Friday, October 3, 2025
Homeইতিহাসলেখার আবিষ্কার – মানব সভ্যতার মাইলফলক

লেখার আবিষ্কার – মানব সভ্যতার মাইলফলক

লেখার আবিষ্কার – মানব সভ্যতার মাইলফলক

লেখার আবিষ্কার মানব ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অর্জন। এটি কেবল তথ্য সংরক্ষণের উপায়ই নয়, বরং জ্ঞান, সংস্কৃতি, প্রশাসন ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ভিত্তি গড়ে তুলেছে। লেখার উদ্ভবের আগে মানুষ মৌখিকভাবে গল্প, ঐতিহ্য ও জ্ঞান প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে স্থানান্তর করত। কিন্তু মৌখিক পদ্ধতিতে তথ্য হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল অনেক বেশি। লেখার মাধ্যমে তথ্য স্থায়ীভাবে সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়, যা সভ্যতার বিকাশে বিরাট ভূমিকা রাখে। বিভিন্ন স্থানে লেখার স্বাধীন উদ্ভাবন প্রমাণ করে যে, মানুষের মধ্যে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা বিনিময়ের আকাঙ্খা একটি সহজাত প্রবৃত্তি। 

প্রাথমিক ধাপ – চিত্রলিপি থেকে প্রতীকী লেখায়

লেখার সূচনা হয়েছিল চিত্রলিপি (pictographs) দিয়ে, যেখানে বস্তু বা ধারণাকে সরল ছবির মাধ্যমে প্রকাশ করা হত। উদাহরণস্বরূপ, একটি গরুর ছবি গরুকে বোঝাত, আর সূর্যের চিত্র সূর্যকে বোঝাত। ধীরে ধীরে মানুষ জটিল ধারণা প্রকাশের জন্য প্রতীকী চিহ্ন ব্যবহার শুরু করে। এটি আইডিওগ্রাম (ideograms) নামে পরিচিত। এখানে চিহ্নগুলি কেবল বস্তু নয়, বরং ভাব বা ক্রিয়াকেও প্রকাশ করত।

প্রাচীনতম পরিচিত লিপি

সুমেরীয় কিউনিফর্ম

প্রায় খ্রিস্টপূর্ব ৩২০০ সালে মেসোপটেমিয়ার সুমের অঞ্চলে উদ্ভব।

কাদা ফলকের উপর বাঁশের কলম দিয়ে ত্রিকোণাকৃতি চিহ্ন আঁকা হত, যা শুকিয়ে বা পুড়িয়ে সংরক্ষণ করা যেত।

শুরুতে হিসাব-নিকাশ ও প্রশাসনিক কাজে ব্যবহৃত হলেও পরে সাহিত্য, আইন ও বিজ্ঞানে প্রয়োগ শুরু হয়।

মিশরীয় হায়ারোগ্লিফ

প্রায় খ্রিস্টপূর্ব ৩১০০ সালের দিকে প্রাচীন মিশরে উদ্ভব।

ছবি, প্রতীক ও ধ্বনির মিশ্রণে গঠিত।

ধর্মীয় শিলালিপি, সমাধি, প্যাপিরাস পাণ্ডুলিপি ও প্রশাসনিক নথিতে ব্যবহৃত হত।

সিন্ধু লিপি

প্রায় খ্রিস্টপূর্ব ২৬০০–১৯০০ সালের মধ্যে সিন্ধু উপত্যকা সভ্যতায় ব্যবহৃত।

মাটির সীলমোহর ও পাথরের উপর খোদাই করা হত।

এখনো সম্পূর্ণরূপে পাঠোদ্ধার হয়নি, ফলে তাদের ভাষা ও অর্থ রহস্যময়।

চীনা লিপি

প্রায় খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ সালে শাং রাজবংশের সময় কচ্ছপের খোল ও পশুর হাড়ে খোদাই করা ওরাকল-বোন লিপি (oracle bone script) ছিল প্রথম রূপ।

ধীরে ধীরে এটি বিকশিত হয়ে আধুনিক চীনা অক্ষরে পরিণত হয়।

লেখার বিকাশ ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতি

লেখা প্রথমে পাথর, ধাতু বা কাদায় খোদাই করা হত, যা স্থায়ী হলেও ভারী ছিল। পরে প্যাপিরাস (মিশর), পার্চমেন্ট (প্রাণীর চামড়া) এবং কাগজ (চীন, খ্রিস্টাব্দ ২য় শতক) ব্যবহার শুরু হয়, যা লেখাকে বহনযোগ্য ও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দিতে সহায়তা করে। চীনে কাঠের ব্লকে মুদ্রণ প্রযুক্তি আবিষ্কারের ফলে লেখা দ্রুত পুনরুত্পাদন সম্ভব হয়। পরে ১৫শ শতকে জোহানেস গুটেনবার্গের মুদ্রণযন্ত্রের আবিষ্কার বিশ্বব্যাপী জ্ঞান বিস্তারে বিপ্লব ঘটায়।

লেখার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব

প্রশাসন ও আইন – আইন সংকলন, কর আদায়, জমির নথি সংরক্ষণে লেখা অপরিহার্য হয়ে ওঠে। হ্যামুরাবির আইনসংহিতা তার একটি প্রাচীন উদাহরণ।

ব্যবসা-বাণিজ্য – হিসাব-নিকাশ ও চুক্তি রেকর্ড করার ফলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সহজ হয়।

ধর্ম ও দর্শন – ধর্মীয় গ্রন্থ, প্রার্থনা ও আচারবিধি লিপিবদ্ধ হওয়ায় সেগুলো প্রজন্মের পর প্রজন্মে সংরক্ষিত থাকে।

বিজ্ঞান ও শিক্ষা – লেখা না থাকলে জ্ঞান ধারাবাহিকভাবে সঞ্চয় ও উন্নয়ন সম্ভব হতো না।

সাহিত্য ও ইতিহাস – মহাকাব্য, নাটক, কবিতা ও ঐতিহাসিক দলিল আমাদের অতীত সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দেয়।

লেখার রূপান্তর – প্রতীক থেকে ধ্বনিগত লিপি

লেখা একসময় শুধুমাত্র চিত্র ও প্রতীকের মাধ্যমে ছিল, কিন্তু ধীরে ধীরে ধ্বনিগত লিপির উদ্ভব হয়। এর বড় উদাহরণ ফিনিশীয় বর্ণমালা (খ্রিস্টপূর্ব ১০৫০ সালের দিকে), যা পরবর্তীতে গ্রিক ও ল্যাটিন বর্ণমালার ভিত্তি হয়। এই ধ্বনিগত পদ্ধতিতে শেখা ও ব্যবহার সহজ হওয়ায় সাধারণ মানুষের মধ্যে লেখার প্রসার ঘটে।

আধুনিক যুগে লেখার পরিবর্তন

আজকের দিনে লেখা কেবল কাগজে নয়, ডিজিটাল মাধ্যমে সংরক্ষিত হচ্ছে। কীবোর্ড, টাচস্ক্রিন ও ভয়েস-টু-টেক্সট প্রযুক্তি লেখাকে আরও দ্রুত ও সহজ করেছে। তবুও এর মূল উদ্দেশ্য অপরিবর্তিত — জ্ঞান, ভাবনা ও অনুভূতি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে পৌঁছে দেওয়া।

লেখার আবিষ্কার মানব সভ্যতার জন্য একটি বাঁকবদলকারী ঘটনা। এটি মানুষের যোগাযোগের সীমা বাড়িয়েছে, ইতিহাস ও জ্ঞানকে সংরক্ষণ করেছে এবং সংস্কৃতি বিনিময়ের পথ খুলে দিয়েছে। প্রাচীন কিউনিফর্ম ফলক থেকে শুরু করে আজকের ডিজিটাল স্ক্রিন—লেখা মানবজাতির অগ্রযাত্রার অবিচ্ছেদ্য অংশ।

তথ্যসূত্র:

Cooper, Jerrold S. Sumerian and Akkadian Administrative Texts. University of Pennsylvania Press.

Coulmas, Florian. The Blackwell Encyclopedia of Writing Systems. Blackwell Publishing.

Daniels, Peter T., and Bright, William. The World’s Writing Systems. Oxford University Press.

Itihasar Golpo
Itihasar Golpohttps://itihasargolpo.com
Step into the past with our unforgettable historical journey. Discover the secrets of history on our captivating journey.
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments