যায় প্রত্নতাত্ত্বিকদের এই কৌশল কতটা কার্যকর ছিল। কয়েকটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হলো:
বাচ্চাদের কাস্ট: আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণে মৃত্যুপ্রাপ্ত বাচ্চাদের কাস্ট খুবই স্পষ্ট এবং আবেগপ্রবণ। এগুলো দেখলে বোঝা যায় তাদের মৃত্যুর সময় তারা কীভাবে অবস্থান করেছিল।
দম্পতিদের কাস্ট: এক দম্পতি বসে বসে মারা গিয়েছিল। কাস্টে তাদের হাতের মেলবন্ধন স্পষ্ট দেখা যায়, যা মানবতার একটি আবেগপ্রবণ ছবি প্রদান করে।
প্রাণীর কাস্ট: শুধুমাত্র মানুষ নয়, ঘোড়া, কুকুর এবং অন্যান্য পোষ্য প্রাণীর কাস্টও উদ্ধার হয়েছে। এগুলো দেখায় যে প্রাচীন রোমানরা প্রাণীদের সাথে কতটা সংযুক্ত ছিল।
প্রত্নতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক মূল্য
ডেকাল প্লাস্টার কাস্ট শুধুমাত্র মৃতদেহের চিত্র নয়; এটি প্রাচীন পম্পেই শহরের জীবনধারার এক অনন্য দৃষ্টান্ত। এগুলো থেকে ইতিহাসবিদরা শহরের জীবনযাত্রা, রাস্তা, বাড়ির বিন্যাস এবং জনসাধারণের আচরণ সম্পর্কে তথ্য আহরণ করেন।
এছাড়া, এই কাস্টগুলো দর্শনার্থীদের জন্য একটি সরাসরি ভিজ্যুয়াল অভিজ্ঞতা প্রদান করে। মৃতদের ভঙ্গি, আবেগ এবং মৃত্যুর মুহূর্ত সরাসরি চোখের সামনে ফুটে ওঠে। এটি প্রাচীন সভ্যতার প্রতি একটি মানবিক সংযোগ স্থাপন করে।
আধুনিক প্রযুক্তি ও উন্নতি
বর্তমান সময়ে এই কৌশলকে আরও উন্নত করা হয়েছে। ২০–২১ শতকে প্রত্নতাত্ত্বিকরা ৩ডি স্ক্যানিং এবং লেজার ইমেজিং ব্যবহার করে কাস্টের ডিজিটাল মডেল তৈরি করেছেন। এর ফলে:
মূল কাস্টকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করা যায়।
গবেষকরা দূর থেকে গবেষণা করতে পারেন।
বিশ্বের যেকোনো জায়গা থেকে শিক্ষার্থীরা এই নিদর্শন অধ্যয়ন করতে পারে।
পম্পেই নগরীর ডেকাল প্লাস্টার কাস্ট কৌশল প্রাচীন রোমান সভ্যতার চমৎকার সংরক্ষণ পদ্ধতির উদাহরণ। এটি মৃতদেহের অঙ্গবিন্যাসকে সংরক্ষণ করেই ইতিহাসকে চোখের সামনে নিয়ে আসে। এই কৌশল শুধুমাত্র প্রত্নতাত্ত্বিক ক্ষেত্রেই নয়, মানব ইতিহাস, শিল্পকলা এবং সাংস্কৃতিক অধ্যয়নের ক্ষেত্রেও এক বিরল সম্পদ।
প্লাস্টার ঢালাই কৌশল মানব ইতিহাসকে বুঝতে এবং প্রাচীন সভ্যতার জীবনযাত্রার সাথে সংযুক্ত হতে আমাদের জন্য একটি জীবন্ত উইন্ডো হিসেবে কাজ করছে। পম্পেইর কাস্টগুলো প্রমাণ করে যে, মৃত্যুর মধ্যেও ইতিহাস বাঁচিয়ে রাখা যায় এবং প্রাচীন সভ্যতার সঙ্গে আমাদের সংযোগ স্থাপন করা সম্ভব।
তথ্যসূত্র
Pompeii: The Life of a Roman Town – Mary Beard, Profile Books, 2008.
The Buried City: Life in Pompeii and Herculaneum – John J. Dobbins & Pedar W. Foss, Oxford University Press, 2007.
Pompeii: Public and Private Life – Andrea Carandini, Harvard University Press, 2003.
UNESCO World Heritage Centre – Pompeii, Herculaneum and Torre Annunziata,