Saturday, October 4, 2025
Homeইতিহাসবিশ্বের প্রথম কাঠের সাবমেরিন

বিশ্বের প্রথম কাঠের সাবমেরিন

বিশ্বের প্রথম কাঠের সাবমেরিন

মানুষ বহু যুগ ধরেই জলের তলদেশে ডুবে থাকা অজানা জগতকে আবিষ্কারের স্বপ্ন দেখেছে। আজকের আধুনিক পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন আসার অনেক আগে থেকেই কিছু অগ্রদূত মানুষ এমন এক নৌযান তৈরির চেষ্টা করেছিলেন, যা পানির নিচে চলতে পারবে। এই প্রচেষ্টার ফলেই ইতিহাসে দেখা দেয় প্রথম কাঠের তৈরি সাবমেরিন—এক বিপ্লবী আবিষ্কার, যা প্রযুক্তির নতুন দিগন্ত খুলে দেয়।

প্রাচীন কল্পনা থেকে বাস্তবতা

প্রাচীন গ্রিসের দার্শনিক এরিস্টটল ও ঐতিহাসিক হেরোডোটাস মানুষের পানির নিচে শ্বাস নেওয়ার কৌশল বা ডাইভিং বেল নিয়ে লিখেছিলেন। কিন্তু পানির নিচে নৌযান চালানোর বাস্তব প্রয়োগ আসে অনেক পরে।

১৫শ শতকে: লিওনার্দো দা ভিঞ্চি সাবমেরিনের কিছু নকশা করেছিলেন, যদিও সেগুলো কাগজেই সীমাবদ্ধ ছিল।

১৬শ শতকে: ১৫৭৮ সালে ইংরেজ উদ্ভাবক উইলিয়াম বর্ন প্রথম সাবমেরিনের ধারণা দেন, তবে বাস্তবে তা তৈরি করতে পারেননি।

বাস্তবিক অর্থে প্রথম কাঠের সাবমেরিন আবির্ভূত হয় ১৭শ শতকে।

কর্নেলিস ড্রেবেল – ডাচ উদ্ভাবক (১৬২০-এর দশক)

ডাচ উদ্ভাবক কর্নেলিস ড্রেবেল ১৬২০-২৪ সালের দিকে ইংল্যান্ডের রাজা জেমস প্রথমের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রথম কার্যকর সাবমেরিন তৈরি করেন।

নির্মাণ

উপাদান: কাঠের কাঠামো, যার চারপাশে জলরোধী করতে চামড়া ব্যবহার করা হয়েছিল।

আকৃতি: দেখতে অনেকটা ছোটো নৌকার মতো।

ধারণক্ষমতা: প্রায় ১২-১৬ জন মানুষ বসতে পারত।

চালনা: ডোঙার মতো কাঠি (ওয়ার/চাকা) দিয়ে চালানো হতো, যা জলরোধী চামড়ার ফাঁক দিয়ে বাইরে বের হত।

কার্যপ্রণালী

নৌযানটি মানুষ নিজের হাতে বৈঠা চালিয়ে পানির নিচে এগোত।

ভেসে থাকা বা ডোবার জন্য ব্যবহার করা হতো পানিভর্তি বস্তা বা কাঠামোর ভারসাম্য।

বাতাস সরবরাহের বিষয়টি স্পষ্ট নয়—কেউ কেউ মনে করেন, ড্রেবেল রাসায়নিক উপায়ে অক্সিজেন তৈরি করতেন।

পরীক্ষা

টেমস নদীতে এর সফল পরীক্ষা চালানো হয়। এটি প্রায় ১২–১৫ ফুট গভীরে ডুবতে পেরেছিল এবং তিন ঘণ্টা পর্যন্ত পানির নিচে থাকতে সক্ষম হয়েছিল। রাজা জেমস নিজে এর একটি প্রদর্শনী দেখেছিলেন এবং অভিভূত হয়েছিলেন।

পরবর্তী উন্নয়ন

ড্রেবেলের সাফল্যের পর ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন উদ্ভাবক কাঠের সাবমেরিন তৈরির চেষ্টা চালান।

জিওভান্নি বোরেল্লি (ইতালি, ১৬৮০): এক ধরনের সাবমেরিনের নকশা দেন, যা পায়ে হাঁটার চাকায় চলত।

নাথানিয়েল সাইমনস (ইংল্যান্ড, ১৭২৯): কাঠের সাবমেরিন তৈরি করেন, যা পানির ট্যাঙ্ক ভরাট বা খালি করে ভেসে থাকা নিয়ন্ত্রণ করত।

ডেভিড বুশনেল (আমেরিকা, ১৭৭৫): বিপ্লবী যুদ্ধের সময় তৈরি করেন বিখ্যাত টার্টল, প্রথম যুদ্ধ-সাবমেরিন।

আমেরিকান টার্টল (১৭৭৫)

আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধে ডেভিড বুশনেল কাঠ ও লোহার সাহায্যে টার্টল নামের একক যাত্রীবাহী সাবমেরিন তৈরি করেন।

বৈশিষ্ট্য

উপাদান: ওক কাঠ ও লোহার আবরণ।

আকৃতি: দেখতে অনেকটা কচ্ছপের খোলসের মতো।

আকার: প্রায় ৭ ফুট উঁচু।

চালনা: হাতঘোরানো প্রপেলার—একটি সামনে এগোনোর জন্য, অন্যটি ওপরে-নিচে ওঠানামার জন্য।

বাতাস: ৩০ মিনিট পর্যন্ত শ্বাস নেওয়া যেত।

অস্ত্র: শত্রু জাহাজে বিস্ফোরক লাগানোর জন্য একটি ড্রিল।

ব্যবহার

১৭৭৬ সালে এটি ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজ HMS Eagle-এর বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়। আক্রমণ সফল হয়নি, কিন্তু এটি প্রমাণ করে যে সাবমেরিন যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহার করা সম্ভব।

কাঠের সাবমেরিনের সীমাবদ্ধতা

যদিও যুগান্তকারী, তবুও কাঠের সাবমেরিনগুলির কিছু বড় সমস্যা ছিল—

কাঠ ও চামড়া গভীর জলে টেকসই ছিল না।

বাতাসের ঘাটতি ছিল বড় বাধা।

বৈঠা বা হাতঘোরানো প্রপেলারে গতি খুব ধীর হত।

দিকনির্দেশ ও নেভিগেশনের কোনো নির্ভরযোগ্য যন্ত্র ছিল না।

উত্তরাধিকার ও প্রভাব

এই প্রাথমিক কাঠের সাবমেরিনই পরবর্তীতে উন্নত নকশার ভিত্তি গড়ে দেয়।

১৯শ শতকে: কাঠের বদলে লোহা ও ইস্পাত ব্যবহার শুরু হয়। মার্কিন গৃহযুদ্ধে Hunley নামের সাবমেরিন প্রথমবার সফলভাবে শত্রু জাহাজ ডুবায়।

২০শ শতকে: ডিজেল ইঞ্জিন, বৈদ্যুতিক শক্তি, পরে পারমাণবিক শক্তি যোগ হয়।

আধুনিক যুগে: আজকের সাবমেরিন সমুদ্রের নিচে মাসের পর মাস থাকতে পারে, জাহাজ ও ক্ষেপণাস্ত্র বহন করতে পারে।

ঐতিহাসিক গুরুত্ব

প্রথম কাঠের সাবমেরিন ইতিহাসে এক অনন্য অধ্যায়—

এটি মানুষের পানির নিচে ভ্রমণের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেয়।

যুদ্ধক্ষেত্রে সাবমেরিন ব্যবহারের সূচনা করে।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে।

সীমিত জ্ঞান ও উপকরণ নিয়েও মানুষের সৃজনশীলতার এক অসাধারণ নিদর্শন।

বিশ্বের প্রথম কাঠের সাবমেরিন ছিল মানব ইতিহাসের সাহসী এক পদক্ষেপ। কর্নেলিস ড্রেবেলের টেমস নদীর পরীক্ষামূলক নৌযান থেকে শুরু করে ডেভিড বুশনেলের টার্টল পর্যন্ত—এগুলো প্রমাণ করে যে মানুষের কল্পনা সীমাহীন। কাঠের সাবমেরিন আজকের আধুনিক স্টিল-জায়ান্টগুলির সঙ্গে তুলনাহীন হলেও, এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ এটাই ছিল পানির নিচে মানুষের যাত্রার সূচনা।

তথ্যসূত্র

Konstam, Angus. Submarines: 1776–1940. Osprey Publishing, 2001.

Howarth, David. The Dreadnoughts. Collins, 1979.

Encyclopaedia Britannica – “Submarine: Early developments.”

Science Museum, London – Collections on Drebbel’s submarine model.

Itihasar Golpo
Itihasar Golpohttps://itihasargolpo.com
Step into the past with our unforgettable historical journey. Discover the secrets of history on our captivating journey.
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments