Saturday, October 4, 2025
Homeস্থাপত্যস্টোনহেঞ্জ: এক প্রত্নতাত্ত্বিক রহস্য

স্টোনহেঞ্জ: এক প্রত্নতাত্ত্বিক রহস্য

স্টোনহেঞ্জ: এক প্রত্নতাত্ত্বিক রহস্য

স্টোনহেঞ্জ (Stonehenge) বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন এবং রহস্যময় স্থাপত্য নিদর্শন। এটি ইংল্যান্ডের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশে উইল্টশায়ার কাউন্টির সালসবুরি সমতলে অবস্থিত। প্রায় ৫০০০ বছর পূর্বে নির্মিত এই পাথরের বৃত্তটি শুধু ব্রিটেন নয়, সমগ্র বিশ্বের গবেষক, পর্যটক ও ইতিহাসপ্রেমীদের জন্য এক অপার আগ্রহের বিষয় হয়ে উঠেছে। স্টোনহেঞ্জ তার অসাধারণ নির্মাণ শৈলী, আকাশ পর্যবেক্ষণ পদ্ধতি এবং সাংস্কৃতিক তাৎপর্যের জন্য বিখ্যাত।

নির্মাণের কাল ও ধাপ

স্টোনহেঞ্জের নির্মাণ ধাপগুলো সময়ের পরিক্রমায় গঠিত হয়েছিল, যা সাধারণত তিনটি প্রধান ধাপে ভাগ করা হয়:

প্রথম ধাপ (~ খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০): এই সময় মূলত একটি বড় পরিখা (ditch) এবং তার বাইরের দিকে একটি বাঁধানো মাটির ঢিবি (bank) নির্মিত হয়। এই সময়ের স্থাপনাকে ‘হেঞ্জ’ বলা হয়, যার জন্য স্টোনহেঞ্জ নামটি এসেছে। এখানে কবর হিসেবে ব্যবহৃত গর্তগুলোও পাওয়া গেছে।

দ্বিতীয় ধাপ (~ খ্রিস্টপূর্ব ২৯০০-২৬০০): এই সময়ে কাঠের স্তম্ভ এবং পরবর্তী কালে ব্লুস্টোন নামে পরিচিত ছোট পাথরের স্থাপন শুরু হয়। এই ব্লুস্টোনগুলো আনুমানিক ২০০ কিমি দূরের ওয়েলসের প্রেসেলি পাহাড় থেকে আনা হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়।

তৃতীয় ধাপ (~ খ্রিস্টপূর্ব ২৫০০): এটি স্টোনহেঞ্জের মূল আকৃতির সময়কাল। এই সময় বিশাল সেরসেন (Sarsen) পাথরগুলোর স্থাপন হয় এবং এই পাথরগুলোর ওপর অনুভূমিকভাবে স্থাপিত হয় লিনটেল (lintel) নামক পাথরগুলো, যেগুলো বৃত্তাকার কাঠামো তৈরি করে।

স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য

স্টোনহেঞ্জের স্থাপত্য একদিকে প্রাচীন প্রযুক্তির সাক্ষ্য বহন করে, অন্যদিকে প্রত্নতাত্ত্বিক বিস্ময়ের জন্ম দেয়। এর নির্মাণকাজে ব্যবহৃত প্রধান দুই ধরনের পাথর:

সারসেন পাথর: বিশালাকৃতির, প্রায় ২৫ টন ওজনের এই পাথরগুলো ২০ কিমি দূরের মার্লবরো ডাউনস থেকে আনা হয়েছিল।

ব্লুস্টোন: অপেক্ষাকৃত ছোট পাথর, যেগুলোর উৎস ২০০ কিমি দূরের ওয়েলসের প্রেসেলি পাহাড়।

এই পাথরগুলো যেভাবে একে অপরের ওপর বসানো হয়েছে এবং তাদের ভারসাম্য রক্ষা করা হয়েছে, তা আধুনিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের দৃষ্টিকোণ থেকেও বিস্ময়কর।

উদ্দেশ্য ও কার্যকারিতা

স্টোনহেঞ্জের প্রকৃত উদ্দেশ্য আজও নির্দিষ্টভাবে জানা যায়নি। তবে বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক, জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও নৃবিজ্ঞানীরা বিভিন্ন মতামত দিয়েছেন:

জ্যোতির্বিজ্ঞান কেন্দ্র: স্টোনহেঞ্জ সূর্য এবং চন্দ্রের অবস্থান অনুযায়ী তৈরি, বিশেষ করে গ্রীষ্ম ও শীতকালীন সূর্যাস্ত ও সূর্যোদয়ের সময় সূর্যের রশ্মি একটি নির্দিষ্ট পাথরের মাঝ দিয়ে পড়ে। তাই এটি প্রাচীন সময়ের সৌর ক্যালেন্ডার বা নাক্ষত্রিক পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র ছিল বলে ধারণা করা হয়।

ধর্মীয় ও আচার অনুষ্ঠান: অনেকে মনে করেন এটি একটি পবিত্র স্থান ছিল যেখানে মৃতদের দাহ বা কবর দেওয়ার অনুষ্ঠান হত এবং সূর্য ও প্রকৃতির শক্তির পূজা করা হতো।

আরোগ্য কেন্দ্র: কিছু গবেষক মনে করেন, ব্লুস্টোন পাথরগুলোর সাথে নিরাময় ক্ষমতা সম্পর্কিত বিশ্বাস জড়িত ছিল। এই কারণে মানুষ এখানে সুস্থতার উদ্দেশ্যে আসত।

প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার

স্টোনহেঞ্জে প্রচুর হাড়, পোড়ানো দেহাবশেষ, হরিণ ও গরুর হাড় পাওয়া গেছে। এগুলো থেকে জানা যায় যে এটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের স্থান। এছাড়া এখানে প্রাপ্ত কিছু যন্ত্রপাতি ও অস্ত্র প্রাচীন ব্রোঞ্জ যুগের সাংস্কৃতিক চিহ্ন বহন করে।

২০০৮ সালে এক প্রত্নতাত্ত্বিক দলে নেতৃত্ব দেন প্রফেসর মাইক পার্কার পিয়ারসন, যিনি আশেপাশের বসতিস্থল ‘ডারিংটন ওয়ালস’-এ খনন করে স্টোনহেঞ্জের সাথে সংশ্লিষ্ট একটি বড় উৎসবের ব্যবস্থা থাকার সম্ভাবনার কথা জানান। এখানে হাজারো মানুষ একত্র হয়ে সামাজিক অনুষ্ঠান করত।

আধুনিক গবেষণা ও সংরক্ষণ

আজকের দিনে স্টোনহেঞ্জ ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের স্বীকৃতি পেয়েছে (১৯৮৬)। এটি ইংল্যান্ডের অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্রও। ব্রিটিশ সরকার এবং ‘English Heritage’ নামক সংস্থা এর রক্ষণাবেক্ষণ এবং পর্যটকদের জন্য সাশ্রয়ী ভ্রমণব্যবস্থা গড়ে তুলেছে।

বর্তমানে লেজার স্ক্যানিং, কার্বন ডেটিং এবং ভূ-আবিষ্কার প্রযুক্তি ব্যবহার করে এর নির্মাণকাল, ব্যবহার ও পরিবর্তনের সময়কাল শনাক্ত করা হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা মনে করছেন যে স্টোনহেঞ্জ একক নির্মাণ ছিল না, বরং এটি একাধিক শতাব্দী ধরে সংস্কার ও রূপান্তরের মাধ্যমে গড়ে উঠেছে।

সংস্কৃতি ও কল্পনায় স্টোনহেঞ্জ

স্টোনহেঞ্জ বহু কল্পকাহিনি, সাহিত্য, সিনেমা ও ডকুমেন্টারিতে স্থান পেয়েছে। কেউ কেউ এটিকে ড্রুইডদের উপাসনাস্থল বলেছেন, কেউ আবার বিশ্বাস করেন এটি এলিয়েন বা ভিনগ্রহের প্রাণীদের তৈরি। যদিও এসব ধারণার কোন প্রামাণ্য ভিত্তি নেই, তবে স্টোনহেঞ্জ মানুষের কল্পনার জগতে এক বিশেষ স্থান দখল করে আছে।

স্টোনহেঞ্জ শুধু একটি প্রাচীন স্থাপত্য নয়, এটি মানব ইতিহাসের এক জীবন্ত প্রতীক—যেখানে প্রাচীন মানুষের বিশ্বাস, জ্ঞান, সমাজব্যবস্থা ও প্রকৃতির সঙ্গে সংযোগের ইঙ্গিত লুকিয়ে আছে। এটি মানব সভ্যতার বিকাশ, আচার-অনুষ্ঠান ও প্রযুক্তির ধারাকে বোঝার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক কুসুম, যা আজও আমাদের বিস্মিত করে।

তথ্যসূত্র:

English Heritage (www.english-heritage.org.uk)

UNESCO World Heritage Centre

Parker Pearson, M. Stonehenge: Exploring the Greatest Stone Age Mystery

BBC History & National Geographic archives

Itihasar Golpo
Itihasar Golpohttps://itihasargolpo.com
Step into the past with our unforgettable historical journey. Discover the secrets of history on our captivating journey.
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments